দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে সমগ্র বিশ্ব কার্যত দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। একদিকে মার্কিন নেতৃত্বাধীন পুঁজিবাদী গ্রুপ অপরদিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন নেতৃত্বাধীন সমাজতান্ত্রিক গ্রুপ। এই দুই পক্ষের মধ্যে প্রতিযোগিতাই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর বিশ্বের প্রধান ইস্যু হয়ে দাঁড়ায়। যার কেতাবি নাম দেয়া হয় স্নায়ুযুদ্ধ। কোন পক্ষ বিশ্বে আধিপত্য বিস্তার করবে অর্থাৎ বিশ্ব কি পুঁজিবাদী ভাবধারায় চলবে নাকি সমাজতান্ত্রিক ভাবধারায় চলবে তা নির্ধারণ করার জন্য আমেরিকা, সোভিয়েত ইউনিয়ন উভয়ে নিজেদের মতো প্রচেষ্টা চালাতে থাকে। এই জন্য তারা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে দেশে নিজেদের মতের লোকদের শাসন ক্ষমতায় বসানোর জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এই ধারাবাহিকতায় পৃথিবীর যে সকল দেশে এই দুই দেশের প্রতিযোগিতার চূড়ান্ত নমুনা প্রকাশ পেয়েছে ভিয়েতনাম তাদের মধ্যে অন্যতম। এই দুই দেশের দুই মতাদর্শের জন্যই ভিয়েতনামের হাজার হাজার সাধারণ মানুষের প্রাণ দিতে হয়েছিল। সম্পূর্ণ রাষ্ট্রকে বিসর্জন দিতে হয়েছে প্রায় দুই দশকের রাষ্ট্রীয় সুখ শান্তি। যুদ্ধের মূল কাহিনী জানার পূর্বে ভিয়েতনামের পিছনের ইতিহাসের দিকে একটু ফিরে দেখা যাক।
১৮৮৪ সালে ভিয়েতনাম ফরাসি উপনিবেশের অধীনে চলে যায়। তখন থেকে তারা উপনিবেশিক রাজ্য হিসেবে ফরাসিদের দ্বারা শাসিত হতে থাকে। দীর্ঘদিন উপনিবেশিক শাসকদের অধীনে থাকার পর ১৯৪৬ সালে তারা তাদের স্বাধীনতা আদায়ের জন্য ফরাসি বাহিনীর বিরুদ্ধে সংগ্রাম শুরু করে। দীর্ঘ আট বছরব্যাপী লড়াই সংগ্রাম চালানোর পর তারা তাদের স্বাধীনতা ফিরে পায়। কিন্তু এই স্বাধীনতার স্বাদ গ্রহণের পূর্বেই তাদের গলার কাঁটা হয়ে দেখা দেয় মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ। তখন মার্কিনীদের আদর্শের যাঁতাকলে পড়ে ভিয়েতনাম কে দুই ভাগে ভাগ করা হয়। ভিয়েতনাম কে স্বাধীন করার জন্য যারা মূল নেতৃত্বে ছিল তারা প্রায় সকলেই ছিল সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শে উজ্জীবিত। তাই তারা স্বাধীনতা ফিরে পাবার পর ভিয়েতনাম কে একটি আদর্শ সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র লক্ষ্য করল ভিয়েতনামে যদি সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় তাহলে তা সমগ্র দক্ষিণ এশিয়াকে প্রভাবিত করবে এবং এখানে চীন–সোভিয়েত রাশিয়ার শক্তি অতি মাত্রায় বৃদ্ধি পাবে। ডমিনো এফেক্টের তত্ত্ব অনুযায়ী পুরো দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া চলে যাবে সমাজতান্ত্রিক আদর্শে। ফলে এই অঞ্চলে পুঁজিবাদ প্রতিষ্ঠা করার স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে যাবে। মার্কিনি হেজিমনিকে টিকিয়ে রাখার স্বার্থে তাই ভিয়েতনামে গোলমাল তৈরি করা আমেরিকার জন্য অবশ্য কর্তব্য হয়ে যায়। ১৯৫৪ সালে জেনেভা সম্মেলনের মধ্য দিয়ে ভিয়েতনাম কে দুই ভাগে ভাগ করে দেয়া হয়। একদিকে উত্তর ভিয়েতনামের বিপ্লবী নেতারা হো চি মিন কে প্রধান করে একটি সমাজতান্ত্রিক শাসন দাঁড় করায়। অপরদিকে দক্ষিণ ভিয়েতনামে প্রথমে বাও দাই কে রাষ্ট্র প্রধান করা হলে কিছুদিন পরই তাকে সরিয়ে ক্ষমতায় আসে মার্কিন মদতপুষ্ট শাসক দিয়েম। দিয়েম গণভোটের প্রতিশ্রুতি দিলেও পরে আর কোন ভোট না দিয়ে শাসন ক্ষমতা পরিচালনা করতে থাকে। এই দিকে উত্তরের বিপ্লবীরা,সাধারণ জনগন ও হোচিমিন সরকার সবসময় চাইত একটি অখণ্ড ভিয়েতনাম গড়তে এমনকি দক্ষিণ ভিয়েতনামের অধিকাংশ মানুষই চাইত অখণ্ড ভিয়েতনাম গড়তে এবং একক সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে ভিয়েতনাম কে একটি শক্তিশালী সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে। অনেকটা এই ভয় থেকেই দিয়েম সরকার গণভোটের আয়োজন করেনি। কারন দিয়েম প্রশাসন জানত যে গণভোটের আয়োজন করলে সমাজতন্ত্রের পক্ষে বেশি ভোট পড়বে সাথে সাথে দিয়েম সরকারেরও পতন নিশ্চিত হবে। মার্কিনীরা সবসময় মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারের কথা বললেও সে সময় ভিয়েতনামের গণভোটের ব্যাপারে ছিল একেবারে নিশ্চুপ কারন তারাও জানত যে গণভোট দিলেই তাদের মদদপুষ্ট দিয়েম সরকারের পতন হবে সেই সাথে দক্ষিন এশিয়াতে তাদের পুঁজিবাদ ছড়িয়ে দেয়ার যে মনোবাসনা তারও সলিল সমাধি ঘটবে।
এইদিকে দক্ষিণ ভিয়েতনামের সাধারণ জনগণ
ও মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা মার্কিন মদতপুষ্ট দিয়েম সরকারকে সহজে মেনে নিতে পারেনি। তারা বিচ্ছিন্নভাবে তার বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে থাকে। ফলে দিয়েম সরকারও তাদের উপর পাল্টা দমনপীড়ন চালাতে থাকে। এতে করে দক্ষিণ ভিয়েতনামের শাসন ব্যবস্থা অনেকটা ভেঙ্গে পড়ে। দক্ষিণ ভিয়েতনামের সাধারণ জনগন ও বিপ্লবীরা হোচিমিন কে তাদের নেতা মানতে শুরু করে। একসময় দেখা যায় দক্ষিণ ভিয়েতনামের প্রশাসন নামমাত্র শাসকের আসনে অন্যদিকে সকল জনগন উত্তর ভিয়েতনামের ইশারায় চলতে থাকে। এর দরুন ১৯৬০ সালে দক্ষিন ভিয়েতনামের সরকারকে উৎখাত করার জন্য “ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট” নামে একটি দল গঠন করা হয়।তারা দক্ষিণ ভিয়েতনামে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তোলে এবং একপর্যায়ে প্রায় সকল প্রত্যন্ত অঞ্চলে এই ফ্রন্টের অধীনে চলতে থাকে । একই সাথে সরকারের পক্ষ থেকে তাদের উপর চলে পাশবিক নির্যাতন । একপর্যায়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দেখল যে তাদের বানানো দিয়াম সরকার কে আর ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখা যাচ্ছে না। তখন ১৯৬১ সালে মার্কিনীরা ভিয়েতনামে সরাসরি তাদের সেনাবাহিনী মোতায়েন করে। ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের সবেমাত্র মঞ্চায়ন ঘটা শুরু করল।
ভিয়েতনামের মাটিতেই ভিয়েতনামীদের শায়েস্তা করার জন্য মার্কিন সৈন্যরা নিজেদের মিশনে নামে। দীর্ঘসময়ব্যাপী ধরে দক্ষিণ ভিয়েতনামে চলে অচলাবস্থা। এর মধ্যেই ১৯৬৩ সালে এক সামরিক অভ্যূত্থানের মধ্য দিয়ে দিয়াম সরকারের পতন ঘটে এবং পরবর্তী আরও বেশ কয়েকটি সামরিক অভ্যূত্থান হলে দক্ষিণের সরকার বলতে আর কিছু অবশিষ্ট রইল না। ফলে এখানকার শাসন অনেকটা সরাসরি মার্কিন সৈন্যবাহিনীর হাতে চলে যায়।
১৯৬৪ সালে মার্কিন জাহাজের মধ্যে বিপ্লবীদের বোমাবর্ষণের মধ্য দিয়ে সরাসরি মার্কিন-ভিয়েতনাম যুদ্ধের সুত্রপাত হয়। ফলে ১৯৬৫ সাল থেকে আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়।
চলতে থাকে আমেরিকান সৈন্যদের অবিরাম বিমান হামলা। ভিয়েতনামের আকাশ মার্কিন বিমানের শব্দে প্রকম্পিত হয়ে উঠে। আর এই বিমান থেকে বৃষ্টির ন্যায় বর্ষিত হতে থাকে প্রাণঘাতী সব বোমা। অপরদিকে ভিয়েতনামীদের প্রধান শক্তি ছিল তাদের গেরিলা আক্রমণ ও অকুতোভয় বীর যোদ্ধা যারা মার্কিনীদের হটানোর জন্য যেকোনো সময় নিজের জীবন দিতে প্রস্তুত ছিল।
১৯৬৮ সালে রিচার্ড নিক্সন মার্কিন প্রেসিডেন্ট হলে ভিয়েতনামে মার্কিন সৈন্যদের নৃশংসতার মাত্রা বেড়ে যায়। তিনি ভিয়েতনাম রণাঙ্গনে মার্কিনীদের সফলতা ছিনিয়ে আনার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেন। যেকোনো মূল্যে সেখানে মার্কিন ঘাটি শক্তিশালী করতে ভিয়েতনামীদের রক্তের স্রোতের উপর দিয়ে রণতরী নিয়ে যাওয়ার জন্যও তিনি প্রস্তুত ছিলেন তিনি। তখন মার্কিনীদের কাছে মানবাধিকারের চেয়ে তাদের নিজেদের স্বার্থই বেশি প্রাধান্য পায়। ফলে সেখানে মার্কিন সৈন্যরা সকল আধুনিক অস্ত্র নিয়ে নেমে পড়ে। কিন্তু তা সত্ত্বেও ভিয়েতনামের অকুতোভয় গেরিলারা তাদের গেরিলা আক্রমণের মাধ্যমে একের পর এক মার্কিন বিমান ধ্বংস ও আমেরিকান সেনাদের হত্যা করে। ফলে মার্কিন সৈন্যরা দীর্ঘ সময় যুদ্ধের মাধ্যমে যেমন ছিল ক্লান্ত তেমনি তারা যুদ্ধ করার জন্য মানসিক শক্তিও হারিয়ে ফেলে। তাছাড়া ভিয়েতনামের সকল প্রত্যন্ত অঞ্চল ছিল ভিয়েতনামী সৈন্যদের হাতে যেখানে বিমান ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র কোন হামলা করতে পারত না এবং এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্যদের শনাক্ত করাও ছিল কষ্টসাধ্য ব্যাপার। ফলে মার্কিনীরা তাদের সকল শক্তি প্রয়োগ করেও যখন সেখানে সফলতা পাচ্ছিলোনা তখন তারা চাচ্ছিল সম্মানজনক একটি উপায়ের মধ্য দিয়ে যুদ্ধ থেকে বের হয়ে আসতে। এর বাইরে যুদ্ধে জড়ানো সৈন্যরাও ভিয়েতনামে যুদ্ধ করার সকল আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। তারা চাচ্ছিল যত দ্রুত সম্ভব নিজ ভূমিতে ফিরে যেতে। এজন্য তারা মার্কিন প্রশাসনের কাছে বার বার আবেদন পাঠাতে থাকে।
ফলে ১৯৬৯-১৯৭৩ সাল পর্যন্ত মার্কিনীরা ভিয়েতনামের সাথে প্রকাশ্য ও গোপনে বেশ কয়েকটি বৈঠক করে। এই আলোচনাকে সফল করার জন্য আমেরিকার তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারকে দ্বায়িত্ব দেয়া হয়। অপরদিকে ভিয়েতনামের পক্ষ থেকে আলোচকের দ্বায়িত্ব পান জুয়ান থুই ও লি ডাক থো। কিসিঞ্জার তাদের সাথে বেশ কয়েকটি বৈঠক করার পর ১৯৭৩ সালের ২৩ জানুয়ারি উভয়ের মধ্যে প্যারিসে একটি শান্তি চুক্তি সাক্ষরিত হয়। চুক্তি অনুযায়ী পরবর্তী ৮০ দিনের মধ্যে ভিয়েতনামীদের হাতে বন্দী সকল মার্কিন সৈন্যদের মুক্তি ও তাদের নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা করা সহ সকল মার্কিন সৈন্যদের নিরাপদে ভিয়েতনাম ছাড়ার ব্যবস্থা করার কথা বলা হয়। একইসাথে যুদ্ধবিরতি কার্যকর করার কথাও বলা হয়। ২৯শে মার্চের মধ্যে মার্কিনীরা তাদের সকল সৈন্যদেরকে ভিয়েতনাম থেকে প্রত্যাহার করে নিলেও তারা যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করে উত্তর ভিয়েতনামে বোমাবর্ষণ করতে থাকে। ফলে বাধ্য হয়ে উত্তর ভিয়েতনামও আবার যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করে। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য ১৯৭৩ জুনের পূর্বের চুক্তি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে আবার একটি পেপার সাইন করা হয়। এর মাধ্যমেই ভিয়েতনাম যুদ্ধের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি কার্যকর হয়। এরপর ১৯৭৫ সালে সাম্যবাদী শাসনের অধীনে দুই ভিয়েতনাম একত্রিত হয় এবং ১৯৭৬ সালে এটি সরকারীভাবে “ভিয়েতনাম সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র” নাম ধারণ করে।
এই যুদ্ধে প্রায় ৩২ লক্ষ ভিয়েতনামিজ মারা যান। আর মার্কিনীদের পক্ষে প্রায় ৫৮ হাজার সেনা নিহত হয়।
ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় সপ্তম নৌবহরকে ব্যবহার করা হয়েছিল। বিশেষ করে এই নৌবহর থেকে ভিয়েতনামের অভ্যন্তরে বিমান আক্রমণ পরিচালনা করা হতো। ভিয়েতনামের পাহাড়ি জঙ্গলময় অঞ্চলে সৈন্য সরবরাহ, সৈন্যদের রসদ যোগানো, সুনির্দিষ্টভাবে কোনো জায়গায় আঘাত হানার জন্য ব্যবহার করা হয় নানা ধরনের প্রায় ১২,০০০ হেলিকপ্টার। অবশ্য প্রায় ৫,০০০ ভিয়েতনামী হেলিকপ্টার গেরিলারা ধ্বংস করে দিয়েছিল।
ভিয়েতনামে যুদ্ধে পরাজিত হওয়া যুক্তরাষ্ট্রের জন্য সবচেয়ে লজ্জাজনক বিষয় ছিল। তাদের সামরিক ইতিহাসে ভিয়েতনাম যুদ্ধ ছিল এক দগদগে ক্ষত। আর ভিয়েতনামের জন্য এটি ছিল এক মহান বিজয়। সাম্রাজ্যবাদী শক্তিকে প্রবল বিক্রমে ঠেকিয়ে দিয়ে ভিয়েতনাম আত্মমর্যাদাশীল একটি জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়। সায়গন শহরের ছাদ থেকে মার্কিন হেলিকপ্টারের পলায়ন ফের পুনরাবৃত্তি ঘটেছিল আফগানিস্তানে, ২০২১ সালে। ভিয়েতনাম যুদ্ধ এভাবে ফিরে ফিরে এসেছিল।