অজানা এক ইংরেজ সৈন্যের ক্যামেরায় ১৯৪২ সালে তোলা পীর ইয়েমেনির সমাধি সৌধর আলোকচিত্র, সাথে ২০১৩ সালে ধারন করা গুগল স্ট্রিট চিত্র।

পূর্বকথাঃ সময়টা ১৩০৩ খ্রিস্টাব্দ। দিল্লীর নিজাম উদ্দিন আউলিয়া (রঃ) এর সাথে সাক্ষাত শেষে শ্রীহট্ট (বর্তমান সিলেট) এর উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়েছেন হজরত শাহজালাল (রঃ)। দিল্লী থেকে বিদায়কালে শুভেচ্ছার নিদর্শন হিসেবে নিজামুদ্দিন আউলিয়া তাঁকে উপহার দিয়েছেন এক জোড়া সুরমা রঙের কবুতর। সুদূর মক্কা থেকে মামার দেয়া এক মুঠো মাটি হাতে ভারতবর্ষের উদ্দেশ্যে শুরু হয়েছিল শাহজালাল (রঃ) এর সেই যাত্রা। মামা সৈয়দ আহমদ কবিরের নির্দেশ ছিল, ভারতবর্ষের যেখানে মাটির গন্ধ, বর্ণ তাঁর দেয়া মাটির সাথে মিলে যাবে, শাহজালাল (রঃ) যেনো সেখানেই বসতি স্থাপন করে ইসলাম প্রচার করেন। যাত্রাপথে সমরখন্দ, বাগদাদ, পাঞ্জাব, গুজরাট এমন নানা অঞ্চল থেকে তাঁর সাথে যুক্ত হয়েছেন অনেক আউলিয়া। এভাবেই একসময় তিনি পৌঁছে যান দিল্লী। নিজামউদ্দীন আউলিয়ার দরবারেই পরিচয় হয় আরো একজন সাধকের সাথে। তাঁর নাম শেখ মালিক; এসেছেন ইয়েমেন থেকে। সদ্য পরিচয় হওয়া শেখ মালিকও শাহজালাল (রঃ) এর সাথে চললেন শ্রীহট্ট, অত্যাচারী রাজা গৌড় গোবিন্দকে পরাজিত করবার জন্যে । গৌড়ের সুলতান শামসুদ্দিন ফিরোজ শাহ এর সিপাহসালার সৈয়দ নাসিরউদ্দিন এর সেনাবাহিনীর সাথে যোগ দিলেন হজরত শাহজালাল (রঃ) এর নেতৃত্বে ৩৬০ জন আউলিয়া। শ্রীহট্ট জয় হল। সেখানের মাটি মিলে গেলো মামার দেয়া নমুনার সাথে, সেখানেই এক টিলার উপর বসতি স্থাপন করলেন হজরত শাহজালাল (রঃ)। জয়ের পর তিনি তাঁর সঙ্গী শিষ্যদের বিভিন্ন অঞ্চলে ইসলাম প্রচারের জন্য পাঠিয়ে দিলেন। হজরত শেখ মালিক তাঁর শিষ্য শাহ বলখীকে নিয়ে বর্তমান সচিবালয়ের কাছের এক স্থানে একটি খানকাহ স্থাপন করলেন। আদি নিবাস ইয়েমেন হওয়ায় স্থানীয় ঢাকাবাসীর কাছে তিনি পরিচিত হলেন পীর ইয়েমেনি নামে।

মৃত্যুর দীর্ঘ কয়েক শতবছর পার হলেও বিংশ শতাব্দীর আগে পর্যন্ত পীর ইয়েমেনির সমাধির উপর কোনো সৌধ তৈরি হয়নি। তবে সুলতানি আমলের এই সাধকের সমাধি দেয়ালের মত ঘিরে রেখেছিল বট-পিপুল গাছের কাণ্ড আর অসংখ্য শিকড়। ১৮৮০এর দশকে ফুলবাড়িয়ায় রেল স্টেশন নির্মানের প্রয়োজনে এলাকাটিকে পরিষ্কার করা হয় এবং আসামের এক নও মুসলিম এখানে নিজ বসতি তৈরি করে সমাধির দেখাশোনা শুরু করেন। এসময়েই ঢাকার নওয়াব খাজা আহসানুল্লাহ এই মাজারটি সংস্কারে এগিয়ে আসেন এবং মাজারের পাশে একটি মসজিদ নির্মানে করে দেন। পিতার পথ ধরেই পরবর্তীকালে ১৯০৯ সালে নওয়াব খাজা সলীমুল্লাহ নিজ অর্থায়নে বর্তমানে দৃশ্যমান সমাধি সৌধটি নির্মান করে দেন। এর নির্মানকাজ তদারক করেন জনাব কাজী রফিকউদ্দিন। অষ্টকোণাকৃতির কিছু সমাধিসৌধ দিল্লী ও উত্তর ভারতে দেখা গেলেও এই অঞ্চলে এমন উদাহরন বিরল। এর সাথে যোগ হয়েছে ঢাকার অনবদ্য চিনি-টিকরির কাজ যা এই সৌধটিকে করেছে দৃষ্টিনন্দন।

সহায়ক গ্রন্থঃ ১- মুসলিম বাংলার অপ্রকাশিত ইতিহাস ঢাকার নওয়াব পরিবারের অবদান- ড: মোঃ আলমগীর, খোশরোজ কিতাব মহল, ২০১৪ 

২- Glimpses of Old Dhaka- Syed Muhammed Taifoor, 1956.

৩- “Pir Yemeni”- Bhuiya, Mossarraf Hussain, Banglapedia: the National Encyclopedia of Bangladesh (Online ed.). Dhaka, Bangladesh: Banglapedia Trust, Asiatic Society of Bangladesh, 2012.