পলাশীর করুণ পরিণতিতে বাংলার স্বাধীনতা সূর্য অস্তমিত হলেও স্বাধীনতার জন্য ব্রিটিশ শোষণের বিরুদ্ধাচরণ করে জেল-জুলুম ও আত্মবলিদান দিতে কুণ্ঠিত হয়নি বাংলার সন্তানেরা। সেই সব লড়াই-সংগ্রামের এক বিপ্লবী সন্তান কমরেড মনি সিংহ। কে এই মনি সিংহ? চলুন জেনে আসা যাক।

বাংলাদেশের গারো পাহাড়ের পাদদেশের নেত্রকোণার পূর্বধলার জমিদারের সন্তান কালীকুমার সিংহ ও সুসং রাজবংশের কন্যা সরলা দেবীর ঘরে ১৯০১ সালে জন্ম নেন মণি সিংহ। সুসং দুর্গাপুরে প্রাথমিক শিক্ষা শেষে তিনি কলকাতা যান এবং সেখানে যোগ দেন গোপন বিপ্লবী দল ‘অনুশীলনে’। উঁচু-নিচু শ্রেণীর ব্যবধান হটিয়ে শিক্ষাকে অস্ত্র হিসেবে বেছে নিয়ে স্থাপন করেন বিদ্যালয়। বিপ্লবী নেতা সুরেশ চন্দ্রের অনুপ্রেরণায় পরিচিত হন মার্কসীয় মতবাদের সাথে। তারপর সখ্যতা গড়ে উঠে কমরেড মোজাফফর সহ নানান বিপ্লবীদের সাথে এবং কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন।

বিপ্লবীনেতা মনি সিংহ

সেইসময় ১৯২৮ সালে কলকাতার মেটিয়াবুরুজ এলাকায় কাশেম কটন মিলে শ্রমিকদের দাবি আদায়ের আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। ১৩ দিন ব্যাপী ধর্মঘটে নেতৃত্ব দিয়ে দাবি আদায়ের মাধ্যমে মনি সিংহ রাজনৈতিক কর্মকান্ডে প্রথম সফলতা অর্জন করেন। এরপর তিনি ১৯৩০ সালে গ্রেফতার হন এবং ৭ বছর পর জেল খাটেন। জেল থেকে মুক্তি পেয়ে তিনি দুর্গাপুরে আসেন এবং সেখানে কৃষকদের দুর্দশা দেখে কৃষক-শ্রমিকদের সংগঠিত করে আন্দোলন গড়ে তোলেন। হাজংদের নিয়ে টংক আন্দোলন ও তেভাগা আন্দোলনের তিনি ছিলেন রূপকার। তাঁর নেতৃত্বে নেত্রকোণা ও বৃহত্তর ময়মনসিংহতে কৃষক আন্দোলন ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে এবং ১৯৪৫ সালে নেত্রকোণায় নিখিল ভারত কিষাণ সভার সন্মেলন হয়, যেখানে তিনি ছিলেন সভাপতি।

টংক আন্দোলন এত ব্যাপকতা লাভ করে যে শেষ পর্যন্ত সরকার ১৯৫১ সালে টংক প্রথা বাতিল করে কিন্তু মণি সিংহের উপর হুলিয়া জারি করে তাঁর সমস্ত স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত ঘোষণা করে। পাকিস্তান সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ কমিউনিস্ট পার্টির নেতা মণি সিংহকে ধরিয়ে দিতে ১০ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে আইয়ুব সরকার। ১৯৬৭ সালে আত্মগোপন অবস্থায় তিনি গ্রেপ্তার হন। ঊনসত্তরের গণ-অভ্যূত্থানের ফলে পাকিস্তানি সরকার অন্য রাজবন্দীদের সাথে তাঁকেও মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।

চির বিপ্লবীনেতা মনি সিংহ

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে মণি সিংহ ও তাঁর সহকর্মীরা বিশেষ ভূমিকা রাখেন। চির বিপ্লবি নেতা মনি সিংহ ১৯৯০ সালের ৩১ জানুয়ারি মারা যান। তাঁর আত্মতাগ, সাহস ও সংগ্রামী জীবন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে। তাঁর প্রতি আমাদের পরম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। আজীবন বিপ্লবী নেতা মনি সিংহ আমাদের অহংকার ।