আঠারো শতকের দিকে নীল নদের পূর্ব তীরে মধ্য মিশরের মরুভূমি অঞ্চলে এক বন্ধ্যা এলাকায় খুঁজে পাওয়া যায় একটি শহরের ধ্বংসাবশেষ, আজও পর্যন্ত যেখানে নতুন কিছু খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা অব্যাহত আছে। শহরটির নাম ‘আমার্না’। বিশ্বের প্রথম একেশ্বরবাদ প্রতিষ্ঠায় কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে পূর্ব দিকে মুখ করে থাকা এ শহরটি, যেনো অবয়বহীন সূর্যদেবতা আতেন সরাসরি শহরটিতে তার দিব্য আলোর দীপ্তি ছড়াতে পারেন। আর এই যাদুকরী শহর গড়ার কারিগর হলেন খোদ মিশরীয় ফারাও আখেনাতেন।
ফারাও আখেনাতেনের ফারাও হয়ে ওঠার গল্পটি আরও বেশি রোমাঞ্চকর। আসলে আখেনাতেনের নামও আগে ‘আখেনাতেন’ ছিলো না এবং তার ফারাও হবারও কথা ছিলো না। তিনি তৃতীয় আমেনহোটেপের সেই ছেলে, যিনি প্রায় পাঁচ থেকে আট বছর সহ-প্রতিনিধি হিসেবে বাবার সাথে মিশর শাসন করেছেন।
তৃতীয় আমেনহোটেপের পর ফারাও হবার কথা ছিলো তার বড় ছেলে থুতমোসের। কিন্তু মিশরের ইতিহাসের ভাগ্যে লেখা ছিলো ‘পরিবর্তন’। ফারাও হবার আগেই মারা গেলেন রাজকুমার থুতমোস। তৃতীয় আমেনহোটেপ ও তার স্ত্রী টিয়ের ছেলে সন্তান মাত্র দুই জনই ছিলেন। তাই থুতমোস মারা গেলে ছোট ছেলেকেই ফারাও বানানো হবে বলে মনস্থির হলো।
তৃতীয় আমেনহোটেপের মৃত্যুর পর যথারীতি তার ছোট ছেলে ‘চতুর্থ আমেনহোটেপ’ নাম নিয়ে মিশর শাসন শুরু করলেন। তার বাবা তৃতীয় আমেনহোটেপ ছিলেন অসম্ভব দূরদর্শী এক ব্যক্তিত্ব। বিদেশী রাষ্ট্রের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক রক্ষায় তার অবদান ছিলো অপরিসীম। পাঁচ বছর পর্যন্ত চতুর্থ আমেনহোটেপ বাবার পদাঙ্ক অনুসরণ করেন এবং মিশরীয় রীতি-নীতির আওতাভুক্ত থেকেই কাজ করেন। তবে পাঁচ বছর শাসনের পর ক্ষমতাবান পুরোহিতদের সাথে ফারাও এর দ্বন্দ্বই প্রধান হয়ে উঠলো চতুর্থ আমেনহোটেপের জীবনে। মন্দির পরিচালনা ও দেবতার উপাসনার নামে অসৎ পুরোহিতেরা দিন দিন ফারাও এর নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছিলেন। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য একটি নতুন ধর্ম প্রতিষ্ঠায় মনোযোগী হলেন ফারাও চতুর্থ আমেনহোটেপ। সম্পূর্ণ অন্য এক মানুষে পরিণত হলেন তিনি। তার ব্যক্তিজীবনের প্রভাব পড়লো রাষ্ট্রেও।
মিশরের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য ছিলো অপরিবর্তনশীলতা। একজন ফারাও এর নাম শুধু তার পারিবারিক পরিচয়ই নয়, বরং তার ধর্মীয় ও রাজনৈতিক পরিচয়ও বহন করতো। ‘আমেনহোটেপ’ শব্দটির অর্থ হলো ‘আমুন সন্তুষ্ট’। সুতরাং এই নামধারী ব্যক্তি নিঃসন্দেহে আমুন দেবতার প্রতি নিবেদিত। কিন্তু চতুর্থ আমেনহোটেপের জীবনে রাজত্বের ষষ্ঠ বছরে এক বিশাল পরিবর্তন আসে। তিনি মিশরে পরিবর্তন নিয়ে আসেন, প্রতিষ্ঠা করেন একেশ্বরবাদের ধারণা।
চতুর্থ আমেনহোটেপ প্রথমে নিজের নাম পরিবর্তন করে রাখেন ‘আখেনাতেন’, অর্থাৎ ‘আতেনের সন্তান’। তিনি এক ঈশ্বর আতেন বা সূর্য দেবতার এমন এক ধারণা চালু করেন, যিনি বাহ্যিক প্রতিকৃতির ঊর্ধ্বে। ফারাও এর নাম পরিবর্তনই মিশরের সাধারণ জনগণ ও পুরোহিতদেরকে উদ্ধত করে তুলেছিলো, তার উপর এই একেশ্বরবাদ তো মিশরের ধর্মীয় ভিতকেই নাড়িয়ে দিয়েছিলো।
মিশরীয় পুরোহিতরা অনেক বছর ধরেই বহুদেবতার পূজা ও তাদের সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে বলি প্রদানের জন্য সাধারণ জনগণের কাছ থেকে চাঁদা সংগ্রহ করতেন। আখেনাতেন যখন এসব দেবতার উপাসনা বাতিল ঘোষণা করলেন, তখন পুরোহিতদের এই বিপুল আয়ের রাস্তা বন্ধ হয়ে গেলো। তার উপর ধর্মীয় বিশ্বাসের ক্ষেত্রে জনমনে বিরূপ প্রভাবের সৃষ্টি হলো। তবে এই প্রভাবকে প্রশমিত করার কোনো চেষ্টাই করলেন না আখেনাতেন। উলটো তিনি প্রচলিত রাজধানী থিবস থেকে সরিয়ে মরুভূমির এক জনমানবহীন এলাকায় নিয়ে গেলেন এবং তার নাম রাখলেন ‘আখেতাতেন’, অর্থাৎ ‘আতেনের দিগন্ত’। এই আখেতাতেনকেই বলা হয় ‘আমার্না’, যার ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পাওয়া গিয়েছে। আখেনাতেনের রাজধানী পরিবর্তন ও একেশ্বরবাদ প্রবর্তনের সময় থেকেই শুরু হয় ‘আমার্না যুগ’।
আখেনাতেন প্রথম বার মিশরে ছাদবিহীন মন্দিরের ধারণার প্রচলন করেন। তিনি আতেনের উপাসনার জন্য কার্নাকে এসব ছাদবিহীন মন্দির তৈরী করেন। এতে তার দুটি উদ্দেশ্য ছিলো। প্রথমটি হলো, সরাসরি দিনের আলোর সান্নিধ্যে আতেনের উপাসনা এবং দ্বিতীয়টি হলো, মন্দিরের অভ্যন্তরে ক্ষমতাবান পুরোহিতদের অসৎ কাজগুলোকে প্রশ্রয় না দেয়া।
আগেই বলেছি, মিশর পরিবর্তন পছন্দ করতো না। আর এক সাথে এতো পরিবর্তন তো কোনোভাবেই তারা মেনে নিলো না। শুরু হলো বিদ্রোহ। তবে এসব কিছুই ফারাও আখেনাতেনের বিশ্বাসকে এতোটুকু দমাতে পারে নি।
মিশরের ফারাও সব কালেই ছিলেন মিশরের প্রশাসনিক ও সামরিক প্রধান। সুতরাং রাষ্ট্রীয় যে কোনো কাজে তার উপস্থিতি ছিলো বাঞ্চনীয়। ফারাও আখেনাতেন এ নিয়মেরও বিচ্যুতি ঘটালেন। রাজধানী স্থানান্তরের পর তিনি সমগ্র মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করেছিলেন এক আতেনের উপাসনায়। ফলে বিভিন্ন প্রশাসনিক ও সামরিক ক্ষেত্রে তার অনুপস্থিতিও মিশরের জনগণের কাম্য ছিলো না। সম্ভবত এ ক্ষেত্রে তিনি ভুল করেছিলেন। তিনি বিদেশী রাজাদের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক রক্ষায় ব্যর্থ হলেন। মিশরও বহিরাগত সাহায্য-সহযোগিতা থেকে বঞ্চিত হতে লাগলো। সব কিছুর ঊর্ধ্বে শুধুমাত্র ধর্ম প্রতিষ্ঠায় মনোযোগ তাকে রাষ্ট্র ও বৃহত্তর স্বার্থের প্রতি বিমুখ করে তুলেছিলো।
আখেনাতেনের এই পুরো যাত্রায় সহযোগী ছিলেন তার স্ত্রী নেফারতিতি। অনেকের তো ধারণা, একেশ্বরবাদ প্রতিষ্ঠার মূল হোতা নেফারতিতিই ছিলেন এবং তিনি আখেনাতেনকে নিয়ন্ত্রণ করতেন। হয়তো কিছু ক্ষেত্রে এটি সত্যি, তবে আতেনের প্রতি নিবেদিত সেবক হিসেবে মূল ভূমিকা আখেনাতেনই পালন করেছেন।
একক দেবতা আতেনের উপাসক হবার পর থেকে আরও দুটি পরিবর্তন লক্ষ করা যায় আখেনাতেনের কার্যকলাপে। তিনি শিল্প ক্ষেত্রে ও ভাস্কর্য বা ছবি চিত্রায়নে আমূল পরিবর্তন আনেন। তিনি চুম্বনরত স্বামী-স্ত্রী ও সন্তানাদির চিত্র খোদাইয়ে গুরুত্ব দিয়েছেন। এর মাধ্যমে তিনি জীবনে পরিবার ও পারিবারিক সম্পর্কের গুরুত্বকে স্পষ্ট করতে চেয়েছিলেন।
নতুন রাজধানীতে নারীর অধিকার ছিলো অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে সুনির্দিষ্ট ও সুস্পষ্ট। নেফারতিতির নিজস্ব মন্দিরও পাওয়া গেছে আমার্নাতে, যেখানে শুধু তার ও তার মেয়েদের চিত্রই খোদাই করা হয়েছে। আতেনকে উৎসর্গ করার মতো কাজ, যা শুধুমাত্র ফারাও করার অধিকার রাখতেন, তা নেফারতিতিকেও করতে দেখা গিয়েছে।
ফারাও আখেনাতেনের রহস্যজনকভাবে মৃত্যু হয়। স্বপ্নের শহর আমার্না সম্পূর্ণরূপে গড়ে তোলার আগেই এই মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে যায়। এর পর কয়েক মাসের জন্য অন্তর্বর্তীকালীন রাজা হন সামেনখাকারে। কিন্তু তিনিও খুব তাড়াতাড়ি মারা যান। ফলে মিশরের ফারাও হন নেফারতিতি। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আখেনাতেনের অসম্পূর্ণ কাজকে পূর্ণরূপ দেবার আগেই তিনিও রহস্যজনকভাবে মারা যান। এতো সব মৃত্যু স্বাভাবিক নাকি অস্বাভাবিক, তা আমরা জানি না। তবে এতোটুকু নিঃসন্দেহে বলা যায়, আখেনাতেন এবং নেফারতিতির অস্তিত্বকে বিলীন করে দেয়ার পূর্ণ চেষ্টা করা হয়েছিলো।
আসলে আখেনাতেনের পরিবর্তনশীল পদক্ষেপ অগণিত শত্রুর জন্ম দিয়েছিলো। সুতরাং একেশ্বরবাদের এই আমূল পরিবর্তন দমনের জন্য মিশরীয়রা যদি জিঘাংসামূলক কোনো কাজে জড়িয়ে পড়েন, তবে তাতে অবাক হবার কিছু নেই। পরবর্তীতে তার নিজের সন্তান তুতেনখামুনই নিজ হাতে আখেনাতেনের একেশ্বরবাদ প্রতিষ্ঠার সমস্ত নিদর্শন ধ্বংস করে দিয়েছিলেন এবং আরও একবার বহুদেবতার বিশ্বাস প্রতিষ্ঠা পেয়েছিলো মিশরীয় রাজদরবারে।
সর্বোপরি তথাকথিত ‘ধর্মান্ধ’, ‘বোকা’, ‘অলস’, ‘উন্মাদ’, ‘ক্ষ্যাপাটে’, ‘বিদ্রোহী’ রাজার তকমা পাওয়া আখেনাতেন যে বিশ্বের ইতিহাসে প্রথম বিমূর্ত একেশ্বরবাদের প্রবক্তা, এ কথা হলফ করেই বলা যায়। আমি তাকে ‘বিদ্রোহী’ নয়, ‘বিপ্লবী’ বলতে চাই, ‘উন্মাদ’ নয়, ‘দূরদৃষ্টিসম্পন্ন’ বলতে চাই। কেননা পরবর্তীকালের যতো মসিহা একেশ্বরবাদের ধারণা নিয়ে এসেছিলেন, তারা সবাই-ই কিন্তু আখেনাতেনের পদাঙ্কই অনুসরণ করেছিলেন।
রেফারেন্স: