পবিত্র কোরান শরীফের বই রাখবার জন্য কাঠের তৈরি ক্ষুদ্র তাক, যার পা দুটি একে অপরকে ক্রস করে ছেদ করে,তাকে ইসলাম দুনিয়ায় রেহেল বলা হয়।মসজিদ, মাদ্রাসা বা বাড়িতে মুসলিমরা পবিত্র কোরান পাঠ করবার জন্য রেহেল ব্যবহার করেন। আবার মাদ্রাসায় পড়ুয়াদের কোরান শরীফ পড়বার জন্য প্রত্যেকেই একটি করে রেহেল নিয়ে যাওয়া বাধ্যতামূলক।মরুভূমিতে কোরান শরীফ পাঠ করবার জন্য যাযাবর আরবরা রেহেল ব্যবহার করতেন।পরবর্তীসময়ে মুসলিম সুলতান বা অভিজাত আমিররা ব্যক্তিগতভাবে কোরান শরীফ পাঠ করবার জন্য ব্রোঞ্জের তৈরি রেহেল ব্যবহার করা শুরু করেন। টার্কোয়েজ পাথর খচিত ঐ সব রেহেলে অলঙ্করণের জন্য আরবিয় অ্যারাবেস্ক ও নসখ লিপিতে লেখাঙ্কন খোদাই করা হতো। আহমদনগরের সুলতান দ্বিতীয় হুসেন শাহের ব্যবহৃত ওরকমই একটি রেহেলর সন্ধান পাওয়া যায়। রেহেলটিতে সুলতানের নাম খোদাই করা আছে।বিশিষ্ট শিল্প ঐতিহাসিক স্টুয়ার্ট ক্যারি ওয়েল্চ মনে করেছিলেন, দাক্ষিণাত্যে মুসলিম শাসকদের ব্যক্তিগত ব্যবহৃত প্রাপ্ত বস্তুর মধ্যে ধাতুর তৈরি ঐ রেহেলটিই হলো প্রথম অলঙ্কৃত শিল্পনিদর্শন। সম্ভবত ১৫৮৮ সাল থেকে ১৫৮৯ সালের মধ্যে সুলতানের জন্য আহমদনগরে ঐ রেহেলটি তৈরি করা হয়েছিল। বর্তমানে লন্ডনে জনৈক মিয়াঁ বশির ওয়ালী মোহাম্মদের বাক্তিগত সংগ্রহশালায় রেহেলটি সংরক্ষিত আছে বলে শোনা যায়।
ষোড়শ শতাব্দীর শেষভাগে ডেকানি চিত্রকলার সংক্ষিপ্ততম এবং সবচেয়ে রহস্যময় পর্বটি দেখা গিয়েছিল নিজামশাহী দরবারে।নিজামশাহী দরবারে চিত্রকলার চর্চা মাত্র তিন দশকের জন্য স্থায়ী হয়।তাই চিত্র বিশেষজ্ঞরা নিজামশাহী দরবারের চিত্রকলাকে সবচেয়ে সংক্ষিপ্তম সময়ের বলেই মনে করেন।তবে তাঁদের শাহী তসবিরখানায় কবে কখন চিত্রকলার চর্চা শুরু হয়েছিল বা কোথা থেকে চিত্রশিল্পীরা তাঁদের দরবারে প্রবেশ করেছিলেন,এ বিষয়ে বিশদে কিছুই জানা যায় না।তাই আহমদনগরের চিত্রচর্চা ডেকান কলমে এক রহস্যময় অধ্যায় হয়েই চিহ্নিত হয়ে আছে।বিজয়নগর রাজ্যের পতনের পর ঐ রাজ্যের শিল্পীরাও হয়তো-বা তাঁদের তসবিরখানায় আশ্রয় নিয়েছিলেন।ডেকানি চিত্রকলায় নিজামশাহী চিত্রকরদের নাম জানতে পারা যায়-না।তাই নিজামশাহদের চিত্রচর্চায়, যে সব সংগ্রহশালায় চিত্রগুলো রাখা আছে সেই সংগ্রহশালার নাম থেকেই চিত্রকরদের নামকরণ করা হয়।আমরাও আমাদের আলোচনায় সেই পদ্ধতি(বেরেনসন পরিভাষা) অনুসরণ করেছি।
আষাঢ় শ্রাবনে হয়তো শাহী তসবিরখানায় কোনো এক অদৃশ্য চিত্রকর এসে ঐ সব ছবি এঁকেছিলেন।রহস্যময় ঘোমটা দেওয়া আহমদনগরের চিত্ররীতির জগৎ আমাকে এক রূপকথা রাজ্যের জানান দেয়।আমার কল্পনা পাখির ডানায় ভর করে আকাশকে ছুঁতে চায়।নিজের মনে কাঠকয়লা কিংবা পেন্সিল দিয়ে আমি সেই সব শিল্পসৃষ্টির বহিঃরেখা স্পষ্ট করে আঁকি। চৈত্র মাসে মেঘ দেখতে দেখতে যেমন সারা আকাশ মেঘে ঢেকে যায়, তেমনই আহমদনগরের চিত্রচর্চায় হতাশা হয়ে ওঠে চৈত্র মাসের আকাশের মতো।আর না পাওয়ার দুঃখ হয়ে ওঠে সুমুদ্রের মতো।এ যেন মন মরা দিন।মন মরা টিপটিপে বৃষ্টি। ব্যর্থতার মস্ত কালো রাত।নিজামশাহী চিত্রশালার প্রাচীন বাড়িটা আজ ভগ্ন। স্বপ্নে দেখি, নিচের ঘরগুলো মাটিতে ডুবে বসে গেছে …শেয়াল সাপেদের আবাসস্থল। উপরে উঠবার সিঁড়ির ধাপ আজ আর দেখতে পাওয়া যায় না। যেন এক ভুতুড়ে বাড়ি!ভোরবেলা, পুবের জানলা দিয়ে একফালি কমলা রঙের আলো এসে পড়ে সেই বাড়িতে।কানে ভেসে আসে হাফিজের দিওয়ান…
‘…আমি কি জানি কি আমার লক্ষ্য
পথের শেষ কোনখানে
দূরাগত এক ঘন্টা ধ্বনি তবু অবিরাম
ভেসে আসে কানে…’
-আর আমি বাতাসের গায়ে পালকের মতো উড়তে থাকি। দূর আকাশে দুরন্ত মেঘের মতো ভেসে বেড়াই।
আহমদনগরের দরবারে আঁকা যে তিনটি পুঁথিচিত্রের সন্ধান পাওয়া যায় তা সবই ডেকানি কলমে ধ্রুপদী রীতি প্রবেশ করবার আগেই আঁকা হয়েছিল। ঐ তিনটি পুঁথিচিত্রের মধ্যে প্রতিকৃতি চিত্রে চিত্রকর যে অসাধারণ শক্তি ও আবেগ ফুটিয়ে তুলেছিলেন তা ভারতীয় চিত্রকলায় সূক্ষ্ণভাবে আঁকা মুষ্টিমেয় চিত্রের মধ্যে এক আলাদা শ্রেণীতে অবস্থান করে। শুধু তাই নয়, শিল্পীরা ঐ সব প্রতিকৃতি চিত্রে পোশাক ও শৈলীতে যে স্বকীয়তার পরিচয় দিয়েছিলেন, তা ছিল তাঁদের দক্ষ অভিব্যক্তিরই প্রকাশ।
১৫১০ সালে প্রথম আহমেদ বাহিরীর হাত ধরে আহমদনগরকে কেন্দ্র করে যে নিজামশাহী সুলতান বংশের পথ চলা শুরু হয়েছিল, ১৬০০ সালে মুঘলদের হাতে সেই পথ চলা রুদ্ধ হয়ে যায়। মাত্র নব্বই বছরের মধ্যে নিজামশাহী তসবিরখানায় যে চিত্ররীতির ঐতিহ্য গড়ে উঠেছিল,ঐ তিনটি পুঁথিচিত্র ছিল সেই শৈল্পিক উজ্জ্বলতার ঝলক। তাই চিত্র বিশেষজ্ঞরা,টিকে থাকা মাত্র ঐ তিনটি চিত্র ছাড়াও আহমদনগরের চিত্রশালার ঐতিহ্য যে আরও গভীরে প্রসারিত হয়েছিল তা দ্ব্যর্থহীনভাবে স্বীকার করে নেন। যদিও কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ মনে করেন, আহমদনগরে বেড়ে ওঠা চিত্রশালার ঐতিহ্য মুঘল তসবিরখানার প্রভাবেই প্রকাশিত হয়েছিল।
নিজামশাহী চিত্রকলা মূলত সুলতান প্রথম হুসেইন নিজামশাহ (১৫৫৩-৬৫) এবং তাঁর পুত্র প্রথম মুর্তজা নিজামশাহ (১৫৬৫-৮৮) ও দ্বিতীয় বুরহান নিজামশাহের (১৫৯১-৯৫) রাজানুগ্রহে বেড়ে উঠেছিল। আহমদনগরের নিজামশাহী দরবারে আঁকা যে ছবিটি বর্তমানে মহারাষ্ট্র রাজ্যের পুণা শহরে অবস্থিত ‘ভারত ইতিহাস সংশোধক মন্ডলে’র গ্রন্থাগারে দেখতে পাওয়া যায় তা, প্রথম হুসেইন নিজামশাহ’র সময়েই আঁকা হয়েছিল।নিজামশাহ সুলতানি’র বিবরণী লেখক আফতাবী, ফারসি ভাষায় রচনা করেছিলেন, ‘তারিফ-ই-হুসেইনশাহী’ নামক জীবনীমূলক গীতিকাব্য,ঐ চিত্রটি এই পুঁথিকে অলঙ্কৃত করবার জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল।
১৫৫৮ সালে বিজাপুরের সুলতান প্রথম আলী আদিলশাহ (১৫৫৮-৮০)আহমদনগর আক্রমণ করবেন বলে মনস্থির করলেন। তিনি তৎকালীন বিজয়নগরের রাজা তিরুমালা দেবরায়ের অভিভাবক রামরায়ের কাছে সাহায্য চাইলেন।রামরায়ের স্ত্রীর দত্তক পুত্র ছিলেন বিজাপুরের সুলতান প্রথম আলী আদিলশাহ। তাই রামরায় প্রথম আলী আদিলশাহকে সমর্থন জানালেন এবং ১৫৫৯ সালে ঐ মৈত্রী শক্তি আহমদনগর দুর্গ অবরোধ করলো।স্বতঃস্ফূর্তভাবে না হলেও গোলকুণ্ডার সুলতান ইব্রাহিম কুতুবশাহও (১৫৫০-৮০) আহমদনগরের ঐ বিরোধী শক্তিতে যোগ দিয়েছিলেন।
সুলতান প্রথম হুসেইন নিজামশাহ বেরারের ইমাদশাহী বংশের শাহাজাদীকে বিবাহ করেছিলেন,তাই ইমাদশাহী সুলতান, প্রথম হুসেইনকে সাহায্য করবার জন্য এগিয়ে এলেন।ইমাদশাহী দরবারের সেনা অধিনায়কের সমস্ত প্রতিরোধ ব্যর্থ হলো। রামরায়ের আদেশে বিজয়নগরের সেনাবাহিনী আহমদনগরের বহু মসজিদ ও ইমারত ধ্বংস করে দিলো, এমনকি মুসলিম মহিলারাও তাঁদের হাত থেকে ছাড় পেলেন-না। অবশেষে ১৫৬১ সালে বাধ্য হয়ে সুলতান প্রথম হুসেইন ঐ বিরোধী শক্তির কাছে শান্তির প্রস্তাব রাখলেন।ইতিমধ্যে সুলতান প্রথম আলী আদিলশাহ ও রামরায়ের মধ্যে গোপন চুক্তি হয়েছিল যে, নিজামশাহ রাজ্য তাঁদের মধ্যে ভাগ করে নেবেন।তাই সুলতান প্রথম হুসেইনের ঐ শান্তির প্রস্তাব, গ্রহণ করবার বিষয়ে কিছুটা বিলম্বিত হয়েছিল।
অবশেষে রামরায় প্রথম হুসেইনকে শান্তির স্বপক্ষে তিনটি শর্ত দিলেন, সুলতানকে তাঁর রাজ্যের সবচেয়ে উর্বর অঞ্চল বিজাপুরের সুলতান প্রথম আলী আদিলশাহের হাতে তুলে দিতে হবে।দ্বিতীয় শর্তে ছিল ইমাদশাহী দরবারের ঐ সেনাপ্রধানকে মৃত্যুদণ্ড দিতে হবে।তবে তৃতীয় শর্ত ছিল আরও মারাত্মক,সুলতান প্রথম হুসেইনের পক্ষে যা ছিল চূড়ান্ত অপমানকর।রামরায় দাবি করলেন সুলতান প্রথম হুসেইনকে শিবিরে এসে তাঁর হাত থেকে ‘পান-সুপুরি’ গ্রহণ করতে হবে, যা ছিল তৎকালীন দরবারী ঐতিহ্যে নিজের সার্বভৌমত্ব ত্যাগ করে, বিজেতার কাছে বশ্যতা স্বীকার করে নেওয়ার সমান। সুলতান প্রথম হুসেইন নিজামশাহ’র কাছে আর কোনো পথ খোলা ছিল-না, তিনি রামরায়ের তিনটি শর্তই মেনে নিতে বাধ্য হলেন।
নির্দিষ্ট দিনে সুলতান প্রথম হুসেইন রামরায়ের শিবিরে এসে উপস্থিত হলেন।রামরায় স্বয়ং করমর্দন করে সুলতান প্রথম হুসেইনকে তাঁর শিবিরে অভ্যর্থনা জানালেন।তাঁর হাবভাব ছিল, যে তিনি সব শত্রুতা ভুলে যেতে চান।এরপরের দৃশ্যেই এলো সেই নাটকীয় মুহূর্ত, যার নীরব সাক্ষী হয়ে থাকলেন প্রথম হুসেইন নিজামশাহ। বলা যায়,ভারতের ইতিহাসে বিশেষ করে দাক্ষিনাত্যে, ইতিহাসের ক্লাইম্যাক্স রচিত হলো রামরায়ের শিবিরে।রামরায় তাঁর পরিচারককে জল নিয়ে আনতে আদেশ দিলেন। যে হাত দিয়ে তিনি সুলতান প্রথম হুসেইনকে করমর্দন করেছিলেন, সেই হাত তিনি জল দিয়ে ধুয়ে নিলেন।শিবিরে উপস্থিত সবাই চমকে উঠেছিলেন ঐ ঘটনায়। সুলতান প্রথম হুসেইন নিজামশাহ বুঝতে পারলেন অপমানের জ্বালা কি হতে পারে! এখানেই শেষ নয়, রামরায় বললেন,
– যদি তিনি আমার অতিথি না হতেন, যে হাত আমি স্পর্শ করেছি তা কেটে নিয়ে ওঁর গলায় ঝুলিয়ে দিতাম! আহমদনগরের সুলতান প্রথম হুসেইন ভোলেন-নি ঐ অপমান। মূলত তাঁরই উদ্যোগে মুসলিম মৈত্রী শক্তি বিজয়নগরের বিরুদ্ধে একজোট হয়েছিল। বিজয়নগরের হিন্দু সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে দাক্ষিনাত্যে যে ইসলামি মৈত্রী গড়ে উঠেছিল,প্রথম হুসেইন নিজামশাহ ছিলেন তাঁর পুরোধা।১৫৬৫ সালে তালিকোটার যুদ্ধে বিজয়নগরের পতন যখন সুনিশ্চিত,সুলতান প্রথম আলী আদিলশাহ ও গোলকুণ্ডার সুলতান ইব্রাহিম কুতুবশাহের শত অনুরোধ সত্ত্বেও সুলতান প্রথম হুসেইন রামরায়ের শিরোচ্ছেদ করেন। বেরারের সুলতান বুরহান ইমাদশাহ সুযোগ পেলেই নিজামশাহদের সীমায় প্রবেশ করে অবাধে লুঠ-তরাজ ও বিভিন্ন এলাকা দখল করে নিতেন। তাই বুরহান ইমাদশাহকে প্রচ্ছন্ন হুমকি দেওয়ার জন্য সুলতান প্রথম হুসেইন নিজামশাহ রামরায়ের কাটা মুন্ডু তাঁর দরবারে ভেট রূপে পাঠিয়ে ছিলেন।বর্তমানে বিজাপুর শহরের পুরাতাত্ত্বিক সংগ্রশালায় একটি পাথরের কাটা মুণ্ডুর মূর্তি রাখা আছে।যা ইংরেজ আমলে তাজ বাওলি পরিষ্কার করার সময় পাওয়া গিয়েছিল। স্থানীয়রা দাবি করেন সেটিই নাকি, রামরায়ের কাটা মুন্ডু। ১৫৬৫ সালে জানুয়ারি মাসে তালিকোটার যুদ্ধে বিজয়নগরের পতনের পর অবশ্য সুলতান প্রথম হুসেইন মাত্র ছ-মাস বেঁচেছিলেন।
…….(ক্রমশ)