হাজার হাজার বছর ধরে মানুষের মুখে মুখে চলে আসছে নানান রকম কাহিনী। কালক্রমে কিছু কাহিনী পরিণত হয়েছে মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাসের কেন্দ্রবিন্দুতে। এমনই একটি কাহিনী হচ্ছে ‘বারলাম ও জোসেফাত’ এর কাহিনী। বারলাম এবং জোসেফাত খ্রিস্টান ধর্মের প্রতিষ্ঠিত দুটি চরিত্র। এই কাহিনী অনুসারে, জোসেফাতের জন্ম রাজপরিবারে। জোসেফাতের জন্মের সময় তার বাবা রাজা এবিনার গণকদের কাছ থেকে জানতে পারেন যে, তার ছেলে বড় হয়ে সন্ন্যাসী হবেন। এমন কথা শোনার পর রাজা জোসেফাতকে নিয়ে ভীষণ সতর্ক হয়ে যান। কোনোভাবেই যেনো বার্ধক্য, জরা, সাধু এবং মৃত্যুর দেখা জোসেফাত না পায়; সেই ব্যবস্থাই তিনি করে রাখেন। কিন্তু নিয়তিকে বদলানো তো এতো সহজ নয়। ভাবুক জোসেফাত বড় হবার পর ঠিকই এক দিন তার সামনে বয়সের ভারে কুঁজো বৃদ্ধ, রোগগ্রস্ত ব্যক্তি, ধ্যানরত সন্ন্যাসী এবং মৃত ব্যক্তির লাশ দেখা দেয়। তৎক্ষণাৎ জোসেফাতের ভাবোদয় হয়, জীবনের মর্মার্থ তিনি বুঝতে পারেন এবং সংসারমায়া ত্যাগ করে রাজপ্রাসাদ ছেড়ে চলে যান। উদ্দেশ্যবিহীনভাবে চলতে চলতে এক সময় তিনি একজন শিক্ষকের দেখা পান, যিনি তাকে অনেক ছোট ছোট কাহিনী শোনান। সেই শিক্ষকই হলেন বারলাম। বারলামের দীক্ষায় চোখ খুলে যায় জোসেফাতের এবং খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করেন তিনি। পরবর্তীতে জোসেফাতের বাবা রাজা এবিনার, যিনি ধর্মে বিশ্বাসী ছিলেন না, তিনিও এক সময় নিজের ভুল বুঝতে পারেন এবং খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করেন।
বারলাম ও জোসেফাতের এই কাহিনী খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের কাছে দিনে দিনে অনেক বেশি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। অষ্টম শতাব্দীর কোনো এক সময় খলিফা আল ওয়ালিদ ইবনে আব্দুল মালিকের আদালতে সেন্ট জন নামের এক ভদ্রলোক ছিলেন। উনি বারলাম এবং জোসেফাত এর কাহিনী লিখেছিলেন। পরে এগারো শতাব্দীতে আবার ডেভিড মার্শাল ল্যাং এর বারলাম ও জোসেফাতের ওপর লেখা ‘দ্য বালাভারিয়ানি’ কাহিনীটিও অনেক জনপ্রিয়তা পেয়েছিলো। এটিও বিভিন্ন ভাষায় বিভিন্ন দেশে খুব জনপ্রিয়তা পেয়েছিলো। এর পরে প্রায় ১২৬০ সালের দিকে জেনেভার আর্চ বিশপ জ্যাকোবো ফ্যাজিও বিভিন্ন কালের সাধু-সন্ন্যাসীদের অনেকগুলো কাহিনী সংকলন করেন এবং সেখানে বারলাম ও জোসেফাতের কাহিনীটি খুব স্পষ্টভাবে তুলে ধরা হয়েছে। এটিও অনেক বেশি জনপ্রিয় হয়ে যায় পুরো ইউরোপে। ১৪৩৮ সাল পর্যন্ত পৌঁছতে পৌঁছতে ইংরেজি সাহিত্যের শুরুর দিকের গ্রন্থগুলোর মধ্যে উইলিয়াম ক্যাক্সটনের একটি গ্রন্থ ছিলো ‘গোল্ডেন লিজেন্ড’ নামের, যেখানে অনেকগুলো মহামানবের জীবনের কাহিনী উল্লেখ করা হয়েছে এবং বারলাম ও জোসেফাত এর কাহিনীটি সেখানেও স্পষ্টভাবে তুলে ধরা হয়েছে। এই কাহিনীটি এতো বেশি জনপ্রিয় হয়ে গিয়েছিলো যে, ১৫০০ সাল পর্যন্ত পৌঁছতে পৌঁছতে বাইবেলের চেয়েও বেশি সংস্করণ প্রকাশ পেয়েছিলো এই বইটির। এরপর জিওফ্রে চসার এই কাহিনী নিয়ে ‘দ্য পারডোনার্স টেইল’ রচনা করেন, যা পরবর্তীতে পার্সিয়ান ও আরবী ভাষায় অনুদিত হয়। পরে এই কাহিনী আবার উল্লেখিত হয় ‘জেস্টা রোমানোরাম’ নামের অনেক বড় একটি সঙ্কলনগ্রন্থে, যেখানে বিভিন্ন ধরনের কাহিনীর সংকলন থাকতো। এই ‘জেস্টা রোমানোরাম’ থেকে উৎসাহিত হলেন শেক্সপিয়র এবং ঐ সংকলন থেকে ছোটো এই কাহিনীটিকে তুলে ধরে রচনা করলেন ‘দ্য মার্চেন্ট অফ ভেনিস’। আর এরই মাধ্যমে বারলাম ও জোসেফাতের কাহিনী সাহিত্যাঙ্গনে চিরকালের জন্য অমর হয়ে যায়।
বারলাম এবং জোসেফাত এর কাহিনী এই সাহিত্যের কারণে ইউরোপে এতো জনপ্রিয় হয়ে যায় যে, তা এক সময় লোকজনের বিশ্বাসের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। এমনকি গ্রীক চার্চ দশম শতাব্দীতে বারলাম এবং জোসেফাতকে নিজ ধর্মের সাধুসন্ত বলে মেনে নেয়। ১৬১০ সালের কাছাকাছি সময়ে রোমান চার্চও বারলাম ও জোসেফাতকে সাধুসন্ত হিসেবে মেনে নেয়, যার ভিত্তি হল অষ্টম শতাব্দীর সেন্ট জনের রচনা। এখানেই শেষ নয়, ১৫৭১ সালে ভেনিসের প্রথম ডোজে আলভাইজ মোসেনিগো কিছু হাড়ের টুকরো পর্তুগালের রাজার কাছে উপস্থাপন করেন এবং বলেন যে, এগুলো সাধু জোসেফাতের শরীরের ধ্বংসাবশেষ। এই নিদর্শন পাওয়ার পর পর্তুগালের রাজা নিজের জন্য অনেক বড় অবস্থান তৈরী করে ফেলেন। ১৬৩৩ সালে কোনোভাবে এই ধ্বংসাবশেষ অ্যান্টোয়ার্কে পৌঁছে যায় এবং সেখানেই সংরক্ষণ করা হয়। কিন্তু ১৭৫৫ সালের ফরাসি বিপ্লবের পর গায়েব হয়ে যায় সেই হাড়ের টুকরোগুলো।
অবশেষে সতেরো শতাব্দীতে পাওয়া গেলো এক নতুন তথ্য। ভারতের গোয়াতে এলেন পর্তুগীজ ইতিহাসবিদ ডিওগো ডু কুয়োটো এবং আবিষ্কার করলেন গৌতম বুদ্ধকে, যিনি এক সময়ের মহান ধর্ম প্রচারক ছিলেন। ডিওগো ডু কুয়োটো জানতে পারলেন গৌতম বুদ্ধের জীবন কাহিনী। কি আশ্চর্য! গৌতম বুদ্ধের কাহিনীর সাথে জোসেফাতের কাহিনীর কি অদ্ভূত মিল! প্রশ্ন হলো, আসলেই কি মিল, নাকি একই ব্যক্তির জীবনের অভিন্ন কাহিনী এই দুটো?
এর আগেও ১৪৪৬ সালে মার্কো পোলোর একটি বই ছাপা হবার সময় সেই বইয়ের একজন সম্পাদক বলেছিলেন যে, মার্কো পোলো তার বইতে গৌতম বুদ্ধের যে কাহিনী লিখেছেন, তা অদ্ভূতভাবে বারলাম ও জোসেফাতের কাহিনীর সাথে মিলে যায়। অবশেষে ১৯ শতকে সম্পূর্ণভাবে প্রকাশ ঘটে গৌতম বুদ্ধের। জানা যায়, ভারতবর্ষে গৌতম বুদ্ধের এই কাহিনী বহু প্রাচীনকাল থেকেই প্রচলিত।
গৌতম বুদ্ধের আদর্শের প্রভাব দীর্ঘ সময় পর্যন্ত ভারতবর্ষে স্থায়ী হয়েছিলো এবং মৌর্য সম্রাট অশোক নিজ উদ্যোগে পৃথিবীর নানা জায়গায় দূত পাঠিয়েছিলেন এই বৌদ্ধ ধর্মের আদর্শকে পুরো পৃথিবীতে ছড়িয়ে দেয়ার উদ্দেশ্যে। এটি যীশুখ্রিস্টেরও জন্মের প্রায় ৩০০ বছর আগের কথা। আর প্রাচীন ভারতবর্ষের সাথে বহিঃর্বিশ্বের বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক যোগাযোগের বহুলতার বিষয়ে তো নতুন করে আর বলবার কিছু নেই। ফলে দ্রুতগতিতে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে গৌতম বুদ্ধের গল্পগুলো এবং নানান ভাষায় অনুদিত হবার পর এক সময় নামগুলো পরিবর্তিত হয়ে ‘বারলাম’ ও ‘জোসেফাত’ বনে যায়।
যীশুর জন্মের দুই শতাব্দী আগের একজন ভদ্রলোক ফ্ল্যাভিয়াস জোসেফাস বলেছিলেন, বুদ্ধের এই কাহিনী পশ্চিমা দর্শন বা জুডাইক দর্শন বা জিউসের ধারণাকে প্রভাবিত করে। সে সময় যে এই কাহিনীগুলো প্রচলিত ছিলো, এই কথাই তার প্রমাণ। চতুর্থ শতাব্দীতে সেইন্ট জেরোমও দাবি করেছিলেন যে, তিনি গৌতম বুদ্ধের ব্যাপারে জানেন।
প্রায় ১৫০০ বছর আগে পার্সিয়ান রাজা প্রথম খসরুর কাছে যখন এই কাহিনীটি পৌঁছলো, তখন তিনি একে পহ্লব ভাষায় অনুবাদ করার আদেশ দিলেন, যার ফলে ‘বোধিসত্ত্ব’ হয়ে যায় ‘বুদ্দাসাফ’। এরপর আরবীতে অনুবাদ করা হলে এটি হয়ে যায় ‘ইউদ্দাসাফ’, জর্জিয়ান ভাষায় অনুবাদ করার পর হয় ‘আওদ্দাসাফ’, গ্রীক ভাষায় অনুবাদ করার পর হয় ‘আয়োসাফ’ এবং ল্যাটিনে অনুবাদ করার পর হয়ে যায় ‘জোসেফাত’। অন্য দিকে সিরীয় ভাষায় অনুবাদ হবার পর ‘বালাউভার’ হয়ে যায় ‘বারলাম’। এভাবেই এগারো শতাব্দীর মধ্যে ভারতবর্ষের বাইরে দুটো নতুন চরিত্রের জন্ম হয়, বারলাম ও জোসেফাত নামের দুটো চরিত্র। ভাবা যায়, খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের এতো গ্রহণযোগ্য একটি কাহিনী আসলে গৌতম বুদ্ধের কাহিনীরই পরিবর্তিত রূপ?
বারলাম ও জোসেফাতের গল্পের গ্রহণযোগ্যতার ওপর আঙুল তোলা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। কেননা, এটি মূলত গৌতম বুদ্ধের জীবনের গল্প হলেও এই বিকৃতি আসলে প্রাচীন ভারতবর্ষের সাথে বাইরের জগতের শক্তিশালী যোগসূত্রকেই বার বার প্রমাণ করে। তবে সঠিক ও সত্যিকার ইতিহাসকে আবিষ্কার করে পাঠকের সামনে তুলে ধরার এই প্রচেষ্টা চিরকালই অব্যাহত রাখতে চাই আমরা।