মার্ক শাগালের ছবিগুলি যেন শীত বিকেলের মনোরম দিনের মতো, দেখলেই মনটা ভালো হয়ে যায়।তবুও… কোথায় যেন খানিকটা বিষণ্ণতাও ছড়িয়ে আছে তবে সেটা কষ্টের নয়। ছবি আঁকার পাশাপাশি মার্ক শাগাল তাঁর আত্মজীবনীও লিখেছেন। তাঁর আত্মজীবনী পড়লে মনে হবে তিনি ছবি না এঁকে যদি লিখতেন তাহলেও তিনি খ্যাতির চূড়ায় থাকতেন। রাশিয়ার একটি ছোট শহর উইটেবসকে, ১৮৮৭ সালে একটি ইহুদি পরিবারে মার্ক শাগালের জন্ম। যেদিন তাঁর জন্ম হয়, সেদিন শহরের গরীব ইহুদি পাড়ায় আগুন লেগে তা নিশ্চহ্ন হয়ে যায়।
আত্মীয়স্বজনদের সাথে তাঁর বেড়ে ওঠা, তবে ঘনিষ্ট ছিলেন নানার সাথে। নানার বর্ণনা তিনি দিয়েছেন এভাবে, “ তিনি জীবনের অর্ধেক সময় কাটিয়েছেন স্টোভের উপর শুয়ে, সিকিভাগ সিনাগগে আর বাকিটা কসাইয়ের দোকানে। এতোটা সময় তাঁর বিশ্রামে কেটেছে যে, আমার নানী যৌবনেই চলে গিয়েছিলেন ওপারে।”
মাকে খুব ভালোবাসতেন তিনি। তাঁরা আট ভাই- বোন ছিলেন, স্বাভাবিকভাবেই মা সময় দিতে পারতেন না, কিন্তু শাগালের মন মানতো না। যৌবনের শুরুতে একটা ছবি এঁকে মাকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘ দেখাতো মা ছবিটা কেমন?’
মা ছবিটা দেখে বলেছিলেন, ‘ হ্যাঁ মনে হচ্ছে তোর ট্যালেন্ট আছে। কিন্তু বাছা শোন, আমার মনে হয় তোর কেরানী হওয়া উচিত। তোর জন্য আমার দুঃখ হয়, তোর কাঁধটা যে রকম। কিন্তু এই ট্যালেন্ট তুই পেলি কোথায়?’
“ আমি তোমাকে আমার জন্য প্রার্থনা করতে বলি না, তুমি নিজেই জানো আমার বেদনা কেমন হতে পারে, বলোতো আমার ছোট্ট মা— অন্য পৃথিবী, স্বর্গ, মেঘ যেখানেই তুমি থাকো না কেন, আমার ভালোবাসা কি তোমায় সান্ত্বনা যোগায়?”
“আমার শব্দ দিয়ে কি বুনতে পারি তোমার জন্য মধুর, শান্ত কোন সান্ত্বনা?” মা এবং নানা ছাড়াও তিনি পরিবারের অন্য সদস্যদের সাথেও ঘনিষ্ট ছিলেন। তিনি পরম মমতায় পরিবারের সবার ছবি এঁকেছেন। তাদের জীবন- যাপন, স্বপ্ন, আনন্দ-দুঃখ— এসব উপাদান দিয়েই তৈরি করেছেন তাঁর ছবির জগত। তিনি লিখেছেন, “যদি আমার পরিবারের কাছে আমার ছবির কোন মূল্য না থাকতো তা হলে হয়তো ছবিই হতো না!”“তাঁদের জীবন, তাঁদের কৃতিত্ব প্রভূতভাবে প্রভাবিত করেছে আমার ছবিকে।”
তাঁর শৈশবের সংসারের একটি ছবি, তাঁর ভাষায়— “ সাবাথের নৈশভোজ, পিতার জন্য একটু বিশেষ আয়োজন, মাংস। দরজার পাশে দাঁড়িয়ে আমি দেখছিলাম কুকুরের মতো। আমার ছোট ভাই- বোনগুলি আমার পাশে, পেছনে দাঁড়িয়ে দেখছিলো। আমরা সবাই সেই পাত্রের মাংস খেতে চাইছিলাম।ভাবছিলাম, হয়তো একদিন আমি পিতা হবো, বাড়ির কর্তা হবো, যখন ইচ্ছা তখন খেতে পাবো ভাজা মাংস।”
একবার একটা কুকুর কামড়েছিলো শাগালকে, কাকা তাঁকে নিয়ে গেলেন সেন্ট পিটার্সবার্গ। ডাক্তার বললেন, তাঁর বাঁচার কোন আশা নাই।“আমি ভাবলাম, বারান্দায় হয়তো জারের সাথে আমার দেখা হয় যাবে’ লিখেছেন তিনি।
নেভা নদী পার হওয়ার সময় মনে হলো পুলটা আকাশ থেকে ঝুলছে। বাগানে মনে হলো সুন্দর পোষাক পরে খেলছে শিশুরা আর যুবরাজও আছেন সেখানে।” পঞ্চমফর্মে পড়ার সময় এক পত্রিকায় রুবেনস্টাইনের ছবি দেখে আঁকলেন, কিছু স্কেচও করলেন। ছবিগুলি তাঁর ঘরে টাঙ্গিয়ে রাখলেন। এক বন্ধু এসে সেগুলি দেখে বললেন—
‘বাহ্, তুমি দেখছি সত্যিকারের শিল্পী!’
‘শিল্পী সেটা আবার কি? একজন শিল্পী কে? এটা কি সম্ভব আমি নিজেও….’
তখনই শাগালের মনে হলো, শহরের কোথায় যেন একটি দোকানের সাইনবোর্ড দেখেছেন লেখা আছে— ‘পেনে দ্য পেইন্টার্স স্কুল অফ পেইন্টিং আ্যান্ড ডিজাইন।’
‘ভাবলেন শাগাল—‘ ভবিতব্য নির্ধারিত’। আমাকে শুধু ঐ স্কুলে যেতে হবে এবং আমি একজন শিল্পী হবো।’ তারপর মায়ের কাছে অনুনয় বিনয়। মা নিয়ে গেলেন তাঁকে পেনের কাছে। বললেন—-‘দেখুন দেখি, এ হতে চায় একজন পেইন্টার… নিশ্চয় পাগল হয়ে গেছে… ওর ড্রইংগুলি একটু দেখবেন… যদি তার কোন ট্যালেন্ট থাকে তবে শিক্ষা নেয়াটা পোষাবে, না হলে বাছা, বাসায় চলো।’
পেনে দেখলেন স্কেচগুলি। বললেন, হ্যাঁ.. গুণ আছে, তার কিছু…’
বাবার কাছ থেকে পাঁচ রুবল যোগাড় করে শিক্ষা নেয়া শুরু করলেন তিনি। পেনের ছাত্রদের মধ্যে একমাত্র তিনিই বেগুনী রং দিয়ে আঁকতেন।ব্যাপারটা এতো অভাবনীয় এবং সাহসী যে তাঁকে আর কোন ফিস দিতে হয়নি পেনেকে।
তিনি লিখেছেন— “আমার স্মৃতিতে তিনি আমার পিতার মতো। প্রায়ই যখন আমি আমার শহরের পরিত্যক্ত রাস্তার কথা ভাবি, তখন তাঁকে দেখি এখানে সেখানে, কোথাও না কোথাও।
তাঁর বাড়ির সামনে গিয়ে কতবার তাঁকে বলতে চেয়েছি “আমি খ্যাতি চাই না; আপনার মতো নীরব একজন ক্রাফটসম্যান হতে চাই, আপনার ছবির মতো ঝুলে থাকতে চাই, আপনার রাস্তায়, আপনার কাছে, আপনার বাসায়।
আমি কি সেটা করতে পারি?”
যৌবনে বেল্লার প্রেমে পড়েন, কৈশরে যে দু’একটি মেয়ের সাথে প্রেম হয়নি এমনটা নয়, তবে বেল্লার সাথে প্রেমে জড়ানোর পর অন্য কোন মেয়ের দিকে ফিরেও তাকাননি, বেল্লাকেই বিয়ে করেছেন এবং আজীবন তাঁরা একসাথে ছিলেন।
পিটার্সবার্গে এসে তিনি চেয়েছিলেন নামীদামী আর্ট স্কুলে ভর্তি হতে কিন্তু ফেল করলেন। পরে আরেকটু কমদামী স্কুল ‘ সোসাইটি ফর দ্য প্রোটেকশন অফদি আর্টস’ এ থার্ড ইয়ারে ভর্তি হলেন।এই স্কুলের ডাইরেক্টর ছিলেন রোয়েরিখ।
শাগাল লিখেছেন, “ দুটি বছর নষ্ট হলো সেখানে”।
তখন লিও বাকসটের স্কুলের নাম হচ্ছে, শাগাল বাকসটের বাড়িতে গেলেন তাঁর সাথে দেখা করতে।‘তিনি আমায় বুঝবেন, কেন আমি তোতলাই, কেন আমি বিবর্ণ, কেন প্রায়ই আমি বিষন্ন, আর কেনই বা আমি আঁকি লাইলাক রঙে’।
বাকসট শাগালের ড্রয়িং দেখে বললেন, স্পয়েল্ড্ বাট নট কমপ্লিটলি…’।
তিনি ভর্তি হলেন সেখানে, তাঁর সহপাঠী ছিলেন কাউন্টেস টলস্টয় এবং নিঝনিস্কি। নিঝনিস্কি তখনই বিখ্যাত ছিলেন।
কিছুদিন পর সেই স্কুল ছেড়ে শাগাল প্যারিস গেলেন। এক সময় শাগাল কবিতা লিখতেন। ভাস্কর্যবিদ গুইনজবার্গকে শাগাল তাঁর কবিতাগুলি তাঁর কবি বন্ধুকে দেখাতে অনুরোধ করলে তিনি বললেন, ‘ কেন ? কি কারনে? একজন শিল্পী এটা চায় না। এর কোন প্রয়োজন নেই’। এরপর আরেকবার আলেকজান্ডার ব্লককে তাঁর কবিতা দেখাতে গিয়েছিলেন, কিন্তু তাঁকে দেখার পর আর সাহস করলেন না। কবিতার খাতায়ই ফেলে দিলেন।
১৯১০ সালে তিনি প্যারিস গেলেন। ছোট একটা ঘরে থাকেন, কখনো খাবার জোটে, কখনো জোটে না।
তিনি লিখেছেন—-
“ রাত দুটো কি তিনটে হবে। আকাশ নীল, ভোর হবে।
নীচে, একটু দুরে, গরু জবাই করা হচ্ছে, চিৎকার করছে গরুরা আর আমি তাদের আঁকছি।
সারা রাত আমি সেভাবে বসে থাকতাম।…
ঘরে বাতি জ্বলছে, তার সাথে আমি”।
নিঝনিস্কি আর বাকসট প্যারিসে এলেন, তাঁর সাথে দেখা করলেন। শাগালের ছবি দেখে বাকসট বললেন,
‘এখন তোমার ছবি গান গায়’….।
প্রাক্তন ছাত্রের প্রতি এটাই ছিলো বাকসটের শেষ মন্তব্য।
রুশ শিল্পকলা সম্বন্ধে তাঁর মনে হয়েছে….
“It’s my imagination, Russia took the form of a paper balloon hanging from a parachute/ the deflated bulb of the balloon sagged, cooled off, and collapsed slowly as the years went by.”
তবুও রাশিয়া তাঁকে টানে।প্যারিস থেকে বার্লিন… সেখানে এক পত্রিকা অফিসে প্রদর্শনী শেষে ফিরলেন নিজের জন্মভূমিতে। রাশিয়ায় তখন বিপ্লবের পদধ্বনি পাওয়া যাচ্ছে। বিয়ে করলেন। এলেন পেট্রোগ্রাড। কাজ করতে হলো সামরিক বিভাগে। জার্মানী এগুচ্ছে, পালাচ্ছে ইহুদিরা।
“ আমার ইচ্ছে হতো তাদের নিরাপত্তার খাতিরে,সবাইকে ক্যানভাসে রাখি”।
লেনিন আসছেন, মিখাইলস্কি থিয়েটারে শিল্পী সাহিত্যিকেরা সমবেত হয়েছেন সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় গঠনের উদ্দেশ্য । হঠাৎ তিনি শুনলেন, মন্ত্রী হিসাবে তাঁর নাম প্রস্তাব করা হয়েছে। ফিরে এলেন পেট্রোগ্রাড থেকে উইটেবসক, কারণ মন্ত্রী হওয়ার চেয়ে নিজের শহরে ফেরা ভালো। এক জায়গায় লিখেছেন, “আমি আঁকছি না, তারজন্য আমার স্ত্রী চোখের জল ফেলেন।“বরফে ঢেকে গেছে রাশিয়া। লেনিন তাকে উল্টে দিলেন, যেভাবে আমি উল্টে দেই আমার ছবি”।
তিনি নিজ শহরে ‘ স্কুল অফ ফাইন আর্টস্ খুললেন।তিনিই ডাইরেক্টর।প্রতিবারই লুনাচরস্কি তাঁকে তাঁর স্কুলের জন্য অনুদান পেতে সাহায্য করতেন। আর প্রতিবারই তিনি চাইতেন শাগাল তার কর্তৃত্ব মানবেন, আর না মানলে হাজতবাসের হুমকি দিতেন। শাগাল কখনোই তার কর্তৃত্ব মানেননি। তাঁর স্কুলের শ্রীবৃদ্ধি হতে লাগলো, তিনি প্রাণপণে খাটতে লাগলেন। একদিন দেখলেন, তিনি নিজেই সেখান থেকে বহিস্কৃত।
তিনি লিখেছেন….
And then I understood that no man is a prophet in his own country.”
চলে গেলেন মস্কো, সেখানে বিশৃঙ্খল অবস্থা, খাদ্যাভাব। এর মাঝেই তিনি থিয়েটার গড়ে তুলতে চেয়েছেন, এঁকেছেন ম্যুরাল। কিছুদিন অনাথ শিশুদের স্কুলে ছবি আঁকা শেখালেন।দেখলেন যথেষ্ট হয়েছে।
সব ছেড়ে তিনি আবার ছবি আঁকায় মনোযোগ দিতে চান। লুনাচরস্কির সাহায্য তিনি প্যারিস যাবার ছাড়পত্র যোগাড় করলেন। যুদ্ধের আগে তাঁর আঁকা সব ছবি তখন বার্লিন আর প্যারিসে। জার্মানী থেকে তাঁর কবি বন্ধু রুবিনার লিখলেন……‘বেঁচে আছো তুমি? তারা বলে তুমি যুদ্ধে মারা গেছো। তুমি কি জানো যে, এখানে তুমি এখন বিখ্যাত? তোমার ছবিগুলি খুব ভালো দামে বিকাচ্ছে।
টাকার চিন্তা করো না, ওয়ালডেনের কাছে তোমার পাওনা আছে। সে তোমাকে কিছু দিবে না, তার মতে খ্যাতিই যথেষ্ট। Your pictures have launched expressionism’.
আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি শাগালকে। তিনি লিখেছেন, “আমি বরং চিন্তা করবো আমার বাবা- মা,রেমব্রা, সেঁজা, আমার নানা বা আমার স্ত্রীর কথা। বরং চলে যাবো হল্যান্ড, ইতালীর দক্ষিণে প্রভাসে এবং কাপড় চোপড় পরিত্যাগ করে বলবো…. দেখো বন্ধুরা, আমি আবার ফিরে এসেছি তোমাদের কাছে। আমি শুধু ছবি আঁকতে চাই, পাশাপাশি আরও কিছু করতে চাই। ইম্পিরিয়াল রাশিয়া বা সোভিয়েত রাশিয়ার আমাকে কোন প্রয়োজন নেই। তাদের কাছে আমি আগন্তুক, রহস্য। আমি নিশ্চিত রেমব্রা ভালোবাসেন আমাকে।”
১৯২২ সালে মস্কোয় যখন তাঁর আত্মজীবনী লেখা শেষ করেছিলেন তখন শেষ বাক্যটি ছিলো…. “ হয়তো ইউরোপ আমাকে ভালোবাসবে এবং তার সঙ্গে আমার রাশিয়া”।
১৯২৩ সালে, যখন তাঁর বয়স পঁয়ত্রিশ বছর তখন তিনি মস্কোয় বসে তাঁর আত্মজীবনী শেষ করেছিলেন।রুশ ভাষায় লেখা বইটি বেরিয়েছিলো আরো পঁচিশ বছর পরে ১৯৪৭ সালে। ফরাসি সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৯৫৭ সালে। আর ‘মাই লাইফ’ সংস্করণটি ইংরেজীতে প্রকাশ হয় ১৯৬৫ সালে। মূল রুশ ভাষা থেকে ফরাসি ভাষায় বইটি অনুবাদ করেন তাঁর স্ত্রী। বইটি ফরাসি থেকে ইংরেজীতে অনুবাদ করেন ডরোথি উইলিয়ামস। অক্সফোর্ড ‘মাই লাইফ’ য়ের পেপারব্যাক সংস্করণ প্রকাশ করেন, বইটির প্রধান আকর্ষণ শাগালের পঞ্চাশটি ড্রইং। ছোট ছোট বাক্যগুলি যেন ছোট ছোট ছবি, যা জোড়া দিলে হয়ে যাবে একটি চিত্রিত ক্যানভাস।
তথ্যসূত্রঃ
মার্ক শাগাল, মাই লাইফ, অক্সফোর্ড, লন্ডন ১৯৮৯
মুনতাসীর মামুন।