বাংলার আনাচে কানাচে ছড়িয়ে রয়েছে কতো কাহিনী, কতো গল্প l আবহমানকাল ধরেই এই গল্পগুলো লোকমুখে প্রচলিত হয়ে আসছে l বংশপরম্পরায় প্রবাহমান এ কাহিনীগুলো পরবর্তীতে পরিণত হয়েছে রূপকথায়, লোক-কাহিনীতে কিংবা কল্পকাহিনীতে! লাইলি-মজনু, শিরি-ফরহাদ রোমিও -জুলিয়েট এর কাহিনী তো আমাদের আত্মার সাথে যুক্ত হয়ে গিয়েছে l মহুয়া পালাও ঠিক তেমনি একটি লোক-কাহিনী। প্রায় সাড়ে তিনশো বছর আগে কবি দ্বিজ কানাই এ পালাগানটি রচনা করেন, যা বর্তমানে “নদের চাঁদ ও মহুয়া’র” পালা নামে পরিচিত। কবি দ্বিজ কানাই এর লেখা এই পালাগানটি মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের গীতিকা ধারায় একটি উল্লেখযোগ্য সম্পদ। এটি একটি দৃশ্য কাব্য। অনেক ইউরোপীয় পণ্ডিতদের মতে, আমাদের মহুয়া পালার সঙ্গে প্রায় ৪০০ বছর আগের দ্বাদশ শতাব্দীর ইউরোপের কালজয়ী রোমান্স ‘ট্রিস্টান অ্যান্ড ইসল্ড’ কাহিনীর আশ্চর্যজনক মিল রয়েছে। বিভিন্ন সময়, বিভিন্ন ভাষা ও নামে অনূদিত হয়েছে কাহিনীটি (সুনীলের রচনায় ‘সোনালী দুঃখ’) । চলচ্চিত্র নির্মাণও হয়েছে এই গল্প নিয়ে। দুর্ধর্ষ প্রেমকথা ‘ট্রিস্টান অ্যান্ড ইসল্ড’-এর বাংলা সংস্করণ যেনো ‘মহুয়া’!

মহুয়া

মৈমনসিংহ গীতিকার প্রথম খণ্ডে যে ১০টি পালাগান প্রকাশিত হয়েছিলো, তার মধ্যে অন্যতম একটি হলো এই ‘মহুয়া পালা। পালাগানটির প্রধান চরিত্র মহুয়া, তারই নাম অনুসারেই এর নামকরণ করা হয়। মূলতঃ এ পালাগানটির কাহিনী গড়ে উঠেছে অসম কিন্তু দুর্জেয় এক ভালোবাসাকে কেন্দ্র করে…. যেখানে সমস্ত রোমান্টিকতার ওপরে মৃত্যুই ছিলো অবধারিত! দীনেশচন্দ্র সেন মৈমনসিংহ গীতিকার প্রথম খণ্ডে লিখেছেন,

“মহুয়ার প্রেম কী নির্ভীক, কী আনন্দপূর্ণ! শ্রাবণের শতধারার মতো দুঃখ আসলেও মহুয়া তার প্রেমের অমর সুধা পান করে মৃত্যুকে বরণ করে হয়েছে মৃত্যুঞ্জয়ী!”

এক সময় দেশে প্রচুর ডাকাতি হতো l যেমনটা আমরা ছবিতে দেখি, গল্পের বই এ পড়ি….আবার চায়ের আড্ডাতেও অনেক নামকরা ডাকাতির গল্প শুনেছি। ঠিক তেমনি একটি গল্প..’হুমরা ডাকাতের গল্প’ l নিকষ কালো অন্ধকারের মাঝে ডাকাত দলের সর্দার হুমরা তার দলবল নিয়ে হানা দেয় সম্পদশালী এক ব্রাহ্মণের বাড়িতে। লুটপাট চালিয়ে যখনই সবাই বের হতে যাবে… ঠিক তখনই হুমরার চোখ পরলো বৃদ্ধ ব্রাহ্মণের মাত্র ছয় মাস বয়সী মেয়ের উপর, যার স্বর্গীয় সৌন্দর্যের কাছে তার অপহরণকৃত সব ধন-সম্পত্তি নিমিষেই তুচ্ছ হয়ে গেলো। এই দেবশিশুকে অপহরণ করার লোভ জাগলো তার মধ্যে যাকে ফেলে যাবার সামর্থ্য তার নেই, তাই ব্রাহ্মণের চোখ ফাঁকি দিয়ে শিশুটিকে চুরি করে নিয়ে আসে সে!

মৈমনসিংহ গীতিকার ‘মহুয়া’

গারো পাহাড়ের ওপর হিমানী পর্বত….এর উত্তরের সাগর পাড়ে— চাঁদ সূর্যের দখা নেই এমন অন্ধকার ঘেরা গভীর বনে বাস করে ডাকাত সর্দার – হুমরা বেদে। চুরি করে আনা শিশুটি হেসেখেলে হুমরার কাছেই বড় হতে থাকে। এছাড়া মেয়েটিকে আনার পর থেকেই হুমরার মধ্যে অনেক পরিবর্তন চলে আসে…. সে ভালোবাসতে শেখে, এক সময় সে ডাকাতি করাও ছেড়ে দেয়। কিন্তু খাবে কি? জীবিকা উপার্জন করবে কিভাবে? সে তো লেখাপড়া জানতো না। তাই যোগ দেয় বেদের ( Gipsy) দলে । যাযাবর জাতি তারা, জীবিকার তাগিদে এক দেশ থেকে অন্য দেশে ঘুরে বেড়াতে হয় তাদের l সে মেয়ের বয়স এখন ১৬। তার উপচে পড়া রূপ ‘হুমরার অন্ধকার ঘরকে আলোকিত করে রাখে’ ….. তাই পালক বাবা-মা রূপে-গুণে এই অতুলনীয় সুন্দরী মেয়ের নাম রাখে “মহুয়া সুন্দরী”। সম্ভ্রান্ত পরিবারের সেই মেয়ে এখন এই পরিবেশে হয়ে ওঠে বেদের মেয়ে । হুমরা তাকে খেলা শেখায়, বেদের কৌশলও শেখায়… মহুয়াও বাবার সাথে সাপ খেলা দেখায়। শৈশব ছেড়ে কৈশোরে পা রাখে মহুয়া, অসম্ভব সুন্দরী এই মেয়েকে যে দেখে সেই পাগল হয়ে যায়। বামনকান্দা গ্রামের জমিদারের ছেলে দেওয়ান নদের চাঁদ প্রতিদিনের মতোই নিজের বাসাতে সভা বসিয়েছেন সন্ধ্যার খোলা আকাশের নিচে। কিন্তু সভায় তার মন নেই, তাকিয়ে আছেন তারা ভরা আকাশের দিকে। তারই বিশ্বস্ত একজনের কাছে খবর পেয়েছেন এলাকাতে এক বেদের দল এসেছে, দলের সাথে এক অসম্ভব সুন্দরী মেয়েও এসেছে যার তুলনা নাকি বামনকান্দা তো দূরের কথা গোটা জমিদারীতেই নেই। তাই নদের চাঁদ সভাভঙ্গ করে অন্দরমহলে পৌঁছে মায়ের কাছে অনুমতির জন্য l যেহেতু জমিদার খুবই অবস্থাপন্ন ছিলেন তাই সকলের বিনোদনের জন্য তার প্রাসাদে প্রায়ই নাচ গান ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা হতো। তাই মায়ের অনুমতি পেয়ে এবারও অনুষ্ঠানের জন্য আমন্ত্রণ করা হয় হুমরা বেদের দলকে।

বেদের-দল

দাওয়াত পেয়ে হুমরা তার দলবল নিয়ে জমিদারের প্রাসাদে গেলো সাপ খেলা দেখানোর জন্য। রাতে বামনকান্দা গ্রাম ভেঙে পড়লো জমিদারের উঠানে খেলা দেখার জন্য। ৷। নাচ হলো, গান হলো, খেলা হলো, বিশেষ করে মহুয়ার খেলা দেখানোর কৌশল দেখে সবাই মুগ্ধ! অন্যদিকে তাকে দেখা মাত্রই প্রেমে পড়ে যায় নদের চাঁদ…. যাকে বলে “Love at first sight” …… মহুয়াকে দেখার পর থেকে নদের চাঁদ সকাল-দুপুর-রাত কেবল তার কথাই ভাবতে থাকে। কোনো কিছুতই তার আর মন বসে না। সে বুঝে যায় যে, প্রেমে পড়ে গেছে সে। কিন্তু সে রাতের পর থেকে অনেকদিন দেখা নেই মহুয়ার। নদের চাঁদ ভাবে মহুয়া বুঝি তাকে উপেক্ষা করে যাচ্ছে। এক সন্ধ্যায় মহুয়ার পথ আগলে দাঁড়ায় নদের এবং কোনো দ্বিধাবোধ না করেই মহুয়াকে তার প্রেমের কথা জানায়। নদের চাঁদও ছিলো বেশ সুদর্শন যুবক! মহুয়ারও তাকে ভালো লেগে যায় এবং তারা একজন আরেকজনের প্রতি ভালোবাসার বন্ধনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়। বেশ ভালো কাটছিলো তাদের দিন। নদের চাঁদ তাকে চিঠি পাঠাতো আর মহুয়াও সে চিঠির উত্তর দিতো। মাঝেমাঝে মহুয়াকে উদ্দেশ্য করেই রাতে তারার আলোয় বসে বাঁশি বাজাতো চাঁদ আর মহুয়া যেনো সেই বাঁশির সুর দূর থেকে শুনতে পেতো। অপূর্ব এক প্রেমের কেমিস্ট্রি চলছিলো তাদের মাঝে! কিন্তু অসম অবস্থানের প্রেম নিয়ে হুমরা বেদের মনে জেগে ওঠে ভয় আর শঙ্কা। পরিস্থিতি এড়াতে সে গভীর রাতে মহুয়া আর দলবল নিয়ে পালিয়ে যায় গ্রাম থেকে ।

ওদিকে মহুয়ার বিরহে চাঁদ ঠাকুরের পাগল প্রায় অবস্থা । তীর্থের নামে সে বেরিয়ে পড়ে মহুয়ার খোঁজে। বহু দেশ ঘুরে অবশেষে সে দেখা পায় মহুয়ার, কংসাই নদীর পাড়ে। হুমরা এবার চাঁদকে মারার জন্য মহুয়ার হাতে তুলে দেয় বিশলক্ষা ছুরি। বাবার শপথের ওপর জিতে যায় মহুয়ার প্রেম। সে মারতে পারে না চাঁদকে, পালিয়ে যায় তারা। এভাবে কাটে ছয় মাস। তারা এখন বনেই পেতেছে সুখের সংসার। কিন্তু প্রেম যেখানে খরস্রোতা, ভাঙনও সেখানে মারাত্মক। একদিন সে বনেও হাজির হয় যাযাবর হুমরা বেদের দল। এবারও হুমরার সামনে দাঁড়িয়ে মহুয়ার হাতে বিষ লাগানো ছুরি তুলে দেয় চাঁদকে মারার জন্য। কিন্তু মহুয়া তো নদের চাঁদকে সত্যিকারের ভালোবেসেছিলো, সে কি করে মারবে তাকে? তাই ছুরিটি সে নিজের বুকেই গেঁথে দেয় এবং মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়ে। এদিকে নদের চাঁদ নিজের প্রানের চেয়েও প্রিয় প্রিয়তমার এই আত্মত্যাগ সহ্য করতে না পেরে প্রেমের প্রতিদান সরূপ একইভাবে ছুরিটি তার বুকেও গেঁথে দেয়। দুজনই লুটিয়ে পড়ে মাটিতে…. চির বিদায় নেয় এ পৃথিবী থেকে। অবশেষে দুজনের মিলন হয় একত্রে মাটিচাপা পড়ে!

বাঁশি হাতে দাড়িয়ে আছে নদের চাঁদ

মূলতঃ মহুয়া পালাটি সামাজিক শ্রেণী বৈষম্য ও অসম প্রেমের একটি নিদর্শন। প্রেমকে যে কোনো ভাবেই বেঁধে রাখা যায় না তারই এক উজ্জ্বল উদাহরণ এই পালাটি। তৎকালীন রক্ষনশীল সমাজের বেদের মেয়ে মহুয়া সুন্দরী ও জমিদারের সুদর্শন ছেলে নদের চাঁদের ভালোবাসায় বারবার বাধা এসেছে….কিন্তু কোনো বাধাই দু’জনের মধ্যে আত্মিক দূরত্ব সৃষ্টি করতে পারেনি, এমন গল্পই তো রোমিও- জুলিয়েট, লাইলি-মজনু, শিরি- ফরহাদের। ঐ চরিত্রগুলোর মতো এরাও তো অমর! ঠিক, এটাও প্রেমের একটি অমর কাহিনী যা আমরা অনেকেই জানিনা। অথচ এগুলো আমাদের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার ,আমাদের অস্তিত্ব, আমাদের পরিচয় যা উত্তর নাগরিকের চিন্তা-ভাবনা তৈরিতে শক্তি দেয়। এর জন্যে চাই নিজস্ব চেতনা ও ঐতিহ্যের প্রসার। আর এটাই এই প্রজন্মের মূল দায়িত্ব। সে দায়িত্ব পালনে আমরা সচেষ্ট হবো, আমাদের সংস্কৃতিকে ধরে রাখবো এবং এর প্রসার করবো।

গ্রাম গঞ্জে মহুয়া’ পালা

কিন্তু কথা হলো… তাহলে কি আগে আমরা অন্ধকারাচ্ছন্ন ছিলাম? তা নিশ্চয় নয়। ইউরোপের মানুষ প্রমাণ করতে চায় রেনেসাঁস জ্ঞান-বিজ্ঞান-সাহিত্য-দর্শনের আলো বাণিজ্যের জাহাজে চড়ে অনেক শ্রম-সাধনার পর পৌঁছালো এই উপমহাদেশে। সে আলোতেই আমরা আলোকিত হলাম, দেখলাম পরস্পরকে। কিন্তু নাহ্, আমাদেরও একটা আলোকময় ঐতিহ্য আছে। বুদ্ধদেব বসুও তাঁর অনূদিত ‘মেঘদূত’র ভূমিকায় এ বিষয়টি দুঃখ করে বর্ণনা করেছেন,’আমাদের জানা জিনিস তাদের কাছ থেকে আবার নতুন করে শিখতে হলো’l পাশ্চাত্য সমাজে তাদের লোককাহিনীকে টিকিয়ে রাখার জন্য কতো অনুষ্ঠান, কতো মেলা, কতো সিনেমার তৈরি হয়। মার্জিতভাবে আধুনিকতার ছোঁয়া দেয়…. পুরনো গল্পগুলোকে নতুন আঙ্গিকে নিয়ে আসে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য করার জন্য। তাই আজও তাদের Sleeping Beauty, Beauty & The Beast, Cinderella বেঁচে আছে সবার কাছে। আর সেটা নতুন প্রজন্ম গ্রহণ করছে তাদের মতো করে। তেমনি ভাবে আমাদের চিন্তা-ভাবনাকেও সেদিকে প্রসারিত করতে হবে, নতুনভাবে ভাবতে হবে নিজেদের সংস্কৃতিকে ধরে রাখার জন্য। কুপমন্ডুকতায় আটকে থাকলে চলবে না।