ঠিকঠাক ভোরের আলো তখনও ফোটেনি, প্যারিসের সেন্ট লাজার জেলখানায় ১৭ নম্বর কুঠুরীর কয়েদী মার্গারিটা অন্যান্য দিনের মতই নোংরা দুর্গন্ধময় এই কুঠুরীর একমাত্র ছোট জানালার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন, যেমন প্রতিদিন থাকেন। একটু একটু সূর্যের আলো ঐ জানালা দিয়ে প্রবেশ করে, আলো আসার ঐ একটাই পথ। প্রতিদিন মার্গারিটা ভাবেন, নতুন দিনের সূর্য বোধহয় তার জন্য সত্যিকারের নতুন একটা দিন নিয়ে আসবে।
হঠাৎ ভারী বুটের আওয়াজ পেয়ে মার্গারিটা নড়েচড়ে বসলেন। আওয়াজটা মার্গারিটার কুঠুরীর দিকেই এগিয়ে আসছে, নিস্পৃহ হয়ে বসে রইলেন মার্গারিটা। একসময় গরাদের উল্টোদিকে দুজন নান, তাঁর আইনজীবী এবং এক নিরাপত্তাকর্মী উপস্থিত হলেন। অল্প কথায় মার্গারিটার আইনজীবী যা বললেন, নিস্পলক দৃষ্টিতে মার্গারিটা পুরোটা শুনলেন। চোখে মুখে বিস্ময় তখনও কাটেনি। মার্গারিটা চেঁচিয়ে উঠলেন “না এ হতে পারে না।” পরমুহূর্তে সংযত করলেন নিজেকে। একটু অপেক্ষা করতে বলে ধীরে ধীরে পোশাক পাল্টালেন, প্রিয় একঢাল দীর্ঘ কালো চুল ঢেকে নিলেন বড় ফেল্টের টুপিতে। হঠাৎ মেয়েটার কথা মনে পড়ে গেল ― চোখের কোণ থেকে একফোঁটা জল সবার অলক্ষ্যে মাটিতে পড়ল। না, আর দেরী নয়। নিজেকে প্রস্তুত করে এগিয়ে গেলেন গরাদের দিকে। খুর ধীর অথচ নির্ভীক ভঙ্গিতে বললেন, “আমি প্রস্তুত।” দুজন নানের পাশে হেঁটে একটা ধূসর গাড়িতে উঠলেন। প্যারিসের শুনশান রাস্তা দিয়ে ভোরের কুয়াশা চিরে গাড়িটা এগিয়ে চলল শহরের প্রান্তে শ্যাতো দ্যু ভিসেনসের দিকে।
গাড়িতে বসে মার্গারিটা শেষবারের মত দেখে নিচ্ছিলেন এই শহরটাকে, প্যারিস তাঁর স্বপ্নের শহর। এই শহর তাঁকে দুহাত ভরে দিয়েছিল নাম, যশ, প্রতিপত্তি, অগণিত স্তাবক। এক সময় তাঁর সঙ্গ পাওয়ার জন্য ব্যাকুল ছিল এই শহরের উচ্চবিত্ত ক্ষমতাবান পুরুষেরা। নির্জনে নিভৃতে তাঁকে পাওয়ার জন্য মাথা কুটেছে অগণিত রাজপুরুষের দল। গাড়ি থেকে নেমে মার্গারিটা ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলেন বধ্যভূমির দিকে, মনে হচ্ছে পা আর চলছে না। এটুকু পথ যেতেই যেন একটা যুগ পেরিয়ে গেল। ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে এসে দাঁড়াতেই একজন সৈনিক এসে চোখে কালো কাপড় আর হাত বাঁধতে চাইল, মার্গারিটা বারণ করে দিলেন। মৃত্যুকে চাক্ষুস করতে চান তিনি। ১২ জন সৈনিক প্রস্তুত, প্রস্তুত মার্গারিটাও। কমাণ্ডারের নির্দেশের আগে মৃদু হাসিতে একটা উড়ন্ত চুম্বন ছুড়ে দিলেন ১২ জন সৈনিকের দিকে। কমাণ্ডারের পাশে থাকা একজন অফিসার স্বগোতক্তি করলেন, “এই মেয়ে জানে কীভাবে মরতে হয়।”
কমাণ্ডারের নির্দেশ পেতেই চলল গুলি, হাঁটু মুড়ে ঢুলে পড়লেন মার্গারিটা, ধীরে ধীরে কাত হয়ে গেল মাথাটা। মৃত্যু নিশ্চিত করতে একজন সেনা অফিসার এগিয়ে এসে গুলি করলেন কপালের ঠিক মাঝ বরাবর। পরদিন ফলাও করে ছাপানো হল এই খবর। সামরিক আদালতের রায়ে শাস্তি পেলেন কুখ্যাত গুপ্তচর মাতা হারি। যাঁর বিশ্বাসঘাতকতায় বিশ্বযুদ্ধে পর্যদুস্ত ফ্রান্স, মারা গিয়েছে প্রায় ৫০ হাজার ফরাসি সৈন্য। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে যে কজন গুপ্তচরের নাম আজও মানুষের মুখে মুখে ফেরে মার্গারিটা ওরফে মাতা হারি তাঁদের মধ্যে একজন।
গুপ্তচর বা স্পাই’রা নিজেদের বুদ্ধিমত্তা, ছলচাতুরী ও নানা কৌশলকে কাজে লাগিয়ে রাষ্ট্রীয় গোপন তথ্য সংগ্রহ করত, অন্য রাষ্ট্রের জন্য। গুপ্তচরদের কৌশলের একটি পন্থা ‘হানিট্র্যাপ’, নিজের দেহবল্লরী ও যৌনতাকে কাজে লাগিয়ে রাজনীতিবিদ ও কূটনীতিবিদের ফাঁদে ফেলে গোপন তথ্য আদায়ের এক মাধ্যম। মাতা হারিকে অনেকেই হানিট্র্যাপের জননী বলে থাকেন। রাশিয়া, ইংল্যান্ড, জার্মানি, ফ্রান্সের বাঘা বাঘা রাষ্ট্রনেতা, কূটনীতিবিদকে ঘায়েল করেছিলেন মাতা হারি, এমনই অভিযোগ। আরো অভিযোগ ― মাতা হারি একজন ‘ডবল এজেন্ট’ অর্থাৎ অর্থের বিনিময়ে একসাথে একাধিক রাষ্ট্রের হয়ে গুপ্তচর বৃত্তি করতেন।
মাতা হারির ওরফে মার্গারিটা গেট্রুডা জিল হল্যান্ডের এক ধনী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন ১৮৭৬ সালের ৭ই আগস্ট। ছোটবেলা থেকেই বিলাসব্যসনে বড় হওয়া মার্গারিটার জীবনে বিপর্যয় নেমে এল যখন বাবা মায়ের বিচ্ছেদ হয়ে গেল। ততদিনে মার্গারিটার বয়স ১৩ বছর। দীর্ঘ কালো চুল, বাদামী চোখ আর জলপাই আভা গায়ের রঙের দীর্ঘাঙ্গী প্রাণবন্ত মার্গারিটা স্বভাবে লাজুক কিন্তু চালচলনে দাম্ভিক। বাবা-মায়ের বিচ্ছেদের দুবছর পর মায়ের মৃত্যু হয়। এই সময় মার্গারিটার প্রতি তাঁর বাবার ব্যবহার ক্রমশ তাঁকে নিঃসঙ্গ করে তুলেছিল। ১৮ বছর বয়সে মার্গারিটাকে হেগ শহরে এক আত্মীয়র বাড়ীতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ততদিনে মার্গারিটা এটুকু বুঝে গেছিলেন যে এই নিরাপত্তাহীন বিপর্যস্ত জীবনে বাঁচতে গেলে শক্ত খুঁটি লাগবে। আরও বুঝেছিলেন তাঁর এই সুন্দর দেহবল্লরীই তাঁকে একমাত্র নিরাপত্তার জীবন দিতে পারে, তাঁর যৌবন পুরুষদের কাছে মোহনীয় এবং কামনার।
স্থানীয় পত্রিকায় একটা ‘পাত্রী চাই’ বিজ্ঞাপন চোখে পড়ে মার্গারিটার। “ইন্ডিজের সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন, হল্যান্ডে আছেন ছুটিতে, মনের মত একজন পাত্রী খুঁজছেন।” পাত্র ক্যাপ্টেন রুডলফ ম্যাকলিউড। মার্গারিটা দেখা করলেন ক্যাপ্টেন রুডলফ ম্যাকলিউড এর সাথে যিনি মার্গারিটার দ্বিগুণ বয়সী এক পৌঢ়। তিন মাস পর বিয়ে হয়ে গেল দুজনের, পরের সাত বছর নবদম্পতি ডাচ ইস্ট ইন্ডিজ অর্থাৎ আজকের ইন্দোনেশিয়ায় কাটান, দুই সন্তানের জন্ম হয় সেখানেই। জীবনের যে নিরাপত্তার খোঁজে দ্বিগুণ বয়সী একজনের সাথে বিয়ে করেছিলেন মার্গারিটা তা ক্রমশ ভুল প্রমাণিত হল। দুর্ভাগ্য অবশ্য পিছু ছাড়ল না মার্গারিটার। দাম্পত্য জীবন এর মধ্যেই অসহনীয় হয়ে উঠেছিল মার্গারিটার কাছে। ম্যাকলিউড শুধু মদ্যপ আর অত্যাচারীই নয়, যৌনরোগগ্রস্ত, যেটা ছিল ম্যাকলিউডের এক বাঁধা রক্ষিতার দান। দুই সন্তানই বাবার কাছ থেকে পেয়েছিল সিফিলিস। এরই মধ্যে দুই সন্তান ভয়ংকর অসুস্থ হয়ে পড়ল। মেয়েকে কোনোক্রমে বাঁচানো গেলেও, ছেলেটি মারা যায়। তবুও বেশ কিছুদিন এই অসুখী দাম্পত্য চললেও মার্গারিটার প্রতি ম্যাকলিউডের হিংস্র আচরণ ক্রমশ বাড়তে থাকে। স্বামীর এহেন আচরণ মার্গারিটাকে পরকীয়ার দিকে ঠেলে দেয়। একের পর এক নতুন সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন মার্গারিটা। অসুখী দাম্পত্য আর টিকিয়ে রাখা গেল না। অবশেষে ১৯০২ সালে বিচ্ছেদ হল। ততদিনে তাঁরা ফিরে এসেছিলেন হল্যান্ডে। ম্যাকলিউড তাদের ছোট মেয়েটিকে জোর করে রেখে দিল নিজের কাছে। মার্গারিটা মেয়েকে নিজের কাছে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করলেও অর্থাভাবে সফল হলেন না।
১৯০৩ সালে কপর্দকশূন্য মার্গারিটা ২৭ বছর বয়েসে এলেন প্যারিসে। কিছুদিন শিল্পীদের মডেল হিসেবে কাজ, কিছু দিন সার্কাসে কাজ তেমন নিরাপত্তার জীবন দিতে পারল না, আবার ফিরে গেলেন হল্যান্ডে। এখানে তাঁর পরিচয় হয় এক ফরাসি কূটনীতিক হেনরি দ্যু মার্গুয়েরির সাথে। মার্গুয়েরির মিসট্রেস হিসেবে মার্গারিটা কিছুদিন পর প্যারিস ফিরে আসেন। মার্গুয়েরির মাধ্যমে প্যারিসের নানা মহলের পুরুষের সাথে পরিচয় হল। এবার শুরু হল জীবনের বিখ্যাত সময়টি, নৃত্যশিল্পী হিসেবে নাচের দুনিয়ায় পা রাখলেন মার্গারিটা। ইন্দোনেশিয়ায় থাকাকালীন সেখানকার নৃত্যশৈলী শিখেছিলেন, তা কাজে লাগিয়ে এক অদ্ভুত গল্প ফাঁদলেন। নিজেকে জাভার এক রাজকুমারী হিসেবে পরিচয় দিলেন। নতুন নাম নিলেন ‘মাতা হারি’ অর্থাৎ ভোরের আলো। তাঁর মসৃণ ত্বক, বাদামী চোখ, দীর্ঘ একঢাল কালো চুল আর মোহময় শরীরী আবেদনে মাতাল হয়ে গেল প্যারিস। স্বল্প পোশাকের ওপর পাতলা ওড়না শরীরে জড়িয়ে মঞ্চে আসতেন মাতা হারি, নাচতে নাচতে ধীরে ধীরে এক এক করে পোশাক উন্মোচন করতেন; আধুনিক স্ট্রিপটিজের রূপকার বলা যায় মাতা হারিকে। নগ্নতাকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেলেন মাতা হারি। ইরোটিক নাচের সাথে যোগ করলেন আধ্যাত্মিকতাও। মাতা হারি খুব ভালো করেই জানতেন কীভাবে প্রচারের সমস্ত আলো নিজের দিকে টেনে নিতে হয়। অর্থের অভাব রইল না আর। ১৯১০ সালের মধ্যে সারা ইউরোপে ছড়িয়ে পড়লো মাতা হারির নাম। মাতা হারির শরীরি সাহচর্যের একান্ত প্রত্যাশী ছিলেন রাশিয়া, জার্মানি, ফ্রান্সের উচ্চপদস্থ সামরিক অফিসার আর ধনী পুরুষরা।
ইতিমধ্যে ১৯১৪ সালে শুরু হল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে হল্যান্ড কোন পক্ষ নেয়নি, তাই ডাচ নাগরিকদের ইউরোপের বাকি দেশগুলোতে ভ্রমণে কোন সমস্যা ছিল না। এই সময় মাতা হারি একজন সম্ভ্রান্ত জার্মান রাজপুরুষের আহ্বানে জার্মানি যান। কিন্তু বার্লিনে আটকে যান। তাঁর টাকাপয়সা-গয়না সব বাজেয়াপ্ত করল জার্মান অফিসাররা। কার্ল ক্রোমার নামে এক জার্মান কনসাল মাতা হারিকে জার্মানির হয়ে গুপ্তচরবৃত্তির প্রস্তাব দিলেন, বিনিময়ে ২০,০০০ ফ্রাঁ পাবেন মাতা হারি। মাতা হারি ভাবলেন তাঁর যে টাকাপয়সা গয়না জার্মান সরকার আটক করেছে, তার বদলে এই অর্থ তাঁর প্রাপ্য। গুপ্তচর হওয়ার কোনও অভিপ্রায় তাঁর ছিল না আবার অর্থের ব্যাপারে মাতা হারির কোন বাছবিচার ছিল না। তিনি অনায়াসে সেই টাকা নিলেন। জার্মান কনসাল কার্ল ক্রোমার মাতা হারিকে H-21 কোড নেম দিলেন গুপ্তচরবৃত্তির জন্য।
১৯১৫-র ক্রিস্টমাসে মাতা হারি তিন সপ্তাহের জন্য প্যারিসে বেড়াতে যান। এরপর যান ইংল্যান্ড ভ্রমণে। সেখানে ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থা কড়া নজর রাখতে শুরু করল মাতা হারির উপর। বিশ্বযুদ্ধ তখন সমস্ত ইউরোপের রাজনৈতিক পরিস্থিতি পাল্টে দিয়েছে, এই সময় মাতা হারির মত জনপ্রিয় আর পরিচিত মুখ রাষ্ট্রের নজরদারিতে পড়ে যাবে এইটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বিলাসব্যসনে ব্যস্ত মাতা হারি আঁচ পেলেন না এই পুলিশি নজরদারির কথা। ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থা খোঁজ নিয়ে জানতে পারল মাতা হারি বার্লিনে গিয়েছিল এবং সেখানে এক জার্মান কনসালের সাথে তাঁর সখ্যতা হয়েছিল। তারা সন্দেহ করল মাতা হারি একজন জার্মান এজেন্ট এবং এই তথ্য পাঠালো ফ্রান্সের কাছে।
ইতিমধ্যে প্যারিসে ফিরে এসে মাতা হারির জীবনে এল প্রেম, জীবনে প্রথমবার। প্রেমিক ২১ বছর বয়সী রাশিয়ান পাইলট ভ্লাদিম মাসলভ। মাতা হারির বয়স প্রায় চল্লিশের কোঠায়, পূর্বের নৃত্যশিল্পীর জীবন তিনি ছেড়ে দিলেও বিয়ে করে সংসারজীবন হওয়ার সম্ভাবনা নেই, অথচ এক মায়ার বাঁধনে জড়িয়ে গিয়েছেন এই তরুণের। মাসলভ ভালোভাবেই জানতেন তাঁর প্রেমিকার যৌবনের জৌলুস আর নেই, কিন্তু মাতা হারি তো বহু পুরুষের ফ্যান্টাসি! একজন যুদ্ধের সৈনিক যাঁর যুদ্ধে বেঁচে থাকার সম্ভাবনা সম্পর্কে যিনি নিজেই সন্দিগ্ধ, তিনি মাতা হারিকে শুধু প্রেমিকা হিসেবে নয়, পেলেন ভালবাসায় জড়িয়ে নেওয়া এক বন্ধু হিসেবেও। কিছুদিনের মধ্যেই মাসলভ যুদ্ধক্ষেত্রে ফিরে যান। জার্মানদের ভয়ানক মাস্টার্ড গ্যাসের আক্রমণে তাঁর বাম চোখ নষ্ট হয়ে গেল এবং গুরুতর আহত হলেন। আহত প্রেমিককের সাথে সাক্ষাতে নানা অসুবিধার মধ্যে পড়েন মাতা হারি। এই সময় ফ্রেঞ্চ গোয়েন্দা অফিসার ক্যাপ্টেন গিওর্গি ল্যাঁদু’র সাথে পরিচয় হয়। ল্যাঁদু প্রস্তাব দিলেন, দেখা করার অনুমতি মিলবে, তবে ফ্রান্সের হয়ে গুপ্তচরবৃত্তির শর্তে। নিরুপায় মাতা হারি রাজি হলেন। বিনিময়ে চাইলেন ১০ লক্ষ ফ্রাঁ। ভাবলেন, মাসলভ সুস্থ হলে নতুন জীবন শুরু করবেন দুজনে এই টাকা দিয়ে।
ল্যাঁদুর প্রস্তাব অনুযায়ী ডবল এজেন্ট হিসেবে মাতা হারিকে প্রথম অ্যাসাইনমেন্ট দেয়া হল বেলজিয়ামে, প্রথম অ্যাসাইনমেন্টে যাওয়ার পথে স্পেনে আটক হলেন মাতা হারি। সেখানে এক জার্মান গোয়েন্দাকর্তাকে রূপ আর যৌনতার অস্ত্রে ঘায়েল করলেন এবং উত্তর আফ্রিকায় জার্মান রণকৌশল সম্পর্কে কিছু তথ্য জেনে নিলেন। অ্যাসাইনমেন্টের সাফল্যের খবর যথাস্থানে দিয়ে ভাবলেন, শর্ত মতো তাঁর টাকাটা এ বার পেয়ে যাবেন। অন্য দিকে সেই জার্মান গোয়েন্দাকর্তাটি বার্লিনে এক রেডিয়ো-বার্তা পাঠালেন, জার্মান গুপ্তচর H-21 তাঁকে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছে। বার্তাটি ফ্রান্সের হাতে এসে পড়ল। বর্ণনার সঙ্গে মিলিয়ে ফরাসি কর্তারা বুঝলেন, H-21 আসলে আর কেউ নয়, মাতা হারি।
১৯১৭ সালের ১৩ই ফেব্রুয়ারি প্যারিসের এক হোটেল থেকে মাতা হারিকে গ্রেফতার করা হল। তদন্ত চলাকালীন মাতা হারিকে পাঠানো হল কুখ্যাত সেন্ট লাজার জেলে। দিনের পর দিন জেরা চলল। নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার জন্য নানা জায়গায় অজস্র চিঠি লিখলেন, প্রচুর চেষ্টা করলেন মাতা হারি। কাজ হল না। ফ্রান্স খুব ভালমত জানত, মাতা হারির বিরুদ্ধে সেই জার্মান গোয়েন্দাকর্তার পাঠানো রেডিয়ো-বার্তা ছাড়া আর কোনও তথ্য-প্রমাণ নেই। তাই বিচার চলাকালীন মাতা হারিকে কোনরকম আত্মপক্ষের সুযোগ দেওয়া হল না। মাতা হারি এত দিন যেখান থেকে যত টাকা পেয়েছেন; হোক তা জার্মান আধিকারিকদের সঙ্গ দেওয়ার বিনিময়ে, বা এক ডাচ ব্যারনের কাছ থেকে মাসোহারা বাবদ— সবটাই গুপ্তচরবৃত্তির জন্য ‘জার্মানির কাছ থেকে পাওয়া টাকা’ বলে প্রমাণ করা হল। এরই মধ্যে মাতা হারি কার্ল ক্রোমার নামের সেই জার্মান কনসালের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার কথা স্বীকারও করলেন। মজবুত অজুহাত পেল ফ্রান্স। দোষী সাব্যস্ত হলেন মাতা হারি। ১৯১৭ সালের ১৫ অক্টোবর তাঁর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হল।
সুন্দরী, লাস্যময়ী, অপ্রতিরোধ্য যৌনতার অধিকারী, বিশ্বাসঘাতক! পৃথিবীর অন্যতম কুখ্যাত গুপ্তচর! এই ছবিটা আঁকা হল, তার তলায় ঢাকা পড়ে গেল মাতা হারির অন্য মুখ। বিতর্কের শেষ নেই তা নিয়ে। মাতা হারি তাঁর বিচার চলাকালীন বারবার বলে গিয়েছেন, তাঁর বিশ্বস্ততা শুধুমাত্র ফ্রান্সের প্রতি। মিথ্যেও ছিল না সেই দাবি। কিন্তু তাঁর কথায় কেউ কর্ণপাত করার প্রয়োজন মনে করেনি, কারণ এটাই তো তারা চেয়েছিল। এই ভয়াবহ যুদ্ধের জন্য একটা বলি খুবই দরকারি হয়ে পড়েছিল। কারন ওয়েস্টার্ন ফ্রন্টের যুদ্ধে কৌশলগত ভুলের জন্য জার্মানির কাছে শোচনীয়ভাবে পর্যদুস্ত হয়েছে ফ্রান্স। প্রচুর সৈন্য মারা গিয়েছে যুদ্ধে, আহতের সংখ্যাও কম নয়। ১৯১৭ সালে রণক্লান্ত ফ্রান্সের সৈন্যরা বিদ্রোহ শুরু করেছে। এই অবস্থায় হারতে বসা যুদ্ধটা জেতা এবং বিদ্রোহী ও হতোদ্যম সৈন্যদের মনোবল ফিরিয়ে আনার জন্য এক জন ‘বিশ্বাসযোগ্য বিশ্বাসঘাতক’ তৈরি করার দরকার ছিল। বলির পাঁঠা করে হারের দায়ভার চাপানোর জন্য হাতের কাছে মাতা হারির মত নারী মজুত। যে নারী নগ্নতায় নির্লজ্জ, যাঁর পুরুষসঙ্গী গুনে শেষ করা যায় না, অর্থের লোভে যে সবার শয্যাসঙ্গী হতে পারে, সেই মেয়েই তো গুপ্তচর হতে বাধ্য। নিপুণ হাতে তাঁর বিরুদ্ধে ফাঁদ পেতেছিল জার্মানি আর ফ্রান্স। আর রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ মাতা হারি বোকার মতো সেই ফাঁদে পা দিয়েছিলেন।
অন্যদিকে জার্মানি সুযোগ পেয়েছিল, সেই সময় জার্মানির আসল গুপ্তচর, যারা ফ্রান্সে থেকে কাজ করছিল, তাদের থেকে নজর ঘুরিয়ে ফ্রান্সকে বিভ্রান্ত করা। রাজনীতি, ক্ষমতালিপ্সা আর যুদ্ধ মেশানো এত জটিল খেলা মাতা হারি বুঝতে পারেননি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ-পূর্ববর্তী সমাজের পক্ষেও মাতা হারিকে মেনে নেওয়া কঠিন ছিল। যে সমাজে নারী স্বাধীনতা কী বস্তু তাই জানে না লোকে, যেখানে ‘বিবাহবিচ্ছিন্না নারী’ মানে ভোগ করে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়ার বস্তু। ব্রিটেনে যখন তাঁকে আটক করা হয়েছিল তখন তার পিছনে যুক্তি ছিল, “যে নারী এমন সুন্দরী, যে এতগুলি ভাষায় অনর্গল কথা বলতে পারে, যে নারী কোনও পুরুষসঙ্গী বা অভিভাবক ছাড়াই একা ইউরোপ ঘুরে বেড়ায়, তাঁকে সন্দেহের ঊর্ধ্বে রাখা যায় না।” প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অজস্র পুরুষ এবং নারী গুপ্তচর সন্দেহে ধরা হয়েছিল। এঁদের মধ্যে সব থেকে চর্চিত ও কুখ্যাত, মাতা হারি।
অথচ ‘খারাপ মেয়েমানুষ’-এর আড়ালে যে প্রেমিকা, যে মা লুকিয়ে রইলেন, তাঁকে কেউ চিনল না। ফ্রান্সের হয়ে যে গুপ্তচরবৃত্তি তিনি করার চেষ্টা করেছিলেন, সেটা শুধুই নিজের প্রেমকে বাঁচানোর জন্য। অজস্র পুরুষকে বিছানায় সঙ্গ দিয়ে খুব সম্ভবত তিনি ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলেন। তাই চল্লিশ বছর বয়সে থিতু হতে চেয়েছিলেন জীবনে। কিন্তু ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। প্রেমিক মাসলভও তাঁর ঘোর দুঃসময়ে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। সন্তানকে কাছে না পাওয়ার যন্ত্রণাও নিরন্তর তাড়া করেছে তাঁকে। এক সময় অর্থের অভাবে মেয়েকে কাছে রাখতে পারেননি। পরে যখনই সেই চেষ্টা করেছেন, তাঁর নগ্ন ছবি, চরিত্রের দুর্নাম তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছেন তাঁর স্বামী। বলেছেন, পতিতা কোনও দিন ভাল মা হতে পারে না। মেয়েকে অজস্র চিঠি লিখেছেন মাতা হারি। সব ফেরত এসেছে। মৃত্যুর আগে মাসলভ আর মেয়েকে চিঠি লিখেছিলেন মাতাহারি। জেল কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করেছিলেন, তাঁর জীবনের শেষ ইচ্ছা, এই চিঠি দু’টো যথাস্থানে পাঠিয়ে দেওয়া হোক। হয়নি। ছিঁড়ে ফেলা হয়েছিল সেই চিঠি দু’টো।
একটিও সৈন্যের মৃত্যুর জন্য দায়ী ছিলেন না তিনি। মাতা হারি বিশ্বাসঘাতক ছিলেন না। তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন একটি ছোট্ট সংসারের, তিনি বাঁচতে চেয়েছিলেন, ভালোবাসতে চেয়েছিলেন, একজন সত্যিকারের প্রেমিককে পাশে চেয়েছিলেন। বদলে লাস্যময়ী সৌন্দর্যের খ্যাতি আর চরিত্রের কুখ্যাতি নিয়ে তাঁকে চলে যেতে হয়েছে।
 
লেখাটি প্যারালাল ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া