প্রত্যেক যুগে প্রত্যেক কালেই নারীর চলার পথটা ছিলো বন্ধুর, অমসৃণ। এমনকি আজকের এই আধুনিক যুগেও উন্নত থেকে উন্নততর বিশ্বেও নারীর ভূমিকাকে হালকা করে দেখা হয়। নারী কখনো গোঁড়া ধর্মান্ধতার শিকার, আবার কখনো তথাকথিত লৈঙ্গিক স্তরবিন্যাসের। কিন্তু আসলেই কি সৃষ্টির শুরু থেকেই ছিলো নারীর এমন অবস্থান? নাকি এটি শুধুই পুরুষতান্ত্রিকতার একটি দুর্ভেদ্য আবরণমাত্র? চলুন এই প্রশ্নের উত্তরের খোঁজে বেরিয়ে পড়ি।
লিখিত রীতি প্রবর্তনের আগের পৃথিবী কেমন ছিলো তা নিয়ে ছোটবেলা থেকেই জল্পনা-কল্পনার শেষ নেই জিমের। এটা ছাড়াও আরেকটি বিষয়ে তার প্রবল আগ্রহ। আর তা হলো মানুষের কঙ্কাল। অবাক হয়ে জিম ভাবতো, কি আছে এই রক্ত-মাংসের আড়ালের অবয়বটিতে। প্রবল আগ্রহ ও অদম্য মেধা অবশেষে তাকে এনে দিলো স্বপ্নের দ্বারপ্রান্তে। ছোট্ট জিম থেকে সে হয়ে উঠলো যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনা স্টেট মিউজিয়ামের গবেষক জেমস ওয়াটসন। পেয়ে গেলো তার স্বপ্নের গবেষণাও, প্রাগৈতিহাসিক যুগের মানুষের কঙ্কাল নিয়ে গবেষণা।
প্রায় ৬০ বছর আগে প্রফেসর রান্ডাল হাস তার দলকে সাথে নিয়ে পেরুর আন্দিজ পর্বতে এক শিকারী দলের দেহাবশেষ খুঁজে পান। প্রত্যেক দেহাবশেষের সাথে থাকা অস্ত্রগুলোই প্রমাণ করে যে, তারা একটি শিকারী গোষ্ঠী ছিলো। চিরাচরিত ধ্যান-ধারণার বশবর্তী হয়ে সেই শিকারী গোষ্ঠীর প্রত্যেককে রান্ডাল হাস ও তার দল বিনা প্রশ্নে পুরুষ দেহাবশেষ হিসেবে বিবেচনা করে এবং পেরুর এই গোষ্ঠীকে তারা ‘বিগম্যান’ নামকরণ করে। দেহাবশেষগুলোর সাথে থাকা অস্ত্রগুলোর প্রত্যেকটিই ছিলো পাথরের তৈরী। এ থেকে ধারণা করা হয়, এগুলো প্রস্তর যুগের দেহাবশেষ। অর্থাৎ, প্রায় ৯০০০ বছর আগের শিকারী গোষ্ঠীকে খুঁড়ে বের করেছে রান্ডাল হাসের দল। আর এরই মাধ্যমে লিখন পদ্ধতি প্রবর্তনের আগের পৃথিবীর কঙ্কাল নিয়ে গবেষণা করার সুযোগ হলো জেমস ওয়াটসনের।
জেমস ওয়াটসনের গবেষণায় মিললো যুগান্তকারী আবিষ্কার। সেই দেহাবশেষগুলোর একটির দাঁতের প্রোটিন পরীক্ষা করে ওয়াটসন নিশ্চিত হয়েছেন যে দেহাবশেষটি একজন নারীর। এ যেনো তার কাছে এক অবাক করা বিষয়। কেননা প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী, প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই পুরুষকে ‘হান্টার’ বা শিকারী এবং নারীকে ‘গ্যাদারার’ বা জমায়েতকারী বলেই জানা যায়। আর এ কারণেই কেউ ঘুণাক্ষরেও এ কথা ভাবে নি যে শিকারী দলের কবরে কোনো নারী থাকতে পারে। এরপর সবগুলো দেহাবশেষ পরীক্ষা করে দেখলেন অ্যারিজোনা ও ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটির গবেষকরা এবং সবাইকে অবাক করে দিয়ে গবেষকরা ঘোষণা দিলেন যে, একটি নয়, মোট ১০টি দেহাবশেষ নারীর, বাকি ১৬ টি পুরুষের। এই অভূতপূর্ব আবিষ্কারের পর ১০৭ টি সাইট থেকে পাওয়া ৪২৯টি দেহাবশেষ খতিয়ে দেখার সিদ্ধান্ত নেয়া হলো এবং এখন পর্যন্ত জানা লিঙ্গগুলোর মধ্যে ১০টি সাইট থেকে ১১জন নারীর দেহাবশেষ ও ১৫টি সাইট থেকে ১৬জন পুরুষের দেহাবশেষ পাওয়া যায়।
এবার তাহলে নিশ্চিতভাবেই এটা বলা যায় যে, নারীদের সম্পর্কে চিরাচরিত ধ্যান-ধারণা থেকে বের হবার সময় চলে এসেছে; যে নারীরা সেই প্রাগৈতিহাসিক যুগ, প্রস্তর যুগ থেকেই পুরুষের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পারদর্শী হাতে পাথরের তৈরী ধারালো অস্ত্রের চালনায় বুনো পশু শিকারে ছিলো সিদ্ধহস্ত; যে নারীরা পুরুষের তুলনায় কোনো অংশে কম সাহস ও শক্তির অধিকারী ছিলো না। কিন্তু তবুও এ বিষয়ে সন্দেহ ও প্রশ্ন জেগেছে এবং বিপরীত মতও দিয়েছেন অনেক গবেষকরা। অনেকে অবশ্য একটি তৃতীয় শ্রেণীস্তরের কথাও বলেছেন, বলেছেন হয়তো সন্তানাদি দেখাশোনার জন্য তখনকার সমাজব্যবস্থায় আরেকটি শ্রেণী ছিলো। তবে অনেকে এ-ও বলেছেন যে, কিছু বিশেষ নারীদের সম্মান জানানোর উদ্দেশ্যে তাদের মৃতদেহ অস্ত্রসহ দাফন করা হতে পারে, যদিও এই মতের পক্ষে তেমন জোরালো যুক্তি কেউ দিতে পারে নি।
এই বিরূপ মতভেদ কি তাহলে শুধু নারীর ‘নারী’ হওয়ার জন্যই? নাকি একজন নারীকে দুরন্ত দক্ষতাসম্পন্ন ও শিকারী হিসেবে মেনে নিতে না পারার জন্য? অথচ শিকারী গোষ্ঠীর দেহাবশেষ প্রথমবার যখন মিললো, তখন তাদেরকে ‘পুরুষ’ বিবেচনা করতে তো কোনো আপত্তি দেখা যায় নি, কাউকে প্রশ্ন তুলতেও তখন দেখা যায় নি। কিন্তু আসলে তো সৃষ্টির শুরু থেকে নারী ও পুরুষের ভূমিকায় কোনো পার্থক্য ছিলো না। তবে কি অসভ্য সমাজেই ছিলো নারীর মর্যাদা? কালের বিবর্তনে মানুষ যতো সভ্য হয়েছে, ততোই হয়তো আড়াল করেছে ‘নারী’ নামধারী বিশেষ ব্যক্তিদেরকে, যাদের রয়েছে সন্তান জন্মদানের ক্ষমতা। হয়তো এই ক্ষমতার প্রয়োজনেই বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে নারীকে, নাহয় হয়তো ‘নারী’ হতো কোনো বিলুপ্ত প্রাণীর নাম।
হান্টিং পর্যায়ের পর যখন শিকারের প্রয়োজন মিটে গেলো, মাছ-মাংস ও অন্যান্য খাদ্যদ্রব্য যখন সহজলভ্য হলো; তখন থেকেই পিতৃতন্ত্রের বুনটের মধ্যে ঢুকতে একপ্রকার বাধ্য করা হলো নারীদেরকে। ‘একঘরে’ করে দেয়া হলো তাদের, সীমাবদ্ধ করে রাখা হলো তাদেরকে সন্তান লালন-পালন ও গৃহস্থালির কাজকর্মের মধ্যে। আর এরই পরিণতি আজকের চরম পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা।
নৃতত্ত্ববিদদের তথ্য অনুযায়ী, বন্য ও বর্বর যুগের নারীরা শারীরিক ও মানসিক শক্তিতে পুরুষের সমতুল্য ছিলো। আধুনিক শরীরতত্ত্ববিদরা বলেন, নারী ও পুরুষের মগজের মাপ একই, সুতরাং নারীর জ্ঞানার্জনের দক্ষতা পুরুষের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়।
‘ভলগা থেকে গঙ্গা’ বইটি থেকে জানা যায় যে, সভ্যতম সভ্যতার সৃষ্টি হয়েছে নারীর দাসত্বের মধ্য দিয়ে। রাশিয়ার ভলগা নদীর তীরে যখন সভ্যতার সূচনা হয়েছিল, তখন পর্যন্ত মানব সভ্যতা ছিল নারী কেন্দ্রিক; প্রতিটি গোত্র একজন গোত্রপ্রধান দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতো এবং এই গোত্র প্রধান হতেন নারী। নারীরা শিকারসহ যাবতীয় সাংসারিক কাজে নেতৃত্ব দিতো।
শরৎচন্দ্রের একটি কথাতেই পুরুষতন্ত্রের আড়ালে নারীর অবস্থা সম্পর্কে ধারণা করা যায়, “পুরুষেরা যাহা ইচ্ছা করে, যাহা ধর্ম বলিয়া প্রচার করে, নারী তাহাই বিশ্বাস করে এবং পুরুষের ইচ্ছাকে নিজেদের ইচ্ছা বলিয়া ভুল করে এবং ভুল করিয়া সুখী হয়”।