শামস-উদদীন মোহাম্মদ হাফিজ-ই-শিরাজী, পারস্যের একজন সুফি কবি, কিন্তু তাঁর কবিতায় হাফিজ নামটি ব্যাবহার করেন। যারা সম্পূর্ণ কোরান মুখস্থ করতে পারেন, তাঁদেরকে আরবি ভাষায় “হাফিজ” এবং ফার্সি ভাষায় “হফেজ” বলা হয়। তাঁর জীবনী-লেখকগণও বলেন, হাফিজ পুরা কোরান মুখস্থ করেছিলেন। তিনি ছিলেন শিরাজ শহরের একজন হাফেজ, একারনেই তাঁর নামের শেষে হাফিজ-ই-শিরাজী যোগ করা হয়, আসলে তাঁর নাম ছিলো শামস-উদদীন মোহাম্মদ। জানা যায়, কুরআন মুখস্থ ও কুরআনের জ্ঞানে সমৃদ্ধ হওয়ার কারণেই অবশেষে ‘খাজা হাফিজ’ নামে তিনি অভিহিত হয়েছিলেন। তাঁর কাব্যের ছত্রে ছত্রে এই কুরআনের প্রভাব প্রতিফলিত হয়েছে।তিনি নিজেই এ ব্যাপারে উল্লেখ করেছেন —
‘’হে হাফিজ! তোমার বক্ষে ধারণকৃত এই কুরআনের চেয়ে
সুন্দর ও সুমিষ্ট বাণী আর কিছুই দেখি নি’’।
পারস্যে কবি হাফিজকে লোকে আদর করে ‘বুলবুলে শিরাজ’ অর্থাৎ শিরাজের বুলবুল বলে আখ্যায়িত করে থাকেন। তারা হাফিজকে লেসানুল গায়েব (অজ্ঞাতের বাণী), তরজমানুল আসরার (রহস্যের মর্ম সন্ধানী) প্রভৃতি বিশষনে বিশেষিত করে থাকেন। শিরাজ শহরে কবি হাফিজ শিরাজী মোসল্লা নামে পরিচিত একটি জায়গায় চতুর্দশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে জন্মগ্রহণ করেন। পারস্যের নিশাপুর ( ওমর খৈয়ামের জন্মস্থান) ছাড়া আর কোন নগরই শিরাজের মত বিশ্বজোড়া খ্যাতি লাভ করেনি। ইরানের প্রায় সমস্ত শ্রেষ্ঠ কবিরই তীর্থভূমি এই শিরাজ নগরী।
হাফিজের বাবা বাহাউদ্দীন ইসপাহান নগরী থেকে ব্যবসা উপলক্ষে শিরাজে এসে বসবাস করেন। তিনি ব্যবসায়ে বেশ সমৃদ্ধিও লাভ করেন, কিন্তু মৃত্যুকালে সমস্ত ব্যবসায় এমন গোলমালে জড়িয়ে রেখে যান যে শিশু হাফিজ ও তাঁর মা ঐশ্বর্যের কোল থেকে একেবারে চরম দারিদ্র্যের মধ্যে পড়েন। তাঁর দুই ভাই, যারা তাঁর চেয়ে বয়সে বড় এবং বয়ঃপ্রাপ্তির পর তারা শিরাজ ত্যাগ করে অন্য জায়গায় চলে যায়। বাধ্য হয়ে তখন হাফিজকে তখন মাথার ঘাম পায়ে ফেলে অর্থোপার্জনে নামতে হয়।
প্রসিদ্ধ ইরানি লেখক ও সাহিত্যিক আব্দুন্নবী তাঁর ‘মেয়খানে’ নামক গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন— হাফিজ স্থানীয় একটি রুটির দোকানে কাজ করতেন আর এখান থেকে পাওয়া অর্থ দিয়েই দিনযাপন করতেন। এই রুটির দোকানের পাশেই একটি বিদ্যালয় ছিল যেখানে কাওয়াম উদ্দিন আবদুল্লাহ (মৃত্যু ৭৭২ হি.) নামে একজন প্রসিদ্ধ আলেম শিক্ষা দান করতেন। হাফিজ রুটির দোকানে কাজ করার ফাঁকে ফাঁকে তাঁর কাছ থেকে বিদ্যার্জন করতেন। শুধু প্রাথমিক শিক্ষাই নয়, বরং কুরআন পাঠ করা থেকে কুরআনের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ ও দর্শনশাস্ত্রেরও জ্ঞান অর্জন করেন। এরপর ধীরে ধীরে ইসলামের বিধি-বিধান ও সাহিত্যের জ্ঞান নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করতে শুরু করেন। যেহেতু সেকালে সাহিত্যের জ্ঞান শরীয়তের জ্ঞান লাভের পটভূমি ছিল, সেহেতু তিনি ধর্মীয় জ্ঞানেও প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জন করেন। হাফিজের যুগে শিরাজ ছিলো ধর্মীয় জ্ঞান ও কবি-সাহিত্যিকদের আবাসভূমি। এই বিষয়টি তাঁর শিক্ষা-দীক্ষা ও জ্ঞানার্জনে বিস্ময়কর প্রভাব বিস্তার করে।
এখানে হাফিজের প্রাথমিক জীবনে পিতৃহীনতা, মা’সহ দারিদ্রতার মধ্যে দিন কাটানো, রুটির দোকানে কাজ নেয়া, নিজ উদ্যোগে পড়াশুনা করা সবই হুবহু বিদ্রোহী কবি কাজি নজরুল ইসলামের সঙ্গে মিলে যায়।
হাফিজ দীর্ঘ চল্লিশ বছর পর্যন্ত জ্ঞান সাধনা করেছেন যা তাঁর নিজের গজল থেকে উদ্ধৃত করা —
‘’দীর্ঘ চল্লিশ বছরের সাধনায় আমার অন্তরে
যে জ্ঞান-বৈশিষ্ট্য সঞ্চিত হয়েছে,
ভয় হয়, না জানি প্রেয়সীর চোখের চাহনি
তা হরণ করে নিয়ে যায়’’।
কাব্যচর্চার পাশাপাশি তাঁর এই জ্ঞানচর্চা নিছক কোনো বৈষয়িক জ্ঞান ছিল না। অধিকন্তু ক্ষেত্রে তা ছিল অধ্যাত্ম বা পরমার্থ জ্ঞান। তবে এই আধ্যাত্মিক সাধনার ক্ষেত্রে হাফিজ মুরশিদের আবশ্যকতা উপলব্ধি করেছেন বিধায় তিনি বাহাউদ্দিন নকশেবন্দীসহ একাধিক প্রসিদ্ধ সুফির সংস্পর্শে সময় ব্যয় করেছেন। এ ব্যাপারে হাফিজের মত হচ্ছে, মুর্শিদ ব্যতীত প্রেমের পথে পা বাড়িও না।
‘’তোমার খাঁটি পীর যদি বলে তবে শরাব রং-এ তোমার মুসাল্লা রাঙ্গিয়ে নাও,কেননা, সালেক মানযিলের পথ-পদ্ধতি সম্পর্কে সম্যক অবগত।’
হাফিজ সম্বন্ধে বিশ্ববিজয়ী বীর তৈমুরকে নিয়ে একটি গল্প প্রচলিত আছে। হাফিজের কবিতার এই দুটি চরণ ততদিনে জগতবিখ্যাত হয়ে গেছে –
‘’প্রাণ যদি মোর দেয় ফিরিয়ে তুর্কী সওয়ার মনচোরা
প্রিয়ার মোহন চাঁদ কপোলের
একটি কালো তিলের লাগি বিলিয়ে দেব সমরকান্দ ও রত্নখচা এ বোখারা’’! (অনুবাদ- নজরুল )
সেই সময় তৈমুরের সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল সমরকন্দ। হাফিজ তাঁর প্রিয়ার গালের তিলের জন্য তৈমুরের সাম্রাজ্যের রাজধানী বিলিয়ে দিতে চান শুনে তৈমুর ভীষণ রাগ হয়ে পারস্য জয়ের সময় হাফিজকে ডেকে পাঠান। উপায়ন্তর না দেখে হাফিজ তৈমুরকে বলেন যে তিনি ভুল শুনেছেন, শেষের চরণের “সমরকন্দ ও বোখারা’র” বদলে-
’দো মণ কন্দ ও সি খোর্মারা” হবে। “আমি তার গালের তিলের বদলে দু মণ চিনি ও তিন মণ খেজুর দান করব!” কেউ কেউ বলেন, হাফিজ এই উত্তর দেননি। তিনি নাকি দীর্ঘ কুর্নিশ করে বলেছিলেন, “সম্রাট! আমি আজকাল এই রকমই অমিতব্যয়ী হয়ে পড়েছি!” এই জবাব শুনে তৈমুর এত আনন্দ পান যে, শাস্তি দেয়ার বদলে হাফিজকে তিনি বহুমূল্যবান পুরস্কার দেন। মহাকবি হাফিজ ছিলেন প্রেমরসে ভরপুর একজন কবি। তিনি প্রেমের জন্য কতইনা অমিতব্যয়ী ছিলেন! যেমনটি তিনি প্রিয়ার ঠোঁটের কালো তিলের বিনিময়ে সমরকন্দ ও বোখারা নগরী বিলিয়ে দিতে চেয়েছিলেন।
হাফিজ প্রায় সব কবিতা “শাখ-ই-নবাৎ” নামের কোনো পারস্য সুন্দরীর স্তবগানে মুখরিত। অনেকে বলেন, “শাখ-ই-নবাৎ” হাফিজের দেয়া আদরের নাম। তার আসল নাম তিনি গোপন করে গেছেন। কোন ভাগ্যবতী এই কবির প্রিয়া ছিলেন, কোথায় ছিল তার কুটির, এ নিয়ে অনেকে অনেক জল্পনা-কল্পনা করেছেন। রহস্য-সন্ধানীদের কাছে এই হরিণ-আঁখি সুন্দরী আজো রহস্যের আড়ালে রয়ে গেছেন। হাফিজের গজল অতল গভীর সমুদ্রের মত।যেমন তার বিশালতা তেমনি তার তরঙ্গ লীলা ,দেখে অবাক বিস্ময়ে চেয়ে থাকতে হয়। সমুদ্রের গভীর তলদেশে সন্ধানী ডুবুরী যেমন অজস্র মণিমুক্তার সন্ধান পায় , ঠিক তেমন।
লৌকিক প্রেমের পাশাপাশি তিনি স্বর্গীয় প্রেমকে অত্যন্ত নিপুণভাবে তাঁর কাব্যে ফুটিয়ে তুলেছেন। তবে হাফিজের ভাষায় এ প্রেম কোনো সহজসাধ্য ব্যাপার নয়। প্রেম সলিলে অবগাহন করতে হলে প্রেমিকের জন্য যে অফুরন্ত ও অসীম সাধনার প্রয়োজন রয়েছে তা তাঁর কাব্যে ভাস্বর হয়ে ফুটে উঠেছে।
‘’হায় বধুয়া! দাও পেয়ালা ঢালো শারাব মধুক্ষরা
সহজ ছিল পথটি প্রেমের দেখছি এখন কাঁটা ভরা।
ভেবেছিলাম ভোর বাতাসে কস্তুরী-বাস আসবে ভেসে
বধুর চিকন চিকুর হতে, কলজে হলো ঘায়েল শেষে”।
হাফিজ তাঁর গজল ও রূবাইগুলোতে বিশুদ্ধ প্রেমের মাহাত্ম্য ও খোদাপ্রাপ্তির তথা খোদার নৈকট্য লাভের উপায় বর্ণনা করেছেন। হাফিজের কাব্যে কোথাও ধর্মের ভান বা প্রতারণার অবকাশ নেই। তাঁর মতে খোদার প্রেমে অবগাহন করে যে নিজেকে বিলীন করে দিতে পারে সেই প্রকৃত খোদাপ্রেমিক। ধর্মের নামে প্রতারণা বা ভান করা সম্পর্কে হাফিজ বলেন —
‘’শঠতা ও প্রতারণার আগুন ধর্মের ভান্ডারকে অবশ্যই জ্বালিয়ে ফেলবে,
হে হাফিজ! এ দরবেশি পোশাক পরিত্যাগ করে সামনে অগ্রসর হও’’।
হাফিজ আল্লাহর প্রেমে নিমগ্ন হলেও দেশ, দেশের মাটি ও মানুষকে গভীর অন্তর দিয়ে ভালোবাসতেন। এই ভালোবাসা ছিল যেমনি সনাতন তেমনি নির্বিশেষ। তিনি শিরাজের লোক, শিরাজকে তিনি কীভাবে ভালোবেসেছেন তার নির্দশন আমরা খুঁজে পাই তাঁর কবিতার পরতে পরতে। কবি হাফিজ জীবনভর শিরাজ নগরীর সঙ্গে তাঁর অন্তরকে বেঁধে রেখেছিলেন।
তাঁর সম্বন্ধে একটি কথা প্রচলিত আছে ‘’বাবা-কুহী” নামে শিরাজের উত্তরে পর্বতের উপরকার এক দরগায় ইমাম আলি নামে এক দরবেশের সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। সেদিন “বাবা-কুহী”তে রাতভর ধর্মোৎসব চলছিল, হাফিজও ঐ উৎসবে যোগ দিতে গিয়েছিলেন। ইমাম আলি তাঁকে রহস্যময় কোন ঐশী খাবার খেতে দেন এবং বলেন, এর পরই তিনি কাব্যলক্ষীর রহস্যপুরীর সব ঐশ্বর্যের অধিকারী হবে। এই বিবরণে কতটা কল্পনারস মিশে আছে তা নিশ্চিতভাবে বলা না গেলে এটা সত্য যে হাফিজের সমস্ত জীবনী-লেখকই এই ঘটনার উল্লেখ করেছেন। শুধু উল্লেখ নয়, বিশ্বাসও করেছেন।
১২০৪ খ্রিস্টাব্দে (৭৬৮ হি.) বখতিয়ার খিলজির বাংলায় মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত করেন। সেই থেকে এদেশে ফার্সির প্রচলন হয়। পরে মোঘল আমলে ফার্সি হলো রাজভাষা। সুলতান গিয়াস উদ্দিন আযম ফারসি সাহিত্যের অমর প্রতিভা ইরানের মহাকবি হাফিজকে বাংলা ভ্রমণের জন্য আমন্ত্রণ জানান। কথিত আছে যে, শাহের আমন্ত্রণ পেয়ে মহাকবি হাফিজ বাংলায় আগমনের জন্য যাত্রা করেন, কিন্তু জাহাজে ওঠার আগে সমুদ্রে প্রবল ঝড় উঠলে একে দৈবের অশনিসংকেত ভেবে হাফিজ ফিরে যান। তাঁর আর কখনো বাংলা-ভারত সফর করা সম্ভব হয়নি।
ইরানের কবি হাফিজ আর ওমর খৈয়ামের কবিতা যতজন ‘কবি’ অনুবাদক আছেন তার মধ্যে নজরুল একমাত্র মূল ফারসী থেকে অনুবাদ করেছেন, বাকী সবাই ইংরেজী থেকে অনুবাদ করেছেন। “ফারসী”, ‘’আরবী”তে নজরুল এর জ্ঞান ছিল পাণ্ডিত্যের পর্যায়ে।
কবি নজরুল খুব দুঃসময়ে পুত্রের মৃত্যু শয্যায় বসে ‘রুবাইয়াৎ-ই-হাফিজ’এর অনুবাদ করেন। কতোটা শিষ্যত্ব অর্জন করলে এরকম একটি চরম মুহূর্তে পুত্রের সেবা- শুশ্রুষায় ব্যাস্ত না হয়ে ইরানের বুলবুলকে অনুবাদ করে চলেছেন। তাই কবি যথার্থই বলেন, “যেপথ দিয়ে আমার পুত্রের শবযান চলে গেল, সেপথ দিয়েই এলেন তাঁর প্রিয়তম ইরানী কবি হাফিজ।’
‘রুবাইয়াৎ-ই-হাফিজ’ অনুবাদ কাব্যের উৎসর্গপত্রে কবি লিখেছেন-
“বাবা বুলবুল!
তোমার মৃত্যু-শিয়রে বসে ‘বুলবুল-ই-শিরাজ’
হাফিজের রুবাইয়াতের অনুবাদ আরম্ভ করি। যেদিন অনুবাদ শেষ করে উঠলাম, সেদিন তুমি আমার
কাননের বুলবুলি উড়ে গেছ। যে দেশে গেছ তুমি,
সে বুলবুলিস্তান কি ইরানের চেয়েও সুন্দর?
জানি না তুমি কোথায়! যে লোকেই থাক, তোমার
শোক-সন্তপ্ত পিতার এই শেষ দান শেষ চুম্বন বলে গ্রহণ করো।
তোমার চার বছরের কচি গলায় যে সুর শিখে গেলে,
তা ইরানের বুলবুলিকেও বিস্ময়ান্বিত করে তুলবে।
শিরাজের বুলবুল কবি হাফিজের কথাতেই
তোমাকে স্মরণ করি—
‘সোনার তাবিজ রূপার সেলেট
মানাত না বুকে রে যার,
পাথর চাপা দিল বিধি
হায়, কবরের শিয়রে তার।”
হাফিজের মৃত্যু সম্বন্ধে একটি বিস্ময়কর গল্প শোনা যায়। শিবলী নোমানী, ব্রাউন সাহেব প্রভৃতি পারস্য-সাহিত্যের সব অভিজ্ঞ সমালোচকই এই ঘটনার উলেখ করেছেন। হাফিজের মৃত্যুর পর একদল লোক তাঁর ‘জানাজা’ পড়তে ও কবর দিতে রাজি হচ্ছিলোনা।হাফিজের ভক্তদলের সাথে এটা নিয়ে তাদের বিবাদ-বিসম্বাদের সৃষ্টি হলে কয়েক জনের মধ্যস্থতায় দুই দলের মধ্যে এই শর্তে রফা হয় যে, হাফিজের সমস্ত কবিতা একসাথে করে একজন লোক কবিতাগুলির থেকে যে কোনো জায়গা খুলবে, সেই পৃষ্ঠার প্রথম দুই লাইন কবিতা পড়ে হাফিজের কি ধর্ম ছিল সেটা ধরে নেওয়া হবে। আশ্চর্যের বিষয়, এইভাবে খোলার পর যে দুই লাইন কবিতা পাওয়া গিয়াছিল, সেটা এরকম——-
“কদমে দরিগ মদার আজ জানাজায়ে হাফিজ,
কে র্গচে গর কে গোনাহস্ত মি রওদ বেহেস্ত।”
“হাফিজের এই শব হতে গো তুলো না কো চরণ প্রভু
যদিও সে মগ্ন পাপে বেহেশতে সে যাবে তবু।”
এরপর দুই দল মিলে মহাসমারোহে হাফিজকে এক আঙুর-বাগানে সমাহিত করেন।
ড. আহমাদ তামীমদারী মহাকবি হাফিজের কাব্যের বিষয়বস্তু সম্পর্কে বলেছেন, “তিনি সাধারণত কপট ও বকধার্মিক, নিষ্ঠুর শাষক ও প্রতিদ্বন্দ্বীদের ওপর ব্যাঙ্গাত্নক ভাষায় আক্রমণ করতেন।(তারিক জিয়াউর রহমান সিরাজী ও মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী অনূদিত)।
‘ফার্সী সাহিত্যের ইতিহাস’ বইয়ে ১৯১ নং পৃষ্ঠায় হাফিজের গজল সম্পর্কে আরো বলা হয়েছে, “ভন্ড-তাপস ও জালিম বাদশাহদের বিরুদ্ধে কবিতার খড়গ চালিয়েছেন।”
হাফিজ যখন বেঁচে ছিলেন, তখন তাঁর কবিতাগুলি (দীওয়ান) সংগ্রহ করে রেখে যাননি। তাঁর বন্ধু গুল-আন্দামই সর্বপ্রথম তাঁর মৃত্যুর পর “দীওয়ান” আকারে হাফিজের সমস্ত কবিতা সংগ্রহ করেন। হাফিজের পাঁচশোর ও বেশি কবিতা পাওয়া গিয়েছে, তাছাড়া তাঁর অনেক কবিতা হারিয়েও গেছে, বা তিনি সংগ্রহ করতে পারেননি।
‘নজরুলের অনুবাদে ‘রুবাইয়াৎ-ই-হাফিজে’ মোট ৭৩টি রুবাই মুদ্রিত হয়েছে। গ্রন্থের মুখবন্ধে রয়েছে আরো ২টি রুবাইর অনুবাদ। তার মধ্যে একটি——
‘তোমার পথে মোর চেয়ে কেউ
সর্বহারা নাইকো, প্রিয়!
আমার চেয়ে তোমার কাছে
নাই সখি, কেউ অনাত্মীয়।
তোমার বেণীর শৃঙ্খলে গো
নিত্য আমি বন্দী কেন? —
মোর চেয়ে কেউ হয়নি পাগল
পিয়ে তোমার প্রেম-অমিয়।।’
শতাব্দীর পর শতাব্দী পেরিয়ে তাঁকে জেনেছিলেন আমাদের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বালক বেলায় তাঁর পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মুখে দক্ষিণের বারান্দার সান্ধ্য অন্ধকারে সুরসহ নির্ভুল ফারসি আবৃত্তি শুনে।
পরিণত বয়সে ইরানে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ হাফিজের সমাধির পাশে যান, বিবরণে তিনি লেখেন-
এই সমাধির পাশে বসে আমার মনের মধ্যে একটা চমক এসে পৌঁছল,এখানকার এই বসন্তপ্রভাতে সূর্যের আলোতে দূরকালের বসন্তদিন থেকে কবির হাস্যোজ্জ্বল চোখের সংকেত। মনে হল আমরা দুজনে একই পানশালার বন্ধু, অনেকবার অনেক রসের অনেক পেয়ালা ভরতি করেছি। আমি তো কতবার দেখেছি আচারনিষ্ঠ ধার্মিকদের কুটিল ভ্রুকুটি। তাদের বচনজালে আমাকে বাঁধতে পারে নি, আমি পলাতক, ছুটি নিয়েছি অবাধ প্রবাহিত আনন্দের হাওয়ায়। নিশ্চিত মনে হল আজ, কত-শত বৎসর পরে জীবনমৃত্যুর ব্যবধান পেরিয়ে এই কবরের পাশে এমন একজন মুসাফির এসেছে যে-মানুষ হাফেজের চিরকালের জানা লোক।
নজরুল লিখছেন—-
হাফিজকে আমরা কাব্যপিপাসুর দল কবি বলেই সম্মান করি, কবিরূপেই দেখি। তিনি হয়ত বা সুফি-দরবেশও ছিলেন।…তবু তাঁর কবিতা শুধু কবিতাই। তাঁর দর্শন আর ওমর খৈয়ামের দর্শন প্রায় এক। এঁরা সকলেই আনন্দ-বিলাসী। ভোগের আনন্দকেই এঁরা জীবনের চরম আনন্দ বলে স্বীকার করেছেন।…তবে, এও মিথ্যা নয় যে, মদিরাকে এঁরা জীবনে না হোক কাব্যে প্রেমের আনন্দের প্রতীকরূপেই গ্রহণ করেছিলেন। শরাব বলতে এঁরা বোঝান, ঈশ্বরের প্রেম, যা মদিরার মতোই মানুষকে উন্মত্ত করে তোলে। সাকি অর্থাৎ যিনি সেই শারাব পান করান। যিনি সেই ঐশ্বরিক প্রেমের দিশারী। পানশালা- সেই ঐশ্বরিক প্রেমের লীলা-নিকেতন।
তথ্য
আব্দুলহাফিজ (১৯৮৪ খ্রি.): হাফিজের গজল গুচ্ছ, বাংলাডেমী ঢাকা।
iranmirrorbd.com
উইকিপিডিয়া