Chandrabati and her associates

শেক্সপিয়ার, মোনালিসা, ওমর খৈয়াম যেমন জনপ্রিয়, তেমনি বাংলার কবি চন্দ্রাবতীও সেই জনপ্রিয়তার দাবিদার।পাশ্চাত্য সংস্কৃতি এইসব মানুষদের তাদের সৃষ্টির জন্য অমর করে রেখেছে। আমাদের এই বাংলা, বারবার পরাধীনতার শিকলে বাঁধা পরে ছিল।তাই, বাংলার এই কবিরা কালের গহবরে হারিয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু এখন সময় হয়েছে, সেইসব শিল্পীদেরকে তাদের যোগ্য সম্মান ফিরিয়ে দেয়ার। ১৫৫০ সালে কিশোরগঞ্জে কবি চন্দ্রাবতীর জন্ম। অসংখ্য গীতিকবিতা, পালাগান তিনি লিখেছেন। প্রেম বিরহগাঁথা, বৈষম্য, অবিচার চন্দ্রাবতীর গীতিকা-সাহিত্যের অংশ হয়েছিল। চন্দ্রাবতীর বাবা দ্বিজ বংশীদাস ‘পদ্মপুরাণ’ এবং ‘মনসামঙ্গল’ কাব্যের রচয়িতা। তিনি ভাসান গানের দল নিয়ে গান গেয়ে বেড়াতেন।। সেই থেকে চন্দ্রাবতীরও সাহিত্যে পদচারণা। এমনকি বাবার কথাতেই তিনি রামায়ণের বাংলা অনুবাদ শুরু করেন। রামায়ণের অনুবাদ চন্দ্রাবতীর অমর সৃষ্টি হিসেবে আজও স্থান পায় বাংলা সাহিত্যে। চন্দ্রাবতীর লেখার গাঁথুনি খুবই ভালো ছিলো। তিনি প্রায় পাঁচশো বছর আগে বিভিন্ন কুসংস্কারের বিরুদ্ধে লিখেছেন। অত্যাচার, নিপীড়নের বিরুদ্ধে সাহিত্যে তার কথা তুলে ধরেন। চন্দ্রাবতী রামায়ণের পুরোপুরি অনুবাদ করেননি। সীতার প্রতি যে অবিচার রামায়ণে করা হয়েছে, সেসবই তিনি অত্যন্ত সুক্ষ্মভাবে তুলে ধরেছেন। নারীবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে রামায়ণ অনুবাদ করেছিলেন চন্দ্রাবতী। এতে করেই চন্দ্রাবতীর রুচিশীলতা, মুক্তচিন্তার প্রমাণ পাওয়া যায়।

House of Chandraboti

তার এই সাহিত্য রচনা, পড়াশোনা, খেলাধুলার একমাত্র সাথী ছিল জয়ানন্দ। ছোটবেলা থেকে একসাথে বেড়ে উঠছিলো তারা। তারা দুজনেই কবিতা লিখতে ভালোবাসতো দ্বিজবংশীর পদ্মপুরাণে চন্দ্রাবতী এবং জয়ানন্দ, দুজনেরই কবিতা রয়েছে। একসময় বুঝতে পারে তারা একজন আরেকজনকে পছন্দ করে। বাবা দ্বিজবংশী ও পরিবারের মতে চন্দ্রাবতী ও জয়ানন্দের বিয়ের দিন ঠিক হয়। ঠিক সেদিনই ঘটে চন্দ্রাবতীর জীবনের সেই অঘটন। তার সেই ছোটবেলার সাথী জয়ানন্দ ধর্মান্তরিত হয়ে বিয়ে করে ফেলেন এক মুসলমান মেয়ে আসমানীকে(কমলা)।

Chandrabati from the play

জয়ানন্দের দেয়া এই আঘাত চন্দ্রাবতী সহজে মেনে নিতে পারেননি। সে তার বাবার কাছে প্রার্থনা করে, ফুলেশ্বরী নদীর তীরে তার জন্য শিব মন্দির তৈরী করে দেয়া হোক। সেখানে তিনি কুমারী থেকে সারা জীবন শিবের উপাসনা করে কাটিয়ে দিতে চান।পিতাও কন্যার অনুরোধ মেনে নেন। কন্যা-পিতার কথা কবিতার চরনে:

চন্দ্রাবতী বলে ‘পিতা সম বাক্য ধর।
জন্মে না করিব বিয়া রইব আইবর॥
শিবপূজা করি আমি শিবপদেমতি।
দুঃখিনীর কথা রাখ কর অনুমতি’॥
অনুমতি দিয়া পিতা কয় কন্যার স্থানে।
‘শিবপূজা কর আর লেখ রামায়ণে’॥
 
চন্দ্রাবতীর দিন কাটতে থাকলো শিবের আরাধনা করে। আর অবসর সময়ে তিনি রামায়ণ রচনা করতেন। কথায় আছে, আঘাত না পেলে, সৃষ্টি করা যায়না। তার সবচেয়ে কাছের মানুষের দেয়া আঘাত তাকে নব নব সাহিত্য সৃষ্টির দরজা খুলে দিয়েছিলো।

Different Characters

এর বেশ কিছুদিন পর জয়ানন্দ নিজের ভুল বুঝতে পারে। সে তখন চন্দ্রাবতীর কাছে ফিরে আসে। মন্দিরের দরজার কাছে বসে বার বার চন্দ্রাবতীর কাছে ক্ষমা চায়। কিন্তু চন্দ্রাবতী শিবের আরাধনায় এতোই মগ্ন ছিলেন যে জয়ানন্দের কথা সে শুনতে পাননি। এদিকে জয়ানন্দ মনে করেন চন্দ্রাবতী তাকে ক্ষমা করেননি। তাই তিনি চন্দ্রাবতীর উদ্দেশ্যে একটি কবিতা লিখে সেখান থেকে চলে যান আর নিজের ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করতে ফুলেশ্বরী নদীতে আত্মাহুতি দেন।চন্দ্রাবতী যখন মন্দিরের বাইরে আসে তখন সে বুঝতে পারে জয়ানন্দ এসেছিলো আর তার আগমনে মন্দির অপবিত্র হয়েছে। তাই সে পানি আনতে নদীতে যায় আর সেখানে জয়ানন্দের মৃতদেহ দেখে। অনেকের ধারণা, চন্দ্রাবতী নিজেও তখন সেই নদীতে ঝাঁপিয়ে আত্মাহুতি দেন।আবার অনেকে বলেন, জয়ানন্দের মৃত্যুর পরেও তিনি অনেকদিন বেঁচে ছিলেন এবং তার স্বাভাবিক মৃত্যুই হয়েছিল।
 
চন্দ্রাবতীর মতো দুঃখের জীবন বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে বিরল। নিজের কষ্ট ছাপিয়ে তিনি যে কাব্যগাথা, অসাধারণ পালাগান পরিবেশন করে গিয়েছেন তা এখনো গ্রামের মানুষের মুখে মুখে।তার জীবনীভিত্তিক পালাগান গীত ও অভিনীত হয়ে আসছে সেই প্রাচীন কাল থেকে এখনও। আর এভাবেই দুঃখিনী কবি চন্দ্রাবতী আজো বেঁচে আছেন বাংলাদেশের পল্লীহৃদয়ে বিশেষ করে বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলে।
 
 
অন্যান্য গীতিকা থেকে মৈমনসিংহ গীতিকাগুলি একটু আলাদা। এতে হিন্দু ও মুসলমান দুটি সংস্কৃতিই দেখতে পাওয়া যায়। প্রাচীন বাংলা সাহিত্য প্রধানত ধর্মাশ্রিত ও দেবদেবী কেন্দ্রিক হলেও মৈমনসিংহ গীতি কবিতায় ধর্মের প্রভাব খুবই অল্প। এসব গীতিকায় তুলে আনা হয়েছে পূর্ববঙ্গের সহজ সরল পল্লী-জীবনের কাহিনী। গীতিকায় পটভূমি বর্ণনা করা হয়েছে নায়ক নায়িকাদের প্রাত্যহিক জীবনের খুঁটিনাটি, তাদের প্রেম ভালোবাসা-বিরহ দিয়ে। এছাড়াও তখনকার পল্লীবাংলার দৈনন্দিন সমস্যা, গ্রামীণ জীবনের প্রকৃত অবস্থা আমরা পেয়েছি এইসব গীতিকাব্যগুলির মাধ্যমেই। বিভিন্ন রোগ, বন্যায় ফসল নষ্ট, দুর্ভিক্ষ, ক্ষুধা, দারিদ্রতা এসব লোকগীতিতেই পেয়েছি। এমনকি, একটা মানুষ তার বেঁচে থাকার শেষ সম্বল গরু বা বসতবাড়ি বিক্রি বা বন্ধক করে জীবন চালিয়েছে এবং তাতেও না কুলালে দেশ ছেড়েছে এমন ঘটনাও চন্দ্রাবতী তার ‘মলুয়া’ ও ‘কেনারাম দস্যু’ পালার ছত্রে ছত্রে লিখে গেছেন। একজন কবি হিসেবে তার স্বার্থকতা রেখেছেন তার কবিতার মাঝে। একই কবিতায় একইসাথে হিন্দু ও মুসলিম সমাজের ব্যবহৃত শব্দ তিনি ব্যবহার করেছেন। আজ থেকে ৫০০ বছর আগে যা অকল্পনীয় ছিলো। নারী হিসেবে তো কল্পনারও অতীত ছিলো। একদিকে তিনি দুর্গাপূজা, লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের কথা বলছেন, অন্যদিকে মুসলিম দোয়া, পানি, ছাওয়াল এসব শব্দ স্বাভাবিকভাবে ব্যবহার করেছেন চন্দ্রাবতী।
 
 
চন্দ্রাবতী যে রামায়ণ রচনা করছিলেন তা তিনি সম্পূর্ণ করে যেতে পারেননি। তাই অনেকে এই রচনাকে অসমাপ্ত ও দুর্বল সাহিত্য বলে ফেলে রেখেছেন। আসলে এটা কোনো দুর্বল বা অসমাপ্ত সাহিত্য নয়।এটি একটি নারীর রচিত কবিতা, যেখানে রামের গুণগান না করে, সীতার দুঃখ, দুর্দশা, অসহায়ত্ব তুলে ধরা হয়েছে। তার এই সৃষ্টিকে তখনকার পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বিরুদ্ধচারণ হিসেবে দেখা হয়েছে। তাই তার অন্যান্য কবিতাগুলো খ্যাতি পেলেও রামায়ণ তেমন একটা জায়গা করে নিতে পারেনি। কিন্তু তার এই নারীপ্রধান রামায়ণ সারাজীবন অবহেলিত নারীদের কিছুটা হলেও মুক্ত করেছে।