বিশ্বের চিত্রজগতে জার্মান চিত্রকর আলব্রেশ্ট অল্টডর্ফ অথবা ওলন্দাজ চিত্রশিল্পী হেরকুলেস স্যেঘেরস যেমন রহস্যময় শিল্পী বলে পরিচিত তেমনই ফারুখ বেগের আঁকা ছবিও ছিল গূঢ় অর্থপূর্ণ মেজাজে ঢাকা। তাঁর ছবিতে স্তব্ধতার স্পন্দন মূর্ত হয়ে ফুটে ওঠে, চিত্রের স্তব্ধতা শুধু নিজেই প্রাণবন্ত নয়, প্রাণবন্ত করে রাখে ছবির নির্বাক ভাষাকেও।ইংরেজ কবি কোলারিজ বলেছিলেন, পোয়েট্রি ইস দ্য বেস্ট ওয়ার্ডস ইন দ্য বেস্ট অর্ডার… একটা কবিতায় শব্দের স্পন্দন নিয়েই গড়ে ওঠে কবিতার ভাষা। তেমনই ফারুখ বেগের ছবিতে রঙ আর রেখা, সৃষ্টি করে ছবির ভাষা।

ফারুখ বেগ সিরাজ (দক্ষিণমধ্য ইরান) শহরে বাস করতেন এবং পরবর্তীসময়ে ইরানের খোরসান প্রদেশে চলে এসেছিলেন। খোরসান অঞ্চলে তখন শাসন করছিলেন, সাফাভিদ সুলতান ইব্রাহিম মির্জা (১৫৪০-৭৭)। ফারুখ বেগ তাঁর চিত্রশালায় শিল্পী হিসেবে যোগ দেন। সুলতান ইব্রাহিম মির্জা’র তসবিরখানা খোরসান প্রদেশের উত্তর-পূর্ব দিকে মাশহাদ শহরে অবস্থিত ছিল এবং ফারুখ বেগ সেখানেই চিত্রশিল্পী হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন।ধীরে ধীরে ফারুখ বেগ ও তাঁর ভাই শিয়াভুশ,দুজনেই শাহজাদা হামজা মির্জার(১৫৬৬-৮৬) বিশ্বস্ত মুতামিদান (পার্ষদ) হয়ে ওঠেন এবং শাহজাদা হামজা মির্জার আদেশে ফারুখ বেগ তাঁর ব্যক্তিগত চিত্রশালার প্রধান চিত্রকর হন।

ফারসি কবিতায় গুলবাহারের যে খুশবু পাওয়া যায়, মাশহাদ শহরে সুলতান ইব্রাহিম মির্জা’র চিত্রশালায়, শিল্পী মির্জা আলী এবং শেখ মুহাম্মদ, পার্সিয়ান চিত্রকলায় লেখশিল্পের দ্বারা তা প্রকাশ করবার পরীক্ষা প্রথম শুরু করেছিলেন। সুলতানের চিত্রশালায় মুহাম্মদী বলে একজন দক্ষ চিত্রকর ছিলেন।ইসলামিক চিত্রকলায়, তাঁরই হাত ধরে লেখাঙ্কনে ফ্লোরাল মোটিফের শৈলী আরও পরিশীলিত ভাবে প্রকাশ পেয়েছিল।পারস্যের চিত্রকলায়, লেখাঙ্কনে ফ্লোরাল মোটিফের রীতি ব্যবহারের জনক শিল্পী মুহাম্মদী হলেও পরবর্তীকালে শিল্পী রিজা আব্বাসী’র কলম-তুলির ছোঁয়ায় ধীরে ধীরে লেখশিল্পের দ্বারা ফুলকারী নকশা বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। ফারুখ বেগ ছিলেন শিল্পী মুহাম্মদীর যোগ্য সাথী এবং দক্ষতার সাথে তিনি শিল্পী মুহাম্মদীর শৈলীগত বৈশিষ্ট্য রপ্ত করেছিলেন।

ফারুখ বেগ সাফাভিদ শাহজাদা হামজা মির্জার খুব প্রিয় চিত্রকর ছিলেন। হামজা মির্জার শাহী কিতাবখানা ও তসবিরখানার দেখভাল করতেন সাফাভিদ দরবারের তৎকালীন উজীর মির্জা সলমান। ১৫৮৩ সালে তাঁকে ষড়যন্ত্র করে হত্যা করা হয়। সাফাভিদ বংশের অভ্যন্তরীণ দ্বন্ধ ঐ সময়ে তীব্র আকার নেয়, ফারুখ বেগ খোরসান প্রদেশ ত্যাগ করার সিদ্বান্ত নেন।সম্ভবত ১৫৮৪ সাল নাগাদ ফারুখ বেগ মাশহাদ শহর ছেড়ে কাবুলে এসে উপস্থিত হন। কাবুলের শাসক তখন মির্জা মুহাম্মদ হাকিম (১৫৫৩-৮৫)। তিনি ছিলেন মুঘল সম্রাট হুমায়ূনের দ্বিতীয় পুত্র এবং আকবরের সৎ ভাই। মির্জা মুহাম্মদ হাকিম আকবরের থেকে বয়েসে বড় ছিলেন, যদিও দুজনের মধ্যে সম্পর্ক কখনোই মধুর ছিল-না। কাবুলে মির্জা মুহাম্মদ হাকিমের মৃত্যু হলে, ফারুখ বেগ কাবুল শহর ত্যাগ করেন এবং ১৫৮৫ সালে ডিসেম্বর মাসে তিনি ভারতবর্ষে রাওয়ালপিন্ডি শহরে এসে উপস্থিত হন এবং পরবর্তীসময়ে সম্রাট আকবরের ব্যক্তিগত উৎসাহে তিনি দীর্ঘ কয়েক দশক মুঘল চিত্রশালায় নিজেকে সক্রিয় ভাবে যুক্ত রাখেন।

১৫৯৫ সাল থেকে ১৬০০ সালের মধ্যে তিনি সুলতান দ্বিতীয় ইব্রাহিমের আমলে বিজাপুর শহরে এসে উপস্থিত হয়েছিলেন। বিজাপুর দরবারেই তিনি ‘ফারুখ হুসেন’ নামে পরিচিত হন।অবশেষে ১৬০৯ সালে তিনি সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমলে আবার মুঘল চিত্রশালায় যোগদান করেন এবং ১৬১৯ সাল পর্যন্ত তিনি মুঘল শাহী চিত্রশালাতেই নিজেকে সক্রিয় রেখেছিলেন। মুঘল দরবারে পারস্যের শিল্পীদের আনাগোনা সম্রাট শাহজাহান পর্যন্ত বজায় ছিল।মুঘল চিত্রশালায় ফারুখ নামের একাধিক চিত্রশিল্পীর খোঁজ পাওয়া যায়। ফারুখ বেগ, ফারুখ কালমাক, ফারুখ চেলা ইত্যাদি। এঁদের মধ্যে ফারুখ বেগ ছিলেন সবচেয়ে বিখ্যাত, তাঁর পুরো নাম ছিল ফারুখ বেগ মুসাবির। মুঘল কলমের প্রায় পঁয়ত্রিশটি ছবিতে তাঁর স্বাক্ষর পাওয়া যায়।

মনে করা হয়, ফারুখ বেগ একজন গোঁড়া মুসলিম ছিলেন, সম্রাট আকবরের মুক্ত ধর্মচিন্তা তাঁর কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল না।সম্ভবত তাই ১৬০১ সালে তিনি মুঘল দরবার ত্যাগ করেন। আবার বিজাপুরে থাকাকালীন সুলতান দ্বিতীয় ইব্রাহিমের ধর্ম দর্শনও তাঁর পছন্দ হয় নি, তাই তিনি বিজাপুর রাজ্য ত্যাগ করে আবার সম্রাট জাহাঙ্গীরের দরবারে ফিরে এসেছিলেন।

আইরিশ ঔপন্যাসিক ও কবি স্যামুয়েল বেকেট বলেছিলেন, ‘বিশৃঙ্খল কর্মপদ্ধতির মধ্যে সঠিক সামঞ্জস্যপূর্ণ ফর্ম খুঁজে পাওয়াই একজন শিল্পীর কাজ’। প্রত্যেক সার্থক সৃষ্টির ভিতরে একটা সমগ্রতা আছে আর আছে শিল্পগত উৎকর্ষতা। চিত্রে রস যেমন গুরুত্বপূর্ণ রূপও তেমনই।রসের উপর মনোযোগ দিতে গিয়ে রূপকে অবহেলা করা যায়-না। আবার চিত্রে রূপও যেন সর্বস্ব না হয়ে ওঠে। ফারুখ বেগ তাঁর ছবিতে সঠিক সামঞ্জস্যপূর্ণ ফর্ম খুঁজে পাওয়ার জন্য রূপকে যেমন গুরুত্ব দিয়েছিলেন তেমনই তাঁর ছবিতে রসও ছিল গুরুত্বপূর্ণ।তাই তাঁর ছবি জুড়ে ফুটে থাকে প্রশান্তির আশ্বাস।যেন রবীন্দ্রনাথের অক্ষরেরা তাঁর ছবিতে ফুল হয়ে ফুটে ওঠে …

‘একাকী গায়কের নহে তো গান,মিলিতে হবে দুই জনে-

গাহিবে একজন খুলিয়া গলা,আরেক জন গাবে মনে…।’

(আয়ারল্যান্ডে ডাবলিন শহরে চেস্টার ব্যাটটি গ্রন্থাগারের সংগ্রহশালায় যে ছবিটি রাখা আছে তার নাম ‘যোগিনী’ আবার বার্লিন শহরে ইসলামিসচেস যাদুঘরে রাখা ‘সিয়েস্তা’ ও ‘তপস্বীর পরিদর্শনে আসা যোগিনী’ এবং ইস্তানবুল শহরে তোপকাকি প্রাসাদের চিত্র সংগ্রহশালায় রাখা ‘চুম্বনে’র চিত্র এবং ওয়াশিংটন শহরে আর্ট ফ্রি গ্যালারীতে রাখা আছে ‘ম্যাডোনা ও শিশু’)