তেইশ জুলাই, ১৮৯৭। আলমোড়া থেকে মিস নোব্‌লকে লিখছেন বিবেকানন্দ, ‘‘কাজ শুরু হয়ে গেছে এবং বর্তমানে দুর্ভিক্ষনিবারণই আমাদের কাছে প্রধান কর্তব্য। কয়েকটি কেন্দ্র খোলা হয়েছে এবং কাজ চলছে, দুর্ভিক্ষ-সেবা, প্রচার এবং সামান্য শিক্ষাদান।… তুমি এখানে না এসে ইংল্যান্ডে থেকেই আমাদের জন্য বেশি কাজ করতে পারবে।’’ ২৯শে জুলাইয়ের চিঠিতে আরও খোলাখুলি লিখলেন স্বামীজি, ‘‘এ দেশের দুঃখ, কুসংস্কার, দাসত্ব প্রভৃতি কী ধরনের, তা তুমি ধারণা করতে পারো না। এ দেশে এলে অর্ধ-উলঙ্গ অসংখ্য নর-নারীতে পরিবেষ্টিত দেখতে পাবে। তাদের জাতি ও স্পর্শ সম্বন্ধে বিকট ধারণা… তা ছাড়া জলবায়ু অত্যন্ত গ্রীষ্মপ্রধান। … শহরের বাইরে কোথাও ইউরোপীয় সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য কিছুমাত্র পাবার উপায় নেই।’’

ভারতবর্ষীয় বাস্তবের কঠোর ছবি তুলে ধরেও অবশ্য মিস নোব্‌লকে ইংল্যান্ডে আটকে রাখা গেল না। তিনি এ দেশে এলেন। দৈনন্দিন জীবনযাত্রার নানা অসুবিধেও টের পেলেন। ৩১শে জানুয়ারি ১৮৯৮। এরিক হ্যামন্ডকে তাঁর ভারতবাসের অভিজ্ঞতার কথা লিখছেন মিস মার্গারেট নোব্‌ল। সে চিঠিতে মিশেছে চকিত কৌতুক। পার্ক স্ট্রিটের যে বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা হয়েছে সে বাড়ির স্নানঘরটিই আয়ারল্যান্ডের মেমসাহেবের কৌতুকের কারণ। স্নানঘরে জলের একটি কল আছে। সেখানে দাঁড়িয়ে টিনের মগে করে মাথায় জল ঢালতে হয়। এমন ধারা স্নানের অভিজ্ঞতা একেবারেই নতুন। কিছু দিন যেতে না যেতেই অবশ্য এই দেশের সব কিছুই বড় আপন বলে মনে হল। পাশ্চাত্যের জীবনযাত্রার ফেলে আসা অভ্যেস ভুলে এই দেশটিকেই কর্মসূত্রে নিজের করে নিলেন। মিস নোব্‌ল হয়ে উঠলেন ভগিনী নিবেদিতা। কিন্তু কী ভাবে? কোন মন্ত্রে?

১৬ নম্বর বোস পাড়া লেন, ভগিনী নিবেদিতার বাড়ি; Image source: Wikimedia

বিবেকানন্দ যে কথাগুলি লিখেছিলেন তা সর্বৈব সত্য। এক জন শিক্ষিত ইউরোপীয়ের কাছে এ দেশের দুর্দশা বিরক্তিকর, কষ্টদায়ক। নিজেকে প্রত্যাহার করে নেওয়ার পক্ষে বাইরের এই প্রতিকূলতাই যথেষ্ট। তবু নিবেদিতা এই প্রতিকূলতা অতিক্রম করতে পেরেছিলেন তাঁর অন্তর্দৃষ্টির সাহায্যে। অন্তর্দৃষ্টি বলতে কিন্তু অলৌকিক কিছু নয়। অন্তর্দৃষ্টি হল দেখার সেই চোখ যা অন্যের অবস্থানকে বুঝতে চায়, তাকে ‘অপর’ হিসেবে দূরে ঠেলে রাখতে চায় না। এই দৃষ্টি নিবেদিতা অর্জন করেছিলেন তাঁর ইতিহাসবোধ থেকেই। কোনও নতুন জনগোষ্ঠীর সঙ্গে অপরিচয়ের দূরত্ব মোচন করা যায় কী ভাবে? নিবেদিতা লিখছেন, ‘‘দ্য ফাউন্ডেশন-স্টোন অব আওয়ার নলেজ অব আ পিপল মাস্ট বি অ্যান আন্ডারস্ট্যান্ডিং অব দেয়ার রিজিয়ন।’’ ভারতবর্ষের মানুষদের বুঝতে গেলে সে দেশের আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য খেয়াল করতে হবে। এও বললেন যে, জানতে হবে সেখানকার মানুষদের শ্রমের প্রকৃতিটি ঠিক কী রকম।

১৮৯৯ সালে ক্যালিফোর্নিয়ার এক পিকনিকে সিস্টার নিবেদিতা, মিসেস সেভিয়ার, সিস্টার ক্রিস্টিনা।

নিবেদিতা তখনও এ দেশে আসেননি। বঙ্কিমচন্দ্র সাহেবি দৃষ্টি সম্বন্ধে ঠাট্টা করে লিখেছিলেন ‘‘বিলাতী বিদ্যার একটা লক্ষণ এই যে, তাঁহারা স্বদেশে যাহা দেখেন, মনে করেন বিদেশে ঠিক তাই আছে। তাঁহারা Moor ভিন্ন অগৌরবর্ণ কোন জাতি জানিতেন না, এ জন্য এ দেশে আসিয়া হিন্দুদিগকে Moor বলিতে লাগিলেন।’’ নিবেদিতা তো সাধারণ মেমসাহেব ছিলেন না, ভারতবর্ষকে চেনা ও চেনানোর সাধনায় ব্রতী হয়েছিলেন। নিজের দেশে যা আছে অপর দেশেও তাই থাকবে এবং তা না-থাকলে মন্দ বলতে হবে এই সঙ্কীর্ণ আধিপত্যকামী দৃষ্টির অধিকারী কেবল পাশ্চাত্যের মানুষেরাই ছিলেন না, ভারতীয়রাও ছিলেন। ভারতীয়রা সাহেবদের মতো ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন না বলে তাঁদের সঙ্কীর্ণতায় আধিপত্যবাদ ছিল না, তবে সাহেবমাত্রেই খারাপ এই বিশ্বাস দৃঢ়মূল ছিল। সাহেব-মেমসাহেবদের যে বাঙালি-বাড়ির ত্রিসীমানায় যেতে দিতে নেই সে সংস্কার ছিল ষোলো আনা। নিবেদিতাকে সংস্কারমুক্ত মা সারদা তাঁর বাড়িতে থাকতে দিয়েছিলেন। নিবেদিতা টের পেয়েছিলেন সারদা মায়ের পরিজনেরা এই উদার বাঙালিনীকে একঘরে করতে তৎপর। তিনি নিজেই অন্য বাড়িতে উঠে গেলেন।

সারদা দেবীর সাথে ভগিনী নিবেদিতা; Image source: Wikimedia

বিবেকানন্দ যে ধর্ম-আন্দোলনের প্রবক্তা, সেই ধর্ম আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য এই দুই ধারার মিলন। বিবেকানন্দ ‘প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য’ নামের যে ধারাবাহিক নিবন্ধটি ‘উদ্বোধন’ পত্রে লিখেছিলেন, তাতে এই দুই সংস্কৃতির মিলনের কথা ছিল। দুই পক্ষেরই অন্তর্দৃষ্টি প্রয়োজন— প্রাচ্যকেও চিনতে হবে পাশ্চাত্য সভ্যতার রীতি-নীতি, পাশ্চাত্যকেও বুঝতে হবে প্রাচ্যের গুরুত্ব। বিবেকানন্দের অনুগামী নিবেদিতার জীবন এই ব্রতেই স্থিতি লাভ করেছিল। ভারতবর্ষকে চেনাই ছিল তাঁর সাধনা, শুধু যে নিজে চিনছেন তা-ই নয়, তিনি ভারতবাসীদেরও তাঁদের দেশ ও সংস্কৃতি সম্বন্ধে সচেতন করে দিচ্ছেন। পরাধীন ভারতীয়দের আত্মবিশ্বাস নেই। নিবেদিতা তাঁদের হারিয়ে যাওয়া আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে দিতে তৎপর। অবনীন্দ্রনাথ, নন্দলাল এঁদের সঙ্গে নিবেদিতার সখ্য গভীর। নিবেদিতার উৎসাহেই ভারতশিল্পের পুনরুজ্জীবন ঘটল। ভারতীয় পুরাকথাকে, গুহাচিত্রের ঐশ্বর্যকে নিবেদিতার সাহচর্যে ভারতীয়রা পুনরাবিষ্কার করলেন। দীনেশচন্দ্র সেন বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস গ্রন্থ রচনা করছিলেন ইংরেজিতে। নিবেদিতা তাঁর ইংরেজি পরিমার্জনা করে দেন। বাংলা সাহিত্যের প্রাগাধুনিক উপাদান নিয়ে দীনেশচন্দ্রকে নানা প্রশ্ন করেন। এই প্রশ্নে দীনেশচন্দ্রের কাছে তাঁর নিজের দেশের সংস্কৃতি নতুন অর্থে উন্মোচিত হয়। নিবেদিতা লেখেন ‘Cradle Tales of Hinduism’। সে বইতে আছে সতীর কাহিনি। ভারত সম্বন্ধে দেখার গভীর দৃষ্টির অধিকারিণী ছিলেন নিবেদিতা। তাঁর প্রয়াণের পর যে সংবেদী প্রয়াণলেখ রচনা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ তাতে নিবেদিতাকে উপমিত করেছিলেন সতী হিসেবেই।

স্বামী বিবেকানন্দের সাথে

তা হলে কি এ দেশের অভাব নেই কিছুর? অন্তর্দৃষ্টিতে ভেতরের রূপ দেখেই মোহিত হয়ে থাকতে হবে? না, তা নয়। বিবেকানন্দ তাঁর পত্রে জানিয়েছিলেন নিবেদিতাকে সেবাকার্যের কথা, শিক্ষাব্রতের কথা, এ দেশের অভাবের কথা। নিবেদিতা এ দেশে এসে সে-দু’টি কাজই গ্রহণ করলেন, শিক্ষা আর সেবা এই দুই তাঁর ব্রত। সে কাজ করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হল কারণ অন্তর্দৃষ্টির অধিকারে তিনি এ দেশকে ভালবেসে ছিলেন। তাঁর ইস্কুলে যে পড়ুয়ারা আসে নিবেদিতা তাদের সম্বন্ধে নোট রাখেন। তাদের প্রবণতার ইচ্ছে-অনিচ্ছের খোঁজ নেওয়া চাই। তাঁর এ বাড়ির উঠোনে মাঝে মাঝে আসেন বাঙালি প্রতিবেশীরা। তাঁদের চেয়ারে বসতে দিয়ে মাটিতে বসে থাকেন নিবেদিতা। প্লেগ কলকাতায় মহামারির আকার নেয়। অক্লান্ত সেবায় আত্মনিয়োগ করেন তিনি। সাধারণ স্বাস্থ্যবিধি সম্বন্ধে দরিদ্র ভারতবাসীর অজ্ঞানতার শেষ নেই যেন। সেবাকার্যে দেশীয় যুবকদের সাহায্য নেন তিনি। বর্জ্যপদার্থ পরিষ্কার করেন যাঁরা, তাঁদের শারীরিক সামর্থ্য ও দেহসৌষ্ঠবে তিনি মুগ্ধ— এঁদের কিনা ভারতীয় সমাজের প্রান্তে ঠাঁই হয়! গোপালের মায়ের সেবা করেন একান্তে। গোপালের মা বালবিধবা, মা সারদার কাছে থাকেন। দু’জনে দু’জনের ভাষা বোঝেন না। তবু অন্তরের যোগ টের পাওয়া যায়। গোপালের মায়ের পায়ের কাছে বসে আস্তে আস্তে হাত বুলিয়ে দেন। এই বিধবার মধ্যে যেন খুঁজে পান নিজের ঠাকুমাকে। সারদা মায়ের বাড়িতে যান। সেখানে নিঃশব্দ বোঝাপড়ায় মেয়েরা ঠাকুরের পুজোর আয়োজন করছেন। তাঁদের এই সম্মিলিত পুজোর আয়োজনে কৌম সমাজের প্রাণ-স্পন্দন টের পান। এ ভাবেই প্রাত্যহিক ছোট ছোট কাজের মধ্যে এ দেশের সঙ্গে তাঁর আদান-প্রদান চলে। এই আদান-প্রদান চলে বলেই স্বামীজির প্রয়াণের পরেও এই দেশেই থেকে গেলেন তিনি। বিবেকানন্দ তাঁর পত্রে লিখেছিলেন নিবেদিতাকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। এ দেশকে নিজের মতো করে চিনেই নিবেদিতা স্বনির্ভর হয়ে উঠেছিলেন। ঔপনিবেশিক প্রশাসনের সীমার বাইরে যে দেশ, তাকে আবিষ্কার করতে পেরেছিলেন।

ক্রেডল টেলস ফ্রম হিন্দুইজম বইটির ১৯১৩ সংস্করণের প্রচ্ছদ; Image source: Wikimedia

কেউ গিরিবালা ঘোষকে চেনেন? কেউ জানেন পারুলের গল্প? গিরিবালা বছর বাইশ-তেইশের এক বিধবা, বালিকা কন্যাকে নিয়ে মামার বাড়ির আশ্রিতা। গিরিবালার খুব ইচ্ছে ‘নিবেদিতার স্কুল’-এ পড়ার। কিন্তু সে কী করে সম্ভব? মেমসাহেবের স্কুল— ম্লেচ্ছ সংসর্গ! গিরিবালার দিদিমা গঙ্গায় স্নান করতে যান রোজ, নিবেদিতার স্কুলের পাশ দিয়ে। এক দিন শুনতে পেলেন সমবেত ভাবে মেয়েরা স্তবগান করছে। বরফ একটু গলল। কিন্তু মেয়ে যাবে কী ভাবে? বাড়ি পর্যন্ত গাড়ি ঢোকে না যে! নিবেদিতার কানে গেল সে কথা। তিনি সোজা চলে গেলেন গিরিবালার মামার কাছে। তাঁকে বললেন, মেয়েরা গঙ্গাস্নানে তো যায়, কালীঘাটে তো যায়! তা-ই না-হয় মনে করুন তিনি। ১১টা থেকে ৪টে তাঁকে দিন মেয়েটিকে। বলতে বলতে হাঁটু ভেঙে পায়ের কাছে বসে পড়লেন তিনি। সন্ত্রস্ত, বিব্রত মামা তাড়াতাড়ি অন্তঃপুর থেকে ভাগনিকে নিয়ে এসে নিবেদিতার হাতে সমর্পণ করলেন।

মায়াবতী অদ্বৈত আশ্রম, সিস্টার নিবেদিতা, মিসেস সেভিয়ার, সিস্টার ক্রিস্টিনা, মিসেস অবলা বসু।

আর পারুল? শ্বশুরবাড়ি যেতে না চেয়ে পালিয়ে চলে এসেছিল নিবেদিতার কাছে। থেকে গিয়েছিল তাঁর সঙ্গে। তার নতুন নাম হল সরলা। এই সরলাই হয়ে উঠেছিলেন প্রব্রাজিকা ভারতীপ্রাণা মাতাজি— শ্রী সারদা মঠ ও মিশনের প্রথম অধ্যক্ষা। বিবেকানন্দের স্বপ্নের ‘স্ত্রী মঠ’ সার্থক হল এত দিনে।

নিবেদিতা প্রসঙ্গে এই দু’টি নাম কেন এল সে কথা বলি। নিবেদিতা বললেই ‘লোকমাতা’ রূপটি যত সহজে আসে, তাঁর শিক্ষয়িত্রী পরিচয় তত সহজে আসে না। অথচ তিনি ছিলেন স্বভাব-শিক্ষয়িত্রী। মার্গারেট এলিজাবেথ নোবল (নিবেদিতা) ছাত্রাবস্থা থেকেই শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন। বিদ্যালয়ের শিক্ষাশেষে যখন তিনি কেসউইকে স্কুলে যোগ দেন, তখন তাঁর বয়স মাত্র ১৭। ১৯ বছর বয়সে রেক্সহ্যাম শহরে নতুন স্কুলে পড়ানো শুরু করেন। সঙ্গে চার্চের কাজও করতেন। চার্চের সঙ্গে মতভেদ হওয়ায় তিন বছর পরে চেস্টারে নতুন স্কুলে যোগ দেন। পাশ্চাত্যে তখন শিশুশিক্ষা নিয়ে নতুন ভাবনার জোয়ার। এই নতুন শিক্ষানীতির মূল দর্শনই ছিল শিশুকেন্দ্রিকতা। শিশুর আগ্রহ, সামর্থ্য, চাহিদা, পছন্দকে প্রাধান্য দিয়ে শিক্ষাদান। শিক্ষাবিদ পেস্তালৎসি এবং দার্শনিক ফ্রেডরিক ফ্রোয়েবলের বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারা মার্গারেটকে বিশেষ ভাবে প্রভাবিত করেছিল। এই সময় তিনি উইম্বলডনে নতুন স্কুলে যোগ দেন। ১৮৯২ সালে নিজেই স্কুল খোলেন। শিক্ষিকা হিসেবে তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। শিক্ষা বিষয়ে তাঁর বক্তৃতা এবং প্রবন্ধগুলি বিশেষ গুরুত্ব পেতে থাকে।

বিবেকানন্দ যখন স্ত্রীশিক্ষা ও নারীকল্যাণের কাজে মার্গারেটকে ডাক দিলেন, তখন তাঁর কাছে ক্ষেত্রটা কাজের জন্য নতুন ছিল না। নতুন ছিল দেশ, মানুষজন, আর এক বৈদান্তিক সন্ন্যাসী। অসামান্য ধী-শক্তিসম্পন্ন এই নারী পরে বহু পাঠ ও ভ্রমণের মধ্য দিয়ে এই দেশকে নিজের মতো করে বুঝলেও, বিবেকানন্দের প্রভাব আমৃত্যু তাঁকে সঙ্গ দিয়েছে। ফলে মেয়েদের বিদ্যালয় যখন প্রতিষ্ঠা করলেন, সেটা উনিশ শতকীয় ঔপনিবেশিক শিক্ষাধারণার অনুবর্তী হল না। উল্টো দিকে খানিকটা জাতীয়তাবাদী চরিত্র তাতে দেখা গেল। এ জন্য তাঁকে কিছুটা সমালোচনা এবং অনেকটা উপেক্ষা সহ্য করতে হয়েছে। উনিশ শতকের শিক্ষা-ইতিহাসে ‘নিবেদিতার স্কুল’-কে খানিকটা ব্রাত্য করেই রাখা হয়েছে।

স্বামী বিবেকানন্দের নিজের হাতে রচিত একটি কবিতা “নিবেদিতার আশীর্বাদ” l

বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আগেই গুরুর দীক্ষায় মার্গারেট হয়েছেন ‘নিবেদিতা’। ভারতবর্ষের জন্য নিবেদিত হয়েছেন তিনি। ভারতের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করছেন তিনি। আর প্রখর বাস্তবজ্ঞানে বুঝে নিচ্ছেন কোন শিক্ষা প্রয়োজন উত্তর কলকাতার পল্লির মেয়েদের জন্য! কোথায় স্থাপন করেছিলেন স্কুল? কারা সেখানে পড়বে? দীর্ঘদিনের শিক্ষয়িত্রী বুঝেছিলেন— যেখানে বিদ্যালয়, সেইমতো ব্যবস্থা করাই যুক্তিসঙ্গত।

বাগবাজারের পল্লির গোঁড়ামিকে অস্বীকার করেননি নিবেদিতা। তাকে যথাযোগ্য সম্মান দিয়েই জ্ঞানের আলো জ্বালার চেষ্টা করলেন ঘরে ঘরে। কালীপুজোর সন্ধ্যায় শ্রীশ্রীমা উদ্বোধন করলেন বিদ্যালয়ের। ফিতে কেটে ইউরোপীয় কায়দায় দ্বারোদ্ঘাটন নয়, রীতিমতো পূজার্চনা হয়েছিল। প্রতি দিন ক্লাস শুরু হওয়ার আগে সমবেত স্তবগান হত। ভাগ্যিস! তাই তো গিরিবালারা স্কুলে যাওয়ার ছাড়পত্র পেলেন! শেখানোর প্রাথমিক উপায় তিনি নির্ধারণ করেছিলেন তাঁর উইম্বলডন স্কুলের অভিজ্ঞতা থেকে। ছবি আঁকা, মূর্তি গড়া, আলপনা দিয়ে মেয়েদের শিক্ষা শুরু হত। অর্থাৎ পুজো-অর্চনা-ব্রত পালনের অভ্যাস থেকেই মুক্তির উপায় খোঁজা শুরু হল। ক্রমশ পড়ানো হত বাংলা, ইংরেজি, অঙ্ক, প্রাথমিক বিজ্ঞান, ভূগোল, ইতিহাস। ভূগোল-ইতিহাসের ক্লাসে জড়িয়ে থাকত ‘স্বদেশ’, ভারতবর্ষ। প্রসঙ্গত উঠে আসত কাহিনি— রানি ভবানী, রানি লক্ষ্মীবাই। নিবেদিতাই কি তবে প্রথম মানবীবিদ্যা চর্চা শুরু করেছিলেন এ দেশে? বাইরের শিক্ষাকে অন্তঃপুরে ঢোকানোর চেষ্টা করেননি নিবেদিতা, যেমনটি উনিশ শতকে হচ্ছিল কোথাও কোথাও। নিবেদিতা অন্তঃপুরকে প্রসারিত করেছিলেন বাইরের দিকে।

তেঁতুলবিচি দিয়ে যোগ-বিয়োগ শিখত মেয়েরা, শিখত জোড়-বিজোড়ের অঙ্ক। মেয়েদের শরীরচর্চার দিকে তাঁর নজর ছিল প্রখর। স্কিপিং করানোর জন্য নিজের গাউনের দড়ি পর্যন্ত খুলে দিতেন। নিজে ব্যায়াম শেখাতেন। কেউ কুঁজো হয়ে বসলে ধরে সোজা করে দিতেন। সেই যুগে অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে রক্তের ফোঁটার মধ্যে জীবাণু চেনাতেন তিনি। আর একাদশীর দিন বিশেষ যত্ন নিতেন বিধবা ছাত্রীদের। মেয়েরা একাদশী পালন করত, সমবেত ভাবে স্তব পাঠ কর। নিবেদিতা চেয়েছিলেন তাঁর মেয়েরা গর্ববোধ করুক দেশের জন্য। স্বাধীন ভারতের জাতীয় পতাকার রূপ ভেবেছিলেন তিনি— লাল রেশমের কাপড়ের উপর সোনালি সুতো দিয়ে বজ্রচিহ্ন সেলাই করে দিয়েছিল স্কুলের মেয়েরা। ছাত্রীদের বক্তৃতা শুনতে নিয়ে যেতেন।

স্বামীজির মহাপ্রয়াণের পর বিদ্যালয়ের কাজে যোগ দিলেন তাঁর মার্কিন শিষ্যা সিস্টার ক্রিস্টিন। বয়সে বড় মেয়েদের নিয়ে গড়ে উঠল ‘বিবেকানন্দ পুরস্ত্রী বিভাগ’। এই মেয়েরা ঘরের কাজ সেরে দুপুরবেলায় আসতেন, মূলত শিখতেন কাটিং আর সেলাই। ভোকেশনাল ট্রেনিংয়ের সঙ্গে তাঁরা বাংলা ও ইংরেজিও শিখতেন। ১৮৮১ সালের জনগণনা শিহরন জাগানো তথ্য সরবরাহ করে। জানা যায় মেয়েদের প্রতি ১০০ জনে ২০ জনই বিধবা এবং তাঁদের বয়স ১-৬০ বছর। এর যে ভগ্নাংশই উত্তর কলকাতার এই পল্লিটিতে থাকুক না কেন,

কলকাতার বিবেকানন্দ সোসাইটিতে ভগিনী নিবেদিতার মূর্তি; Image source: Wikimedia

সে সংখ্যাও খুব কম নয়। বাঙালি হিন্দু বিধবা এবং দরিদ্র পুরস্ত্রীর যথাযথ বৃত্তি শিক্ষা কেন দরকার, নিবেদিতা বুঝেছিলেন। ভগিনী নিবেদিতাকে নিয়ে বহু আলোচনা হয়। তাঁর তেজস্বিতা, দেশাত্মবোধ, আধ্যাত্মিকতা। কিন্তু হারিয়ে যেতে থাকে তাঁর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিচয়— তিনি এক অসামান্য শিক্ষয়িত্রী। নিবেদিতা তাঁর প্রিয় শহর দার্জিলিঙে এসেছিলেন বেশ কয়েক বার। কখনও নিছক অবসর যাপন করতে ছুটে এসেছেন সমতল থেকে বহু দূরে এই দার্জিলিং পাহাড়ে, কখনও ‘কুইন অফ হিলস’-এর কোলটি হয়ে উঠেছিল তাঁর আরোগ্যের আশ্রয়স্থল। বিবেকানন্দের মানসকন্যা নিবেদিতা। দার্জিলিঙে বসে চোখের আয়নায় পাহাড়ি প্রকৃতির মুগ্ধতা নিয়ে কোনও উইলসনকে লিখে জানালেন, ‘আমি কখনও জানতাম না দার্জিলিং এত সুন্দর! ঠিক এখনই বসন্তের ফুলে ভর্তি।’ (আই নেভার নিউ দ্যাট দার্জিলিং ওয়াজ সো বিউটিফুল অফ অটাম ফ্লাওয়ার)।

দার্জিলিঙের বৈচিত্র্যময় পাহাড়ি প্রকৃতির মতোই তাঁর কাজের যে বহুমুখী প্রকাশ ছড়িয়ে আছে পাহাড়ি পথের বাঁকে বাঁকে, তাও তো অসামান্য বৈচিত্র্যে ভরপুর। দার্জিলিঙের দিনগুলিতে কর্মব্যস্ততার মধ্যে ডুবিয়ে রাখতেন নিজেকে। কখনও বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার জন্য দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশকে সঙ্গে নিয়ে বক্তৃতা দিচ্ছেন, কখনও বা জগদীশচন্দ্র বসুর গবেষণা গ্রন্থের প্রুফ সংশোধন করছেন। ছুটে যাচ্ছেন শৈল শহরে বস্তিবাসী শিশুদের কাছে, আবার কখনও বা আপন খেয়ালে ঘুরে বেড়াতেন আশপাশের পাহাড়ি গ্রামগুলিতে, প্রত্যক্ষ করেছেন গ্রামীণ জীবন। তাঁকে আকৃষ্ট করেছিল সেখানকার জনজাতির মানুষ। মিশেছিলেন নেপালি ভুটিয়া স্থানীয় অদিবাসীদের সঙ্গে। তাঁর অভিজ্ঞতা, ‘এরা সকলেই সাহসী, পরিশ্রমী আর ধর্মপ্রাণ।’

১৯৬৮ সালের স্ট্যাম্পে সিস্টার নিবেদিতা

১৮৯৮-র এপ্রিল মাস। বিবেকানন্দ তখন দার্জিলিঙে। মিস মুলারের সঙ্গে দার্জিলিং যাওয়ার কথা নিবেদিতারও। স্বামীজী হঠাৎ তাঁকে টেলিগ্রাম করে আসতে নিষেধ করলেন।

প্রথম বার দার্জিলিঙে যাওয়ার সুযোগ এল ১৯০৩ সালের মে মাসে। তাঁর ঠিকানা হল ঘুম স্টেশনের কাছে ‘অ্যাসাইলিন ভিলা’। কিছু দিন আগেই এখানে এসে পৌঁছেছেন সস্ত্রীক জগদীশচন্দ্র বসু। আছেন নিবেদিতার কিছু পরিচিত জন, বন্ধুরাও। তাঁদের সঙ্গে দেখা হবে না তাও কি হয়? সকলেই চলে আসতেন তাঁর বাড়িতে।

এ বারে এসে ছিলেন ৪৯ দিন। মাঝে এক দিন তাঁর বাড়িতে এসে উপস্থিত গোপালকৃষ্ণ গোখলে। তিনিও তখন দার্জিলিঙে। বড়দিনে স্কুল ছুটি থাকবে। সেই সময় ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের ১৯তম অধিবেশন বসবে মাদ্রাজে। নিবেদিতার কাছে জানতে চাইলেন ‘আপনি যাচ্ছেন তো?’ তাঁর কৌতূহলী জিজ্ঞাসা ‘আপনি কংগ্রেস থেকে দূরে সরে আছেন কেন?’ আশ্বস্ত করলেন নিবেদিতা। জানালেন, ‘কংগ্রেসে সক্রিয় যোগদান না করলেও বিশ্বাস করুন কংগ্রেস আমার চিন্তার বাইরে নয়।’ সে বছরই অগস্টের মাঝামাঝি বসু-দম্পতির সঙ্গে চলে এলেন দার্জিলিঙে। সেখানে জগদীশচন্দ্রের গবেষণাপত্র তৈরির কাজে বাড়িয়ে দিলেন সাহায্যের হাত। পাশাপাশি চলল নিজের দ্বিতীয় গ্রন্থ ‘ওয়েব অব ইন্ডিয়ান লাইফ’-এর পাণ্ডুলিপি প্রস্তুতির কাজও। এ বারে এসে দার্জিলিঙে বসেই শেষ করলেন বইটির ছ’টি অধ্যায়ের কাজ।

যে বাড়িটি নিবেদিতা থাকতেন

এ সবের ফাঁকেই চলে যেতেন বস্তিবাসীদের কাছে। সেখানে শিশুদের হাতে হাতে তুলে দিতেন খেলনা।

১৯০৫-র মার্চে হঠাৎই ‘ব্রেন ফিভার’-এ আক্রান্ত হলেন নিবেদিতা। দীর্ঘ এক মাসের জ্বরে শরীরের অবস্থা সঙ্গিন। কিছুটা সুস্থ হলে ডাক্তার নীলরতন সরকারের পরামর্শে জগদীশচন্দ্র হাওয়া বদল করতে মে মাসের প্রথম সপ্তাহে নিবেদিতাকে নিয়ে পাড়ি দিলেন দার্জিলিং। এ বারে তাঁদের সঙ্গী হলেন নিবেদিতার বোন ক্রিস্টিন। সেখানে বসু-দম্পতি আর ক্রিস্টিনের সেবাযত্নে ধীরে ধীরে সুস্থ হতে লাগলেন। নিবেদিতাকে মানসিক ভাবে প্রফুল্ল রাখার জন্য জগদীশচন্দ্র সব সময় তৎপর। একদিন দার্জিলিঙের বাজারে গিয়ে দেখলেন একজন একটি শেয়ালছানা নিয়ে এসেছে বিক্রির জন্য। জগদীশচন্দ্র চার আনা দিয়ে সেই শেয়ালছানাটিকে কিনে নিলেন। বাড়িতে ফিরে নিবেদিতাকে দিলেন।

নিবেদিতার কি আনন্দ এমন উপহার পেয়ে। তার নাম দিলেন ওয়াইল্ড হার্ট। তাকে নিয়েই সময় কাটাতেন, মেতে থাকতেন। শেয়ালছানাকে কেন্দ্র করে এ সব দেখে ঠাট্টার ছলে জগদীশচন্দ্র বললেন, ‘ওটার ওপর অত মনোযোগ দিলে তো মুশকিল। ও-ই দেখছি আমায় ফতুর করবে?’ একদিন সকালে নিবেদিতার গলায় অভিমানের সুর—‘কাজ করতে পারব এ বার।…আজ বিকেলে শেয়ালছানাটিকে জঙ্গলে ছেড়ে দিয়ে আসব।’

১৯০৫-এর ১৬ই অক্টোবর বঙ্গবিভাজন ঘোষিত হল। প্রতিবাদে কলকাতা-সহ সমগ্র দেশ উত্তাল। কলকাতার পথেঘাটে হিন্দু-মুসলিম সর্বস্তরে পালিত হল রাখিবন্ধন। নেতৃত্ব দিলেন রবীন্দ্রনাথ। নিবেদিতা তখন দার্জিলিঙে। সেখানেই ইংরেজ সরকারের বঙ্গভঙ্গের চক্রান্তের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলতে টাউন হলের জনসভায় বক্তৃতা মঞ্চে হাজির হলেন। সঙ্গে তাঁর দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ। সে দিনের সভায় বললেন, ‘ধিক আমার জন্মভূমিকে। বাংলার বুকে এই যে ভেদের প্রাচীর তুলে সে দেশকে অপমান করেছে, ভারতবাসীর শৌর্য আর আত্মত্যাগ যত দিন তাকে তা তুলে নিতে বাধ্য না করে, আমরা চালিয়ে যাবই এ সংগ্রাম।’

দার্জিলিঙে দেশবন্ধু ও নিবেদিতার সাক্ষাতের একটি চমকপ্রদ গল্প আছে।

দার্জিলিংয়ের রাস্তায় একদিন নিবেদিতার সঙ্গে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের দেখা হয়। নিবেদিতার হাতে ছিল একটি বড় লাল গোলাপ। তিনি হাসতে হাসতে সেই গোলাপটি দেশবন্ধুর কোটের বোতামে গুঁজে দিয়ে বললেন, ‘‘আমি আপনাকে মহৎ বলিয়াই জানিতাম, কিন্তু আপনি এত মহৎ জানিতাম না।’’

১৯০৯ সাল। অক্টোবরের মাঝামাঝি পূজাবকাশে চলে এলেন দার্জিলিং। সঙ্গী বসু পরিবার। পরের বছরও পুজোর ছুটি কাটাতে বেছে নিলেন দার্জিলিং পাহাড়কেই। এ যাত্রায় বেশি দিন থাকা সম্ভব হল না। টেলিগ্রাম এল, মিসেস বুল গুরুতর অসুস্থ। খবর পাওয়া মাত্র দেরি করলেন না। দার্জিলিং থেকেই যাত্রা করলেন আমেরিকার উদ্দেশে। আমেরিকা থেকে ফিরে আসার পর তাঁর স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটে।

১৯১১। নিবেদিতার ভগ্ন স্বাস্থ্য উদ্ধারের আশায় জগদীশচন্দ্র প্রস্তাব দিলেন দার্জিলিং যাত্রার। ঠিক হল, অবলা বসুর ভগ্নীপতি দ্বারকানাথ রায়ের ‘রায়ভিলা’ই হবে তাঁদের প্রবাসের বাসা। সম্মতি দিলেন নিবেদিতা। বসু দম্পতি বেরিয়ে পড়লেন আগেই। পৌঁছে প্রস্তুতি নিলেন সিকিম সফরে যাওয়ার। ১৭ বোসপাড়া লেন বাগবাজার থেকে ২১শে সেপ্টেম্বর নিবেদিতা মিস্টার ও মিসেস এস কে রাটক্লিফ-কে লিখে জানালেন ‘‘উই উইল লিভ টুমরো ফর দার্জিলিং।’’ দার্জিলিংয়ে এসে জগদীশচন্দ্রর সিকিম যাওয়ার পরিকল্পনা শুনে নিবেদিতা মহা খুশি, ‘‘ওখানে একটি মঠ আছে, দেখব।’’ দার্জিলিং থেকে তিব্বতের পথ ধরে যেতে হবে সান্দাকফু। সেখানে ১২ হাজার ফুট উঁচুতে বৌদ্ধ মঠ, সেটাই দ্রষ্টব্য।

ঘোড়ায় জিন বাঁধা হল। বিছানাপত্র খাবারদাবার সঙ্গে নিয়ে যাত্রার আয়োজন যখন সম্পূর্ণ, হঠাৎই অসুস্থ হয়ে পড়লেন নিবেদিতা। জ্বর, সঙ্গে রক্ত-আমাশা। ডাক্তার নীলরতন সরকার তখন দার্জিলিংয়ে। খবর পাঠানো হল তাঁকে। চিকিৎসা শুরু করে বুঝলেন, নিরাময় সম্ভব নয়। সেবাযত্নের ভারটি নিলেন বসুজায়া। নিবেদিতার রোগশয্যার পাশেই সর্বক্ষণ বসে থাকতেন। প্রবোধ দিতেন—‘‘এ রোগ প্রাণঘাতী নয়। শিগগিরই সুস্থ হয়ে উঠবে।’’ কিন্তু নিবেদিতা বুঝতে পেরেছিলেন, শেষের দিন আসন্ন। আশ্বাস দিয়ে মৃত্যুকে এড়ানো যাবে না। বললেন, ‘‘লেট দেয়ার বি নো হাইডিং অ্যান্ড ডোন্ট ট্রাই টু প্রোলং।’’ জগদীশচন্দ্র তখন বিষয়টিকে ভুলিয়ে রাখার জন্য, মনকে ভরিয়ে রাখার জন্য পড়ে শোনাতেন নিবেদিতারই কোনও প্রিয় গল্প। তাঁর মন আলোড়িত হবে ভেবে তখন কোনও কোনও রচনাংশ বাদ দিয়ে পড়তেন জগদীশচন্দ্র, কিন্তু রোগশয্যায় শুয়েও নিবেদিতা কিন্তু সচেতন। ঠিক ধরে ফেলতেন এবং ফলে জগদীশচন্দ্রকে আবার পুরোপুরি পড়তে হতো।

দার্জিলিঙে নিবেদিতার সমাধি; Image source: anandabazar

শরীর অসুস্থ, রোগাক্রান্ত —কিন্তু চেতনা প্রখর, জাগ্রত। ৭ই অক্টোবর। নিবেদিতার কথা মতো উকিল ডেকে আনা হল। নারীশিক্ষা প্রসারের যে সংকল্প করেছিলেন, জীবনের শেষ লগ্নেও তা অটুট। তৈরি করলেন দানপত্র। সঞ্চিত সমস্ত অর্থ, এমনকী ভবিষ্যতে গ্রন্থস্বত্ব থেকে আয়ের অর্থও স্ত্রী-শিক্ষা প্রচলনের জন্য বেলুড় মঠের ট্রাস্টিদের হাতে সমর্পণ করলেন। শেষ প্রহরে নিবেদিতারই অনূদিত বৌদ্ধ প্রার্থনাবাণী পাঠ করে শোনালেন অবলা। আর নিবেদিতার কণ্ঠে ক্ষীণস্বরে উপনিষদের সেই দিব্যবাণী—‘‘অসতো মা সদ্‌গময়, তমসো মা জ্যোতির্গময়, মৃত্যোর্মা অমৃতংগময়…।’’ বললেন, ‘‘তরণী ডুবছে, আমি কিন্তু সূর্যোদয় দেখব।’’ ক’দিন ধরেই চলছিল মেঘ-কুয়াশার খেলা। শুক্রবার, ১৩ই অক্টোবর। কোনও খাবার মুখে তুললেন না। ওষুধও নয়। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে ওঠা সূর্যের প্রথম আলো স্পর্শ করেছে হিমশিখরের চূড়া। ঘরে এসে পড়েছে তারই সোনালি আভা। খুলে ফেললেন অক্সিজেনের নলটি। মাত্র ৪৪ বছর বয়সে শেষ নিশ্বাস ফেললেন এই শৈলশহরের বুকে। দার্জিলিং শহরে তাঁর প্রয়াণের খবর ছড়িয়ে পড়তেই তাঁকে শেষ দেখা দেখতে রায়ভিলার সামনে ভিড় জমে যায়। শেষ যাত্রায় পা মেলান বসু দম্পতি, ডাক্তার নীলরতন সরকার, শশীভূষণ দত্ত, যোগেন্দ্রলাল বসু, শৈলেন্দ্রলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, নিশিকান্ত সেন বাহাদুর, বশীশ্বর সেনগুপ্ত, রাজেন্দ্রলাল দে প্রমুখ বিশিষ্ট জনেরা।

১৫ই অক্টোবর ‘বেঙ্গলি’ পত্রিকা লিখল — ‘‘দার্জিলিঙে এত বড় শোভাযাত্রা ইতিপূর্বে কেহ দেখে নাই।’’

শৈলশহরে নিবেদিতার স্মৃতি- বিজড়িত একমাত্র স্মারক ‘রায়ভিলা’ ২০১৩-র ১৬ই মে বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী হস্তান্তরিত করেন রামকৃষ্ণ মিশনের হাতে। ১০ই জুলাই থেকে মিশনের কাজ শুরু হয় বাড়িটিকে কেন্দ্র করে। সংস্কার করে বাড়িটির দ্বারোদ্ঘাটন হয় ২০১৪-র ১২ই জানুয়ারি। বর্তমানে এটি রামকৃষ্ণ মিশন নিবেদিতা এডুকেশনাল অ্যান্ড কালচারাল সেন্টার। শৈল শহরটির সঙ্গে নিবেদিতার যে সংযোগ স্থাপন হয়েছিল একদিন, তা-ই এতে আরও বেশি সুদৃঢ় হয়।

লেখকঃ রানা চক্রবর্তী

তথ্যসূত্র:
১- নিবেদিতা লোকমাতা, শঙ্করীপ্রসাদ বসু, আনন্দ পাবলিশার্স।
২- মহীয়সী নিবেদিতা, মৃগেন্দ্রচন্দ্র দাস, আনন্দ পাবলিশার্স।
৪- আনন্দবাজার পত্রিকা, ৩১শে অক্টোবর ২০১৬ সাল।
৫- আনন্দবাজার পত্রিকা, ১লা নভেম্বর ২০১৬ সাল।
৬- আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৮শে অক্টোবর ২০১৮ সাল।)