১৯১১ সালের ২১শে আগস্ট, সোমবার। আকাশে ভোরের আলো ফুটে উঠেছে। প্যারিসের বিখ্যাত ল্যুভর মিউজিয়ামের ভেতরে রাখা দেওয়াল আলমারি থেকে বেরিয়ে এলেন এক ব্যক্তি। সারারাত অপেক্ষা করছিলেন এই মাহেন্দ্রক্ষণটির জন্য। দেওয়াল থেকে ফ্রেমে আঁটা মোনালিসাকে নামালেন। তারপর ফ্রেম থেকে ছবিটি খুলে নিজের ওভারকোট দিয়ে মুড়ে বেরিয়ে গেলেন ল্যুভর থেকে। সকাল ন’টায় চিত্রশিল্পী লুইস বেরোদ ল্যুভর মিউজিয়ামে এলেন। মোনালিসা যেখানে রাখা ছিল সেখানে গিয়ে দেখলেন, কেবল মাত্র চারটি পেরেক আছে। মোনালিসা নেই!! সংবাদপত্রগুলির অফিসে দুপুরেই দুঃসংবাদটি পৌঁছে গেল।পরের দিন সকালে ফরাসি কাগজে লেখা হল-
‘অভাবনীয়: মোনালিসা কোথাও নেই!’
‘মোনালিসা’ হল তেলরঙে আঁকা ইতালীয় চিত্রশিল্পী লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির এক অমর সৃষ্টি। লিওনার্দো শেষ বয়সে, ফ্রান্সের রাজা প্রথম ফ্রান্সিস এর আমন্ত্রণে শিষ্য সাল্লি কে নিয়ে ফ্রান্সে আসেন। লিওনার্দোর মৃত্যুর পর ইতালি থেকে তার সঙ্গে আনা সব কিছুর মালিকানা পান সাল্লি। মাত্র চার হাজার সোনার মুদ্রার বিনিময়ে সাল্লির কাছ থেকে মোনালিসাকে সংগ্রহ করেন রাজা প্রথম ফ্রান্সিস। রাখেন ভার্সাইয়ের রাজপ্রাসাদে। এরপর নেপোলিয়ন মোনালিসাকে নিয়ে যান টুইলিরাইসে, নিজের শয়নকক্ষে। নেপোলিয়নের মৃত্যুর পর ছবিটি ল্যুভর মিউজিয়ামকে উপহার দেওয়া হয়।
ছবিটি ফ্রান্সের জাতীয় সম্পত্তিতে পরিণত হয়। শুধু জনপ্রিয়তার দিক থেকেই নয়, অর্থমূল্যের দিক থেকেও মোনালিসা পৃথিবীর সব চেয়ে দামী শিল্পকর্ম। নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রবন্ধে বলা হয়েছিল, ১৯০৬ সালে ছবিটির দাম ছিল ১৬২ কোটি ৯৫ লাখ ২৮ হাজার ৬২ ডলার। মোনালিসার দাম প্রতি মিনিটে বাড়ে বর্তমান মুল্যে ৬৭৩৫ টাকা ।এহেন ছবি চুরি যাওয়াতে তৎপর হয়ে ওঠে ফরাসি প্রশাসন – তদন্ত, তদন্ত। একসময় পুলিশের সন্দেহের তালিকায় উঠে আসে আরেক বিখ্যাত চিত্রশিল্পী পাবলো পিকাসোর নাম। সন্দেহ করা হয় বিখ্যাত কবি গিয়ম অ্যাপোলিনেয়ারকেও। আদালতে হাজির করা হয় এই দুই বিখ্যাত ব্যক্তিকে। অতঃপর অনেক জল ঘোলা হয়। শেষে প্রমাণিত হয় যে মোনালিসা চুরির সঙ্গে জড়িত নন এই দুজন। তারপর মোটামুটি সবাই যখন ধরে নেয় যে চিরকালের জন্য চুরি হয়ে গেছে মোনালিসা, ঠিক তখনই খোঁজ মেলে মোনালিসার। প্রায় দু বছর পর,১৯১৩ সালের নভেম্বর মাস।
জানা যায়, ভিনসেনজো পেরুগিয়া নামে ল্যুভরে একজন ইতালীয় কর্মচারী ছিলেন। তিনি কাজের শেষে জাদুঘরের ভেতর ঝাড়ু রাখার আলমারিতে লুকিয়ে পড়েছিলেন এবং পরদিন ভোরবেলা মোনালিসাকে তাঁর কোটের নিচে লুকিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। আদালতে হাজির করা হয় পেরুগিয়াকে। আদালতে তিনি বলেন, যেহেতু ভিঞ্চি ইতালীয় নাগরিক ছিলেন, তাই মোনালিসা ইতালির সম্পত্তি। ভিনসেনজোর স্বপ্ন ছিল, ইতালির সম্পত্তিকে ইতালিতে পাঠানো। তাই তিনি চুরি করেছিলেন এই চিত্রকর্ম। বিচারে এক বছরের জেল হয় ভিনসেনজোর। আর মোনালিসাকে ফিরিয়ে আনা হয় ফ্রান্সের ল্যুভরে, ১৯১৩ সালেই।কিন্তু শাস্তি পেলে কী হবে, ইতালিতে ঠিকই ‘জাতীয় বীর’ হিসেবে আখ্যা পান মোনালিসা চুরির নায়ক ভিনসেনজো পেরুগিয়া।
তথ্য সূত্র – 1)প্রবঞ্চক – নারায়ণ সান্যাল
2) ” The crimes of Paris” – by Hobler, Dorothy and Thomas