Moai statue

১৭২২ সাল। চিলিতে পৌঁছেছেন অ্যাডমিরাল জ্যাকব রেগেভিন ও তার দল। একটি ডাচ অভিযানে নেতৃত্ব দিচ্ছেন রেগেভিন। উদ্দেশ্য চিলি থেকে প্রায় ২২০০ মাইল দূরের একটি দ্বীপ ভ্রমণ, যেখানে অনেক অনেক বছর আগে ‘রাপা নুই’ নামে এক জাতির বসবাস ছিলো। দ্বীপটি চিলিরই মালিকানাধীন বর্তমানে। রাপা নুইদের এই দ্বীপের কথা অনেক শুনেছেন রেগেভিন, তবে বাস্তবে দেখার সৌভাগ্য প্রথম বার হতে যাচ্ছে তার। স্যান্টিয়াগো থেকে একটি জাহাজে করে রওয়ানা হলেন তারা। কিছুদূর যাবার পরই বুঝতে পারলেন, প্রশান্ত মহাসাগরের একদম মাঝামাঝি চলে যাচ্ছেন তারা। সত্যিই রাপা নুইদের দ্বীপটি সাগরের ভীষণ গভীরে। নিশ্চিতভাবেই আশেপাশে দূর-দূরান্ত পর্যন্ত তেমন কোনো লোকালয় নেই।

রাপা নুই মানুষ

রাপা নুই মানুষ, লুই চোরিস দ্বারা আঁকা, ১৮১৬, Photo Credit: Wikipedia

ঐ তো, দূরে দেখা যাচ্ছে, অসংখ্য দৈত্যাকৃতির মানুষ যেনো সারিবদ্ধভাবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। এ যেনো এক বিস্ময়! এতোদিন শুধু শুনেছিলেনই, তবে আজ নিজ চোখে দেখলেন রেগেভিন ও তার দল। চোখ ফেরানো যায় না। তবে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকলেও কেমন যেনো ঘোরের মতো লাগে। মনে হচ্ছে যেনো আদিমকালের এক দল অতিপ্রাকৃতিক মানুষের অবয়ব ঠায় দাঁড়িয়ে পাহারা দিয়ে যাচ্ছে রাপা নুইদের নিবাস।

দিনটি ছিলো ইস্টার সানডে। অবশেষে রাপা নুইদের দেশে প্রথমবারের মতো পা রাখলেন রেগেভিনরা। ইস্টার সানডে-তে এই দ্বীপে পৌঁছেছেন বলে রেগেভিন এর নাম রাখলেন ‘ইস্টার আইল্যান্ড’।

বিশাল প্রশান্ত মহাসাগরের দক্ষিণ অংশের মাঝখানে এ যেনো এক টুকরো শিলালিপি। এক সময় প্রচুর গাছপালা ছিলো এই দ্বীপে। কিন্তু এখন দেখলে মনে হবে ধূ ধূ মরুভূমি। বার বার অগ্ন্যুৎপাতের কারণে দ্বীপটির আজ এই দশা। আসলে দ্বীপটি নিজেই গড়ে উঠেছে আগ্নেয়গিরির লাভা থেকে। মোট তিনটি আগ্নেয়গিরি আছে এখানে –রানো রারাকু, ম্যাঙ্গাটেরেভাকা ও কাটিকি। ১৬০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই দ্বীপে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য আগ্নেয়শিলা। এই আগ্নেয়শিলাগুলো থেকেই তৈরী হয়েছে দৈত্যাকৃতির সেসব অদ্ভূত পাহারাদার মূর্তিগুলো।

তীরে দাঁড়িয়ে থাকা মূর্তি ছাড়াও পুরো দ্বীপে এই ধরনের মূর্তির সংখ্যা প্রায় এক হাজারের কাছাকাছি। ১৪ টন থেকে ২০০ টন ওজনের এসব মূর্তিগুলোর প্রতিটিই তৈরী করা হয়েছে আস্ত শিলা থেকে। কি অবাক কান্ড! সবচেয়ে বড় বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, মূর্তিগুলো স্থানান্তর মোটেও কোনো সহজ কাজ হবার কথা নয়। তবে কেমন করে স্থানান্তর করা হয়েছে প্রায় দুটো হাতির সমান ওজনের মূর্তিগুলোকে, কেমন করে বসানো হয়েছে জায়গামতো? অনেকে তো একে মানুষের কাজ বলেই মনে করেন না। এ যেনো গ্রহান্তরের কোনো এলিয়েনের কারবার! তবে গবেষণার মাধ্যমে এই সিদ্ধান্তেই পৌঁছানো গেছে যে, মূর্তিগুলো এখানকার রাপা নুই অধিবাসীদের হাতেই ১২৫০ থেকে ১৫০০ সালের মধ্যে তৈরী হয়েছে। সত্যি, রাপা নুইদের অদ্ভূত সক্ষমতা ও শৈল্পিক দক্ষতা দেখে অবাক হতেই হয়!

মোয়াইয়ের পেট্রোগ্লিফ

একটি খননকৃত মোয়াইয়ের পিছনে পেট্রোগ্লিফ, Photo Credit: Wikipedia

ইস্টার দ্বীপে ‘আহু’ নামের পাথরের সংখ্যা প্রায় তিনশো। মূর্তিগুলো তৈরী করবার পর এই ‘আহু’ নামের পাথরে বসানো হতো। মূর্তিগুলোর মাথা শরীরের অন্য অংশের তুলনায় আয়তনে অনেক বড় এবং দাঁড়ানো মূর্তিগুলোর শরীরের বেশিরভাগ অংশই মাটির নিচে পোঁতা থাকতো। বড় চিবুক, প্রশস্ত নাক ও আয়তক্ষেত্রাকার কানের এই বিশাল মূর্তিগুলোকে ‘মোয়াই’ বলে ডাকা হয়। ধারণা করা হয়, বেশিরভাগ মৃতের স্মৃতি রক্ষার্থেই তৈরী করা হতো এদেরকে। তবে আরেকটি প্রচলিত ধারণা হচ্ছে, স্বচ্ছ পানির উৎস চিহ্নিত করার উদ্দেশ্যেই তৈরী করা হতো মোয়াই।

মোয়াই মূর্তিগুলো সাধারণত উচ্চতায় এক থেকে একুশ মিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে। কোনো কোনো মূর্তির মাথায় আবার লম্বা চূড়াও বসানো থাকে। রনো রারাকুর খাদের মধ্যে এই মূর্তিগুলো তৈরীতে ব্যবহৃত অসংখ্য যন্ত্রপাতি পাওয়া গিয়েছে। সেই সাথে মিলেছে প্রায় ৩৯৪টি অসম্পূর্ণ মূর্তি। অসম্পূর্ণ মূর্তিগুলোর সবগুলোই শোয়ানো অবস্থায় পাওয়া গিয়েছে। এ থেকে ধারণা করা যায় যে, মূর্তিগুলো শোয়ানো অবস্থাতেই তৈরী করা হতো। হিবিস্কাস জাতীয় উদ্ভিদের আঁশ থেকে তৈরী দড়ির মাধ্যমে মূর্তিগুলোকে বেঁধে খাদ থেকে নিচে নামানো হতো। পাহাড়ের গায়ে খাদের উপরের দিকে এক মিটার গভীরতার অনেকগুলো ছিদ্র পাওয়া গিয়েছে যেগুলো নিচ দিয়ে পরস্পরের সাথে যুক্ত। ধারণা করা হয়, দড়ি বাঁধার কাজেই এই ছিদ্রগুলো ব্যবহার করা হতো। তবে উইলিয়াম মুলয় মনে করেন, বিশেষভাবে তৈরী স্লেজ-জাতীয় এক গাড়ির মাধ্যমেই স্থানান্তর করা হতো এই মোয়াই মূর্তিগুলোকে।

রানো রারাকু মোয়াই

রনো রারাকুতে পাহাড়ের ধারে মোয়াই সেট, Photo Credit: Wikipedia

উপকূলের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকা মোয়াই মূর্তিগুলো দেখলে মনে হয় যেনো অতন্দ্র প্রহরীর মতো তারা নজর রাখছে বহিঃশক্তির ওপর। তবে ইস্টার দ্বীপ খুঁজে পেতে সবচেয়ে বড় সহায়ক কিন্তু এই মূর্তিগুলোই। বিভিন্ন আকৃতির মোয়াই মূর্তিগুলো দেখে এটাও ধারণা করা হয় যে, রাপা নুইদের সংস্কৃতিতে হয়তো এই ধরনের মূর্তি তৈরীর প্রতিযোগিতা প্রচলিত ছিলো।

বর্তমানে ইস্টার দ্বীপে প্রায় ১৬০০ আদিবাসীর বাস, যারা এই দ্বীপটিকে ‘তে পিতো ওতে হনুয়া’ নামেই পরিচিত করে। এই নামের অর্থ হলো, ‘পৃথিবীর নাভিমূল’। অর্থাৎ তারা দ্বীপটিকে পৃথিবীর উৎপত্তিস্থল বলেই জ্ঞান করে। রেগেভিন ছাড়াও আরো বহু প্রত্নতত্ত্ববিদ ও গবেষক বিভিন্ন সময়ে পাড়ি দিয়েছেন ইস্টার দ্বীপের উদ্দেশ্যে। এদের মধ্যে ১৭৭০ সালে আসা স্পেনীয় নাবিক ফিলিপ গঞ্জালেস, ১৭৮৬ সালে আসা ফরাসি অ্যাডমিরাল জা ফ্রাসোয়া লা পেরোজ এবং ১৯৫৬ সালে আসা নরওয়ের প্রখ্যাত প্রত্নতাত্ত্বিক থর হেয়ারডল উল্লেখযোগ্য। ইস্টার দ্বীপ সম্পর্কে বেশিরভাগ তথ্য উন্মোচনে থর হেয়ারডলের অবদান অপরিসীম।

রেফারেন্সঃ