বেহিশতুন শিলালিপি, প্রাচীন পারস্যের এক অত্যন্ত রাজকীয় নিদর্শন। সম্রাট ডেরিয়াসই এই শিলালেখ গড়েছিলেন। এখানে দেখা যায়, উপরে জরাথ্রুস্টবাদের ঈশ্বর আহুরা মাজদার আশীর্বাদের প্রতিচ্ছবি এবং সম্রাট ডেরিয়াস ‘গওমাতা’ নামের এক ভয়ংকর জাদুকরের বুকে পা দিয়ে দাঁড়িয়ে পেছন দিকে হাত-বাঁধা ও গলায় দড়িযুক্ত গওমাতার অনুসারীদেরকে শাসাচ্ছেন। যদি বলি, এই ‘গওমাতা’, যাকে ডেরিয়াস একজন দুর্ধর্ষ জাদুকর বলে আখ্যায়িত করেছেন, তিনি আর কেউ নন, স্বয়ং গৌতম বুদ্ধ; তবে আপনি কি বিশ্বাস করবেন?
এমন অদ্ভূত দাবীর ওপর বিশ্বাস না হবারই কথা, কিন্তু ভান্দরকার ওরিয়েন্টাল রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ইতিহাস গবেষক ড. রণজিৎ পাল যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করেছেন এই তত্ত্ব। তিনি জানিয়েছেন, নেপাল কোনোভাবেই বুদ্ধের জন্মস্থান হতে পারে না, যার স্বপক্ষে যথেষ্ট দলিল রয়েছে।
আমরা সবাই-ই কম-বেশি অ্যালয়িস অ্যান্টন ফুহরারের নাম শুনেছি, যিনি মূলত একজন জার্মান ভারততত্ত্ববিদ। ফুহরার সবচেয়ে বেশি পরিচিত বুদ্ধের জন্মস্থানের আবিষ্কারক হিসেবে। তিনিই প্রমাণ করেছিলেন যে, নেপালের লুম্বিনিই কপিলাবস্তু, অর্থাৎ গৌতম বুদ্ধের জন্মস্থান। তবে এই পরিচয়ের বাইরে ফুহরার আরও কিছু কার্যকলাপের জন্য পরিচিত –জাল প্রত্নসামগ্রীর ডিলার হিসেবে। ব্যাপারটি খুবই অপমানজনক এবং তার এই পরিচিতি প্রকাশিত হলে স্থায়ীভাবে তার ক্যারিয়ার ধ্বংস হয়ে যায়। মূলত অ্যালয়িস অ্যান্টন ফুহরার একজন প্রতারক এবং তিনি নিজের লাভের জন্য স্বার্থবাদী ব্রিটিশদের সাথে মিলে কিছু মিথ্যা ঘটনাকে ইতিহাসে প্রতিষ্ঠিত করার কাজে নিয়োজিত ছিলেন।
বাংলায় এশিয়াটিক সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা ব্রিটিশ ভারতত্ত্ববিদ উইলিয়াম জোনসের ভারততত্ত্ব বহু দিন ধরেই ভারতবর্ষ তথা ইংল্যান্ডের পাঠ্য-পরিক্রমার আদর্শ বলে বিবেচিত ছিলো এবং তিনিই বলেছিলেন যে, বৌদ্ধ শাস্ত্রের ‘পালিবোথ্রা’ জায়গাটি মূলত বিহারের পাটনায় অবস্থিত। তার এই তত্ত্ব প্রথম থেকেই প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছিলো। জোনসের প্রতিষ্ঠিত ভারততত্ত্বে কোনো অঙ্গুলি প্রদর্শিত হোক, তা ব্রিটিশদের কাছে কোনোভাবেই কাম্য নয়। আর এ জন্যই জোনসের তত্ত্বকে সত্য প্রমাণ করার উদ্দেশ্যে নেপালের লুম্বিনিকে বুদ্ধের জন্মস্থান, অর্থাৎ সিস্তান বা শকস্থান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবার ক্ষেত্রে ফুহরারকে কাজে লাগানো হয় বলে মনে করেন রণজিৎ পাল।
এখানে একটি বিষয় লক্ষণীয়, নেপাল বা বর্তমান ভারতের কোনো জায়গায়ই কিন্তু সিথিয়ান বা শক জাতিগোষ্ঠীর আদি চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায় নি। শকদের আবাস ছিলো প্রাচীন পারস্য ও সিন্ধু উপত্যকা। আর বর্তমানে এদের বংশধররা পাকিস্তানের বেলুচিস্তান ও ওয়াজিরিস্তানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে অবস্থান করছে। আর প্রাচীন ভারতবর্ষ মানেই সিন্ধু উপত্যকা, যার ‘সিন্ধু’ নামটি থেকেই ‘ইন্ডিয়া’ নামের উৎপত্তি। প্রাচীন ভারতবর্ষের মূল কেন্দ্র ছিলো উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত আফগানিস্তান ও দক্ষিণ-পূর্ব ইরান। এ ছাড়া ‘স্তান’-যুক্ত জায়গাগুলোর নামও কিন্তু পারস্য থেকেই এসেছে। উইলিয়াম জোনসের সবচেয়ে বড় ভুল ছিলো প্রাচীন ভারতবর্ষের অবস্থান নির্ণয়ে ভুল। তার চেয়েও বড় বিষয় হলো, জোনসের ভারততত্ত্বে গ্রীক বীর আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের ভারতবর্ষ অভিযানের কোনো উল্লেখ নেই।
রণজিৎ পালের মতে, আকেমেনিড সাম্রাজ্যের রাজধানী পার্সেপোলিসে অবস্থিত বাট্রাপোলিস (গ্রীক ভাষায়) বা বাত্রাকান্তা এলাকাটিই আসলে পালিবোথ্রা। পারস্যই তখন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সাম্রাজ্য এবং আফগানিস্তানও ছিলো এই পারস্যেরই অংশ। ঋগ্বেদ তো প্রথম বার আফগানিস্তানেই রচিত হয়েছিলো।
প্রাচীন সেই সময়টাতে সিল্ক রোড বৌদ্ধ ধর্মের প্রচারে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলো। আর সিল্ক রোডের এই অংশটি ছিলো আফগানিস্তানের মেস আইনাক এলাকা। তা ছাড়াও মেস আইনাক, গান্ধার, বামিয়ান এবং হাদায় সবচেয়ে বেশি বৌদ্ধ নিদর্শন মিলেছে। প্রথম শতাব্দীতে গান্ধারে আবিষ্কার হওয়া বৌদ্ধ শাস্ত্রের বইগুলোও পূর্ব আফগান খরোষ্ঠী লিপিতে লেখা। আবার বৌদ্ধ শাস্ত্রের প্রধান ভাষাই হচ্ছে পালি, যার সাথে নেপালি ভাষার কোনো সম্পর্ক নেই। এই সবগুলো বিষয়বস্তুই বার বার ইঙ্গিত দেয় যে, বৌদ্ধ ধর্ম আফগানিস্তান ও উত্তর-পশ্চিম ভারতবর্ষ থেকে প্রচারিত হয়েছে।
খ্রিস্টান ধর্মে ‘ম্যাজাই’ শব্দটির ব্যবহার সম্পর্কে আমরা সবাই-ই জানি। শিশু যীশুখ্রিস্টকে দেখার জন্য তিন জন ম্যাজাই এর আগমনের গল্পটি সবার মুখে মুখে প্রচলিত। এই ‘ম্যাজাই’ শব্দটি কিন্তু এসেছে ‘মাজুস’ থেকে, যার অর্থ ‘জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তি’। পারস্যের প্রাচীন দলিলগুলোতে গৌতম বুদ্ধকে এই ‘মাজুস’ বিশেষণে বিশেষায়িত করা হয়েছে। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে, প্রাচীন পারস্যে বুদ্ধকে একজন জ্ঞানী ও মর্যাদাবান ব্যক্তি মানা হতো।
এবার আসা যাক বেহিশতুন শিলালিপি প্রসঙ্গে। একটু লক্ষ করলেই দেখা যায়, বেহিশতুন শিলালিপিতে ডেরিয়াসের বন্দিকৃত ব্যক্তিদের মাঝে সবার শেষে দাঁড়ানো ব্যক্তির মাথায় সিস্তানি টুপি। ডেরিয়াসের পায়ের তলায় পড়ে থাকা যে ব্যক্তিকে গওমাতা বলে অভিহিত করা হয়েছে, তার সত্যিকার পরিচয় নিয়ে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন মতবাদ প্রচলিত হয়েছে।
সম্রাট সাইরাস দ্য গ্রেটের ছেলে দ্বিতীয় ক্যাম্বাইসেস খ্রিস্টপূর্ব ৫২২ সালে রহস্যজনকভাবে মারা যান। তার মৃত্যু নিয়ে হরেক রকম ধারণা প্রচলিত আছে। অনেকেই মনে করেন তার ভাই বার্দিয়া তাকে হত্যা করে পারস্যের সিংহাসনে আসীন হয়েছিলেন। কিন্তু ক্যাম্বাইসেসের দুঃসম্পর্কের চাচাতো ভাই ডেরিয়াস আবার দাবী করেন যে, জাদুকর গওমাতা সে সময় অবৈধভাবে পারস্যের সিংহাসন দখল করেন এবং অল্প কিছু সময়ের জন্য পারস্যের শাসকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। ডেরিয়াস প্রচার করেন যে, তিনি গওমাতাকে হত্যা করে পারস্যের সিংহাসন পুনঃরুদ্ধার করেন।
রণজিৎ পালের মতে, ডেরিয়াসের এই গল্পটি বানোয়াট। তিনি মনে করেন, পারস্যে নিজের ক্ষমতা দখলকে বৈধতা প্রদানের জন্য ডেরিয়াস এই গল্পটি প্রচার করেন। আসলে গওমাতাকে তিনি হত্যা করেন নি, গওমাতা পূর্ব দিকে প্রস্থান করেছিলেন ডেরিয়াসের ক্ষমতা লাভের পর। অনেকের মতে, ডেরিয়াস আসলে ক্যাম্বাইসেসের ভাই বার্দিয়াকে হত্যা করেছিলেন এবং এই হত্যাকান্ডকেই গওমাতার হত্যাকান্ড বলে চালিয়ে দিয়েছিলেন। অবশ্য এ নিয়ে বহুমত রয়েছে। অনেকে এ-ও মনে করেন, বার্দিয়া আর গওমাতা একই ব্যক্তি।
রণজিৎ পাল বলেছেন, জরাথ্রুস্ট ও গৌতম বুদ্ধ সমসাময়িক ব্যক্তিত্ব এবং পারস্যের বিভিন্ন দলিলে প্রাদেশিক শাসক হিসেবে যে ‘শুদ্দ-যুদ্দ-শরমন’ এর নাম পাওয়া গিয়েছে, তিনি মূলত গৌতম বুদ্ধের বাবা শুদ্ধোদন। পারস্যেই গৌতম বুদ্ধের জন্ম। একজন ম্যাজাই বা জ্ঞানী ব্যক্তিত্ব হিসেবে গৌতম বুদ্ধের আবির্ভাব সে সময় প্রভাবশালী জরাথ্রুস্টবাদ ধর্ম প্রচার করা জরাথ্রুস্টের ইমেজে আঘাত হানে বলে মনে করেন রণজিৎ পাল। আর তখন থেকেই জরাথ্রুস্টবাদের বিরুদ্ধ-ধর্মে পরিণত হয় বুদ্ধের প্রচারিত ধর্ম। সেই হিসেবে জরাথ্রুস্টবাদের অনুসারী ডেরিয়াসের কাছে গৌতম বুদ্ধই ছিলেন প্রধান শত্রু ও প্রতিযোগী। তাই রণজিৎ পাল মনে করেন, ‘গওমাতা’ নামে পরিচিত রহস্যময় ব্যক্তিই আসলে গৌতম বুদ্ধ। তিনি আরও সন্দেহ করেন, বৌদ্ধ শাস্ত্রে উল্লেখিত ‘দেবদত্ত’ নামের যে ব্যক্তি বুদ্ধকে হত্যার ষড়যন্ত্র করেছিলেন, তিনি আসলে ডেরিয়াস ও জরাথ্রুস্টের মিশ্রিত চরিত্রে সৃষ্ট এক ব্যক্তিত্ব।
গৌতম বুদ্ধ সম্পর্কে রণজিৎ পালের এই তত্ত্ব সত্যও হতে পারে, কিংবা অনুমানের ভিত্তিতে গড়া কোনো কাহিনীও হতে পারে। কিন্তু তার যুক্তিগুলো নিশ্চিতভাবেই আমাদেরকে ভাবায়, আসলেই কি গৌতম বুদ্ধ নিজের আবাসস্থল ত্যাগ করে বনবাসে গিয়ে ধ্যানমগ্ন হয়ে সন্ন্যাসী হয়েছিলেন, নাকি পরিস্থিতির প্রেষণায় বাস্তবতাকে বুঝতে পেরে নিজ ভূমি থেকে বিতাড়িত হয়ে শান্তির পথে সন্ন্যাস-জীবন বেছে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন?
রেফারেন্স:
- পাঠকের নোট: গৌতম বুদ্ধের জন্ম আফগানিস্তান; ছিলেন পারস্যেরও রাজা
- Origin of Buddhism Dhaka Workshop 28th July 2022
- Ranajit Pal
- The False Smerdis: A Detective Story of Ancient Times: The Reconstruction by Ilya Gershevitch
- Bardiya
- Behistun Inscription
- Gaumata and Smerdis in the Dipankara Jataka and the Date of the Buddha
- Alois Anton Führer