মোঘল খাবার, Stay Curioussis

মোঘলরা ছিল ভীষণ খাদ্যরসিক। এই ভারতবর্ষকে তারা নানা রকমের সুস্বাদু খাবার উপহার দিয়েছে। তাছাড়াও পরিচিত খাবারের মধ্যে এনেছে ভিন্নতা। সেইসব খাবারের নামে মোঘল সম্রাটরা অনেক সময় নিজেদের নামের সাথেই মিলিয়ে রাখতো।

মোঘল খাবার, Stay Curioussis

জিলাপি

মোঘলদের বিশেষ কিছু খাবারের মধ্যে একটি হলো জিলাপি। পনেরো শতকের সংস্কৃত গ্রন্থে “কুন্ডলীকা” ও “জালাভালিকা” নামে দুটো মিষ্টান্নের উল্লেখ আছে। ধারণা করা হয় এই দুটোই জিলাপির আরেক নাম। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই জিলাপি বিভিন্ন নামে পরিচিত। ইরানে “জালাবিয়া”, মালদ্বীপে “জিলিপি”, নেপালে “জেলি” নামে বিখ্যাত এই জিলাপি। এটি মূলতঃ মধ্য এশিয়ার খাবার। মধ্যযুগে যখন তুর্কিরা ভারতবর্ষে আক্রমণ করেছিল, তখন তাদের হাত ধরেই জিলাপি ভারতবর্ষে প্রবেশ করে। অনেকে আবার বলে, সম্রাট জাহাঙ্গীরের এই জিলাপি এতই প্রিয় ছিল যে, এর নতুন নাম রাখা হয়েছিল “জাহাঙ্গীরা”।

মোঘল খাবার, Stay Curioussis

বিরিয়ানির কাহিনী

এরপর আসা যাক বিরিয়ানিতে। যে বিরিয়ানি দেখে আমরা রীতিমত হামলে পরি তা আসলে পারস্যিক খাবার। এই মোঘলদের হাত ধরেই এই খাবার ভারতবর্ষে এসেছে। পারস্য ও ভারতবর্ষের রীতি মিলিয়ে এই খাবার হয়ে উঠে আরও সুস্বাদু। বিরিয়ানি শব্দের উৎপত্তি ফারসি শব্দ “বিরিয়ান” থেকে, যার অর্থ রান্নার আগে ভেজে নেয়া। বিরিয়ানি বাঙালির খাদ্য তালিকায় এমনভাবে মিশে আছে যে, চাইলেও একে আলাদা করা সম্ভব নয়।

মোঘল খাবার, Stay Curioussis

লা জওয়াব কাবাব

মোঘল সম্রাট বাবর যখন ভারতবর্ষ জয় করেন, তখন দেশটি তার পছন্দ হলেও, এর খাদ্যাভ্যাস পছন্দ ছিল না।সমরকন্দে হেরে যাবার পর নানান পাহাড়পর্বতে থেকে থেকে বাবরের অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল তিনবেলা যাযাবর ঘোড়সওয়ারদের মতন মাংস খাওয়ার। এই মাংস রান্না হত অতি সহজে ক্যাম্পফায়ারে বসে ঝলসে। ১৯২০ সালে এক ইংরেজ সিভিল সার্ভেন্টকে স্থানীয় আফ্রিদীর দল মাংস রেঁধে খাওয়ায় যার রেসিপি সেই বাবরের সময়কার। তাঁকে দেওয়া হয় কাঠিগাঁথা এক টুকরা ভাজা ভেড়ার মাংস। হাত দিয়ে খুলে খুলে খেতে হয় সেই মাংস। আর্মিনিয়াস ভাম্বেরি নামের এক হাঙ্গেরিয়ান প্রফেসর ১৮৬০ সালে লিখে গেছেন সেই মাংস ভাজার রেসিপিঃ । এটি বর্তমানের শিক কাবাবের পূর্ব রূপ, যা বাবরের খুব প্রিয় খাবার ছিল l

মোঘল খাবার, Stay Curioussis

বাবর

সম্রাট বাবর যখন ভারতবর্ষ জয় করেন তখন সেখানে বেশিরভাগ মানুষ ছিল নিরামিষভোজী। কেউ নিরামিষ খেতো ধর্মীয় কারণে,কেউবা আবার টাকার অভাবে। ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দীর দিকে চাল ও ডাল দিয়ে এক বিশেষ খাবার রান্না করা হতো, যার নামে খিচুড়ি। সম্রাট বাবর খাদ্যরসিক ছিলেন বলেই তার রান্নাঘরে ভারতীয় বাবুর্চি রাখা হয়েছিল। কিন্তু সেই বাবুর্চির তৈরী খাবার খেয়ে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। পরে পরীক্ষা করে দেখা গিয়েছিল, সেই খাবারে বিষ মেশানো ছিল। তারপর থেকে সম্রাট বাবরের রান্নাঘরে আর ভারতীয় বাবুর্চি রাখা হয়নি। কিন্তু তার ছেলে সম্রাট হুমায়ূনের রান্নাঘরে ভারতীয় বাবুর্চি ছিল। একবার পারস্যের সম্রাটকে সেই চাল-ডালের তৈরী খিচুড়ির মোঘল সংস্করণ খাইয়েছিলেন।

মোঘল খাবার, Stay Curioussis

কম নয় খিচুড়িও

পারস্যে মোঘল খাবারের মধ্যে আরেকটি খাবার খুব জনপ্রিয় ছিল, আর তা হলো “পোলাও”। আগ্রায় এক ধরণের চাল উৎপাদিত হতো যার তৈরী ভাত হতো খুব ঝরঝরে। বাবুর্চিরা উৎসবভেদে বিভিন্ন ধরণের পোলাও, যেমন- মুরগি পোলাও, ফলের পোলাও, জাফরান পোলাও- তৈরী করতো। এই পোলাওগুলো তখন পারস্যের দিকে দিকে ছড়িয়ে পরে। স্পেনে এই পোলাও-এর নাম ছিল “পায়েইয়া” আর ইতালিতে নাম ছিল “রিজেটা”।

মোঘল খাবার, Stay Curioussis

আকবর

এরপর আসে সম্রাট আকবরের পালা। ভারতবর্ষ ছিল তার প্রিয় দেশ। তিনি পারস্যিক খবরের সাথে এই উপমহাদেশের সংস্কৃতি মিলিয়ে তৈরী করেছিলেন অভিনব সব খাবার। শোনা যায়, আকবরের রান্নাঘরে বাবুর্চিরা এতই সক্ষম ছিল যে, এক ঘন্টার মধ্যে একশো অতিথির খাবার রান্না করতে পারতো। দিনে দিনে আকবরের উৎসাহে ভারতীয় সংস্কৃতিতে যুক্ত হতে থাকে মজার মজার সব খাবার। আবুল ফজলের লেখা “আইন-ই-আকবরী” বইতে সেইসব খাবারের উপকরণ ছিল সাধারণ ও সহজলভ্য।

মোঘলরা পারস্যের দুটি মশলাকে নিজেদের করে নিয়েছিল। এক জাফরান, দুই হিং। খাবারে হিং মেশালে অনেকটা রসুনের মত স্বাদ হয়। তাই যারা নিরামিষভোজী; পেঁয়াজ-রসুন খেতেন না তাদের কাছে হিং ছিল জনপ্রিয়। এমনকি সেই সময় হিং চাষও করা হতো। তাছাড়া বিভিন্ন মিষ্টান্নতে প্রচুর বাদাম-কিসমিসও ব্যবহার করা হতো। “আইন-ই-আকবরী”-তে “দো-পেঁয়াজা” নামে একটি খাবারের উল্লেখ ছিল। মাংসের কিমাকে পেঁয়াজ, রসুন, হলুদ, মরিচ, ধনেপাতা দিয়ে রান্না করা হতো এই “দো-পেঁয়াজা”।

মোঘল খাবার, Stay Curioussis

শরবত

পারস্য থেকে আমদানি করা আরেকটি খাবার ছিল শরবত। বিভিন্ন ফলের রসের সাথে বরফের কুচি মিশিয়ে তৈরী করা হতো এই শরবত।
ভারতবর্ষে মোঘলদের প্রিয় জায়গা ছিল “কাশ্মীর”। সেখানে স্থানীয় উপায়ে তৈরী একটি খাবার ছিল “রোগান জোশ”। এই বিখ্যাত খাবারটিরও আদি নিবাস ছিল পারস্য।

মোঘলরা ফল খেতেও ভীষণ ভালোবাসতো। সম্রাট বাবর তার শেষ জীবনে নিজের দেশের মিষ্টি তরমুজের কথা ভেবে মন খারাপ করেছিলেন। সম্রাট জাহাঙ্গীর তো এই উপমহাদেশের ফল আমকে সেরা ফল হিসেবে ঘোষণা দিয়েছিলেন।

মোঘল খাবার, Stay Curioussis

জাহাঙ্গীর

যত গল্পই করা হোক না কেন, মোঘলদের জন্যই মূলত আমরা এতো মজার মজার খাবার খেতে পারছি। পোলাও, বিরিয়ানির নামে শুনলেই তো আমাদের জিভে জল এসে যায়। দিনে দিনে মোঘলদের আবিষ্কৃত এই খাবারগুলো হয়ে উঠেছে বাঙালির অন্তপ্রাণ। বাঙালির বিভিন্ন উৎসব, পালা-পার্বনের সাথে এই খাবারগুলো এমনভাবে জড়িয়ে গেছে যে, কখনো মনেই হবে না জিভে জল আনা বেশিরভাগ খাবারের জন্ম আমাদের এই উপমাদেশে নয়। কিন্তু এই উপমহাদেশে সংস্কৃতির সাথে মিশে গেছে ওতপ্রোতভাবে।

মোঘল খাবার, Stay Curioussis

শাহজাহান