ভারতবর্ষের ইতিহাস বেশ পুরনো, কতো পুরনো সেটা সময়ের নিক্তি দিয়ে মেপে দেখা সম্ভব না। কিন্তু সবসময় বলা হয়, ভারতের বাইরে ভারতকে বিশ্বের সাথে যোগাযোগ করিয়েছে ইংরেজরা এবং বৃটিশ পন্ডিতরাই ভারত উপমহাদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য উন্মোচন করেছে । কিন্তু একথা সঠিক নয়, ইংরেজদের বহু আগেই গ্রীক, রোমান ও আরব মুসলমানরা প্রাচীন ভারতকে সারা বিশ্বের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলো। ফা হিয়েন, হিউয়েন সাঙ্গ এবং আল-বিরুনি, ইবনে বতুতার মতো পর্যটকরা এই দেশের অবস্থান সম্পর্কে তাদের অনেক আগেই মূল্যবান বিবরণী লিখেছিলো।

হিউয়েন সাঙের একটি পোর্ট্রেট; Image source: Wikimedia

তবে সবচেয়ে প্রাচীন বিবরণীটি হচ্ছে গ্রীক ঐতিহাসিক ও রাষ্ট্রদূত মেগাস্থিনিসের লেখা ‘দ্যা ইন্ডিকা’ বইটি। যদিও তার সেই অসাধারণ কপির কোনো হদিস আজ আর নেই, অথবা থাকলেও সেটা কোথায় আছে তা কেউ জানে না! আজকে আমরা সেই হারানো ইন্ডিকা বইয়ের বিষয়েই আলোচনা করবো, যেটা আমাদের বাংলার ইতিহাসের সাথেও জড়িত। রোমান ও গ্রীক লেখকদের এবং তাদের বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের উপর ইন্ডিকার প্রভাব ছিলো প্রচুর। এছাড়াও এটি ভারতীয় প্রত্নতাত্ত্বিকদের জন্য অমূল্য সম্পদ হিসেবে অনন্য এক ভূমিকা রাখে। এটাকে এদেশের একটি এনসাইক্লোপিডিক নকশাও বলা যায়।

মেগাস্থিনিস

হাজার হাজার বছর আগে ভারতের সিন্ধু, গঙ্গা এবং সরস্বতীর তীরে যেসব সভ্যতা গড়ে উঠেছিলো, সেসবের অনুসন্ধান ও খনন কাজ অবশ্য খ্রিষ্টান পশ্চিমারা খুব ভালোভাবেই দলিলযুক্ত করে লিখেছে। তার কারণ ছিলো আমাদের সমাজ – সংস্কৃতিকে আরো ভালোভাবে বুঝে তাদের শাসনকে দীর্ঘ করা, যেটাতে তারা পুরোপুরি সফল হয়েছে। এটা ছিলো সম্পূর্ণই উপনিবেশিক চক্রান্ত। মেগাস্থিনিসের ক্ষেত্রেও হয়তো সেরকম কিছু ছিলো। মূলত: মেগাস্থিনিস ছিলেন চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যর গ্রীক রাষ্ট্রদূত, আর তিনি এসেছিলেন সেলুসিড সম্রাটের দরবার থেকে। প্রথমে তিনি ম্যাসিডোনিয়ার সম্রাট আলেকজান্ডারের সহযোগী হিসেবে উত্তর-পশ্চিম ভারত আক্রমণের সময় আসেন। এরপর আলেকজান্ডারের মৃত্যু হলে তিনি চন্দ্রগুপ্ত ও সেলুকাসের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনের জন্য বাংলার চন্দ্রগুপ্তের রাজধানী পাটলিপুত্রের দরবারে রাষ্ট্রদূত হিসাবে আসেন। সম্ভবত ৩০২-২৯৮ খ্রীস্টপূর্বাব্দের সময়কালে তিনি ৪/৫ বছর ভারতবর্ষে ছিলেন। পরবর্তীতে গ্রীসে ফেরত গিয়ে ‘দ্যা ইন্ডিকা’ বইটি লিখেন। মূলতঃ ভারত এবং আমাদের প্রাচীনতম ও সর্বাধিক বিস্তৃত বিবরণীর উৎস এখান থেকেই এসেছে । ধারণা করা হয় মেগাস্থিনিস কাবুল ও পাঞ্জাবের মধ্য দিয়ে পাটলিপুত্রে এসেছিলেন এবং সেখান থেকে আর অন্য কোথাও যাননি। ফলে তার বিবরণে পাটলিপুত্রের বিষয় যতোটা দারুণভাবে ফুটে উঠছে, এ অঞ্চলের অন্যান্য প্রদেশ সম্পর্কে তেমনটা ঘটেনি। সেসব অঞ্চল সম্পর্কে তার বিবরণ কেবলই লোকশ্রুতির ওপর ভিত্তি করে বলা, যার অধিকাংশই মিথ্যে ও নাটকীয় ।

খ্রিস্টপূর্ব ৩২৬ সালে চন্দ্রগুপ্তের সময়ে আলেকজান্ডার দ্যা গ্রেট ভারত আক্রমণ করেছিলেন। যার ফলে উত্তর-পশ্চিম ভারতের বেশিরভাগ এলাকা বিশৃঙ্খলার মধ্যে পড়েছিলো। এই সময় মগধের শাসক ছিলেন নন্দ রাজবংশের শেষ রাজা ধনানন্দ। তার সাম্রাজ্যে কড়া আইন ছিলো। তিনি তার সাম্রাজ্যের সেনাবাহিনীকে যুদ্ধের জন্য সবসময় প্রস্তুত রাখতেন। রোমান ঐতিহাসিক কার্টিয়াসের মতে, সাম্রাজ্য বিস্তারের জন্য তিনি ২০,০০০ অশ্বারোহী, ২,০০,০০০ পদাতিক, ২,০০০ রথ এবং ৩,০০০ যুদ্ধহাতি বিশিষ্ট সুবিশাল বাহিনী গড়ে তোলেন। এতো বড় সেনাবাহিনীর কথা শুনে উত্তর-পশ্চিম ভারতের যুদ্ধ-ক্লান্ত ম্যাসেডোনিয়ার সৈন্যদের মধ্যে হতাশা আরও বেড়ে গিয়েছিলো। ফলে আলাকজান্ডারের ভারত আক্রমণ করার সূচনা পেয়ে ভারতকে আলেকজান্ডারের হাত থেকে বাঁচাবার জন্য তক্ষশীলার আচার্য্য চানক্য সাহায্য চাইতে গিয়েছিলেন মগধ সম্রাট ধনানন্দ এর কাছে। কিন্তু চানক্যকে তিনি অপমান করে বের করে দেন রাজ্য থেকে। তিনি তার অপমানের প্রতিশোধের জন্য চন্দ্রগুপ্তকে মগধের রাজা করার পরিকল্পনা করেন এবং প্রতিজ্ঞা করেন এই পুরো ভারতে অন্য একচ্ছত্র সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করবেন।

দিল্লির বিড়লা মন্দিরে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য্যের মূর্তি; Image source: Wikimedia

মগধের এক অন্যতম মহারাজা হলেন চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য! গ্রীকদের কাছে তিনি স্যান্ড্রাকোটাস নামে পরিচিত ছিলেন। চন্দ্রগুপ্ত ছিলেন খুব উচ্চাভিলাষী এবং তিনি মুকুট অর্জনের উপায় অনুসন্ধান করছিলেন। আলেকজান্ডারের সাথে তিনি দেখা-সাক্ষাতও করেছিলেন, সম্ভবত তাঁর সেনাবাহিনীকে তিনি মগধে যুদ্ধের জন্য বলেছিলেন। কিন্তু চন্দ্রগুপ্ত সেলুকাসের সাথে বিরোধে জড়িয়ে পড়েন। চন্দ্রগুপ্তের সাথে মুখোমুখি যুদ্ধও হয়েছিলো সেলুকাসের। সেলুকাস ছিলেন সিকন্দর বা আলেজান্ডারের বাবা, ম্যাসিডন রাজ ফিলিপের সেনাপতি, এ্যান্টিওকসের পুত্র সিকন্দরের মৃত্যুর পর তার রেখে যাওয়া সাম্রাজ্যের পূর্বাংশ লাভ করেন সেনাপতি সেলুকাস। তিনি ব্যাবিলন ও ব্যাকট্রিয়া জয় করে হাজির হন ভারতে সিকন্দরের জয় করা অঞ্চলগুলো পুনরায় উদ্ধার করতে। পরবর্তীতে সেলুকাস ও স্যান্ড্রাকোটাসের ( চন্দ্রগুপ্ত) মধ্যে এক বন্ধুত্বপূর্ণ সন্ধির মাধ্যমে যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে। যেমন সব সন্ধিতে হয়, তেমনি এখানেও নানা হাতি-ঘোড়া-রাজ্য প্রভৃতি আদান প্রদান করা হয় কিন্তু এর সাথে আরও একটি বিষয় ঘটে, সে বিষয়ে লেখক স্ট্রাবো লিখেছেন, “উভয়ের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়।” এ সম্পর্কে আমরা আরও তথ্য পাই দুইজন লেখকের কাছ থেকে। তাদের দু’জনের মধ্যে একজন এ্যাপ্পিয়ান…তিনি বৈবাহিক সম্পর্কের কথা উল্লেখ করতে গিয়ে যে শব্দটি ব্যবহার করেন তা হলো- ‘KEDOS’……….অপরদিকে স্ট্রাবো লিখেছেন, ‘EPIGAMIA’ এই দুটো শব্দের জন্যই কিছুটা দ্বিধাদ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়! কেননা এখানে ‘KEDOS’ শব্দের মাধ্যমে বিয়ের সম্পর্ক বোঝায় কিন্তু ‘EPIGAMIA’ শব্দের অর্থ হলো, দুই রাজবংশের মধ্যে বিয়ের সম্পর্ক স্থাপনের অধিকারের স্বীকৃতি তবে বিয়ে নয়। এর ফলে সেলুকাসের মেয়ে হেলেনের সাথেই যে চন্দ্রগুপ্তের বিয়ে হয়েছিলো তা নিশ্চিত ভাবে বলা যায় না!

মেগাস্থিনিস ভারত দর্শন শেষে নিজে যে পান্ডুলিপিটি তৈরী করেন তার নাম দেন “দ্যা ইন্ডিকা” (Indica)’। খুবই পরিতাপের বিষয় যে ঐ পান্ডুলিপিটি এখন আর পাওয়া যায় না, হয় হারিয়ে গেছে নয়তো চিরতরে বিনষ্ট হয়ে গেছে! তবে আনন্দের বিষয় যে, তার সমসাময়িক বা অল্প কিছু পরের কয়েকজন গ্রীক লেখক যেমন- আরিয়ান, স্ট্রাবো, ডায়োডরোস প্রমূখ তাদের লেখা বইসমূহে মেগাস্থিনিসকে উদ্ধৃত করেছিলেন। ফলে ঐ সব উদ্ধৃতির মাধ্যমে মেগাস্থিনিসের ইন্ডিকা সামান্য হলেও বেঁচে আছে। আধুনিককালে ১৮৪৬ সালে, জার্মানীর বন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. ই এ শোয়ানবেক প্রচুর খেটে বিভিন্ন লেখকের লেখার মধ্য থেকে মেগাস্থিনিসের ঐসব উদ্ধৃতাংশগুলো এক জায়গায় করে “মেগাস্থিনিস ইন্ডিকা” নামক একটি সংকলন প্রকাশ করেন…. বইটি প্রকাশ হবার সঙ্গে সঙ্গে ভারতসহ সারা বিশ্বে বেশ সাড়া পড়ে যায় । এরপর ১৮৮৮ সালে ম্যাককিন্ড্রল কলকাতা থেকে একটি ইংরেজী সংস্করণ বের করেন। এর ফলেই প্রাচীন ভারত সম্পর্কে প্রামাণ্য তথ্য জানার সুযোগ সৃষ্টি হয় আমাদের। সেই সময় বাঙালীদের মধ্যেও এই বিষয়ে জানবার ঝোঁক হয়েছিলো! বরিশালের প্রতিভাবান লেখক ও অনুবাদক রজনীকান্ত গুহ ছিলেন গ্রীক ও ইংরেজী ভাষার সুপন্ডিত। তিনি বইটির মূল কপি গ্রীক থেকে বাংলায় ‘মেগাস্থিনিসের ভারত বিবরণ’ নামে অনুবাদ করেন। আথীনেয়স, ক্লিমেন্ট এবং জোসেফসের বই থেকে যেসব সূত্র পাওয়া যায় তা থেকে ধারণা করা হয় যে, ইন্ডিকা বইটি কমপক্ষে চারটি খন্ডে রচিত হয়েছিলো । এছাড়া মেগাস্থিনিসের ভারত বিবরণ থেকে প্রাচীনকালের ভারতবাসীদের আচার- ব্যবহার, নানা জাতির বৃত্তান্ত, ভারতবর্ষের ইতিহাস, দেবদেবী ও ধর্মানুষ্ঠান ইত্যাদি সম্পর্কেও আমরা জানতে পারি ।

 
ধারণা করা হয়, মেগাস্থিনিস ভাষার কারুকাজে না গিয়ে তিনি ভারতবর্ষের নতুন নতুন জিনিস ও অনাবিষ্কৃত বিষয়গুলো উল্লেখ করতে ব্যস্ত ছিলেন। মেগাস্থিনিস ভারতবর্ষের সীমা সঠিকভাবে নির্ণয় করে তার ভূ-বৃত্তান্ত শুরু করেন। গ্রীকদের মধ্যে তিনিই প্রথম এই কাজটি মোটামুটি সফল ভাবে করতে সক্ষম হয়েছিলে এবং ভারতবর্ষের দৈর্ঘ্য ১৬ হাজার স্টাডিয়ম (১ স্টাডিয়ম=৬০৬ ফুট ৯ ইঞ্চি) বের করেন। সিন্ধুনদ থেকে পাটলিপুত্র পর্যন্ত ১০ হাজার স্টাডিয়ম এবং সমুদ্র পর্যন্ত অবশিষ্ট অংশ নাবিকদের গনণা অনুযায়ী ৬ হাজার স্টাডিয়ম। স্ট্রাবোর বই থেকে তার লেখার উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়- ‘ভারতবর্ষের দক্ষিণ ভাগে সপ্তর্ষিমন্ডল দেখা যায় না, এবং ছায়া বিপরীত দিকে পড়ে, যা অনেক ক্ষেত্রে সত্য । ভারতীয় নদী সম্পর্কে পূর্ব থেকেই গ্রীকদের অতি উচ্চধারণা ছিলো বলে তিনি জানান। যেমন সিন্ধু নদকে প্রমত্তা ও সুবিশাল বলেছেন এবং নীল, দানিয়ুবসহ পৃথিবীর তাবৎ নদীর মধ্যে একমাত্র গঙ্গা ছাড়া সিন্ধুই সর্ববৃহৎ উল্লেখ করেছেন।
 
তিনি সিন্ধুর পনেরটি উপনদীর নাম লিপিবদ্ধ করে যান। ইউরোপীয়দের মধ্যে মেগাস্থিনিসই সর্বপ্রথম বাংলার গঙ্গা নদীর বিবরণ লেখেন। তবে কিছু নাটকীয়তাও রয়েছে তার বর্ণনায়। যেমন- শিলা নামক আরেকটি অদ্ভুত এক নদীর কথা উল্লেখ করেছেন, যে নদীতে নাকি কিছুই ভাসে না, যা ফেলা হয় তাই পাথর হয়ে ডুবে যায় নদীর অতলে! বোঝাই যাচ্ছে যে, পৌরাণিক কোনো কাহিনী থেকেই এমন নদীর কথা তিনি জেনেছিলেন। তিনি সিন্ধু ও গঙ্গা ছাড়াও আরও ৫৮টি নদীর কথা বলেছেন। মেগাস্থিনিস ভারতবর্ষের মাটির উর্বরতার বিষয়টিও খুব প্রশংসার সাথে বলেছেন। বছরে দুইবার শস্য কাঁটার কথা বলেছেন তিনি…… আবলুস, তাল, বেত, বন্যদ্রাক্ষা, আইভি, লরেল, মার্টল প্রভৃতি বৃক্ষ লতার বর্ণনা দিয়ে গেছেন মেগাস্থিনিস । ভারতীয় পশুর মধ্যে বাংলার বাঘ, হাতি, বানর, কুকুর, কৃষ্ণসার অশ্ব, বিদ্যুৎমাছ, সাপ, পাখাযুক্ত বৃশ্চিকসহ অনেক প্রাণীর বর্ণনা দিয়েছেন তিনি। সেখানে তিনি বিশদভাবে ভারতের বিশিষ্ট হাতি সম্পর্কে লিখেছেন। এখানকার শাসকরা হাজারো হাতি দিয়ে কিভাবে বহি:শত্রুর হাত থেকে দেশকে রক্ষা করতেন এবং কিভাবে খেদায় নিয়ে গিয়ে বুনো হাতিকে আটক করে পোষ মানানো হতো সেটাও যর্থাথ ভাবে লিখেছেন মেগাস্থিনিস । তার লেখায় ভূ-প্রকৃতি, খনিজ সম্পদের কথা ছাড়াও ভারতীয়দের জীবন ও আচার ব্যবহার সম্পর্কে বিশদ ভাবে উল্লেখ রয়েছে। তিনিই সর্বপ্রথম ভারতীয়দের জাতিভেদ প্রথা সম্পর্কে বর্ণনা করেন। তিনি বলেছেন, মোট সাতটি জাতিতে বিভক্ত ছিলো ভারতীয়রা। যথা: পন্ডিত, কৃষক, গোপাল ও মেষপালক, শিল্পী, যোদ্ধা, পর্যবেক্ষক, মন্ত্রী/বিচারক।

পাটালিপুত্রের অশোকের প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষে ফা-হিয়েন; Image source: Wikimedia

 
সেই আমলে আমাদের পূর্বপুরুষদের আচার-আচরণ কেমন ছিলো? তারা কেমন জীবন-যাপন করতেন? এ সব কিছু জানতে এই বইটি আমাদেরকে খুবই আগ্রহী করে তোলে। পাটলিপুত্রের পৌরসভা প্রশাসন বিদেশী নাগরিক, জন্ম ও মৃত্যু, শিল্প ইত্যাদি দেখাশোনা করে এমন কমিটির ব্যাখ্যাও করেছেন তিনি, যা আমাদের প্রাচীন বিশ্বের একটি মহানগরীর ধারণা দেয়। সে সময়ের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে কেবল চন্দ্রগুপ্তের নয়…. নন্দদের কথাও উল্লেখ করা হয়েছে, তাদের কল্পিত সম্পদ এবং উগ্র সেনাবাহিনী যা আলেকজান্ডারকে ভারতে প্রবেশে বাধা দেয় সেটাও বলা হয়েছে। তবে একটি বিতর্ক হলো যে, তিনি বলেছেন, ভারতীয়রা লেখার শিল্পকে জানতো না! এছাড়া আরও বেশ কিছু কাল্পনিক ও অসত্য বর্ণনার জন্য মেগাস্থিনিসের রচনা আমাদের কাছে কতোটুকু বিশ্বাসযোগ্য সে প্রশ্ন থেকেই যায়!! তবে মিথ্যা বা প্রপাগান্ডা যাইহোক না কেনো গ্রীক এবং রোমান লেখকরা ভারত সম্পর্কে জানার জন্য বেশিরভাগেই তাঁর উপর নির্ভর করেছিলেন। পেরিপ্লাস এবং টলেমির কাজগুলি সাধারণ যুগের প্রথম শতাব্দীতে পাওয়া গেলেও তারা তাঁর উপর নির্ভর করেই চলেছে। আমাদেরকে সেটা করলে চলবে না, বরং নতুন করে এই বিষয়ে আরো অনুসন্ধান চালানোই হবে বুদ্ধিমানের কাজ! এমনও তো হতে পারে যে, মিশরের চেয়েও আরও সমৃদ্ধ দেশ ছিলো তা প্রমাণ করার জন্য মেগাস্থিনিস ভারতের ভূমি এবং জনগণের বিবরণ লিখেছিলেন। তাই গ্রীক সভ্যতার দৃষ্টিকোণ থেকে হারিয়ে যাওয়া মেগাস্থিনিসের ইন্ডিকা বই উপনিবেশিক মনমানসিকতার বাইরে থেকে পাঠ করতে হবে, তাহলেই প্রকৃত বিষয়গুলো চিহ্নিত করা সহজ হবে। যখানে গ্রীক সভ্যতা পৃথিবী থেকে হারিয়ে গেছে এবং কেবল তার ধ্বংসাবশেষ রেখে গেছে, সেখানে ভারত মাথা উঁচু করে তার সমৃদ্ধ ইতিহাস নিয়ে আজও বেঁচে আছে।