ভারতীয় উপমহাদেশে সতেরো শতাব্দীর কথা উঠলেই সবার আগে যে নামটি উচ্চারিত হয়, সেটি হচ্ছে মীর জুমলা। একজন লড়াকু ও কৌশলী মানুষ হিসেবে মীর জুমলার জীবন কাহিনী অবশ্যই মনোযোগ ও সম্মান পাবার দাবি রাখে। তুচ্ছ অবস্থা থেকে কি করে সফলতার শিখরে আরোহণ করতে হয়, তার এক উৎকৃষ্ট উদাহরণ হলেন মীর জুমলা।
দক্ষিণ ভারতবর্ষের গলকোণ্ডা রাজ্যের এক বণিকের হাত ধরে কেরানী হিসেবে শুরু হয় মীর জুমলার জীবন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, জীবনে কিছু করতে হলে তাকে ইরানে নয়, বরং এই ভারতবর্ষেই থিতু হতে হবে। অবশেষে পরিপূর্ণ ব্যবসায়িক জ্ঞান নিয়ে শুরু হয় তার ভারতবর্ষ যাত্রা।
তিনি হীরার ব্যবসা শুরু করেন এবং এই ব্যবসা খুব দ্রুতই লাভজনক হয়ে দাঁড়ায়, যা মীর জুমলার ভাগ্যকে বদলে দেয়। একজন উচ্চাভিলাষী ও দূরদর্শী ব্যক্তি হিসেবে মীর জুমলা অবিভক্ত বাংলার (ঢাকা থেকে আসাম ও কুচবিহার) ভৌগোলিক ও জনতাত্ত্বিক ইতিহাসকে পাল্টে দিয়েছিলেন। তিনি মুঘল সাম্রাজ্যের সামগ্রিক অবস্থা পরিবর্তনে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলেন। অনেকে মনে করেন, মীর জুমলা সম্রাট শাহজাহানকে ‘কোহিনূর’ হীরা উপহার হিসেবে দিয়েছিলেন। কিন্তু এর স্বপক্ষে কোনো লিখিত বা মৌখিক প্রমাণ নেই।
মীর জুমলা ছিলেন একজন বিচক্ষণ রাষ্ট্রবিশারদ। সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন তিনি। ফলে তিনি দ্রুতই নিজের জন্য একটি ভালো জায়গা তৈরী করে নিতে সক্ষম হন। শাহজাহানের ছেলেদের মধ্যকার উত্তরাধিকার যুদ্ধের কথাই ধরা যাক। মীর জুমলা বুঝতে পেরেছিলেন, চার ভাইয়ের মধ্যে আওরঙ্গজেবই সবচেয়ে দক্ষ এবং তিনিই এই যুদ্ধে বিজয়ী হবেন। তাই তিনি আওরঙ্গজেবের পক্ষ নিয়ে বনে যান তার একান্ত পরামর্শদাতা।
আওরঙ্গজেবের অবিসংবাদিত সামরিক নেতৃত্বের শ্রেষ্ঠত্ব, শায়েস্তা খানের প্রজ্ঞা, আর মীর জুমলার নেতৃত্ব -এই তিনের মিশেলে মুঘল সাম্রাজ্য হয়ে উঠে অপ্রতিরোধ্য। ইরানের এক ক্ষুদ্র তেল ব্যবসায়ীর ছেলে থেকে ভারতবর্ষের মুঘল সাম্রাজ্যকে বদলে ফেলার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখা মীর জুমলা এক অসাধ্য সাধন করেছিলেন, যা খুব কম মানুষই করতে পারেন।
তখনকার সময় ভারতবর্ষ ছিলো ভাগ্যান্বেষণের উদ্দেশ্যে আসা ব্যক্তিদের জন্য উর্বর ভূমি। অনেকেই এই ভারতবর্ষে আসতেন নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য। একই ঘটনা ঘটেছিলো মীর জুমলার ক্ষেত্রেও। তিনি পারস্যের এক ঘোড়া ব্যবসায়ীর সাথে সখ্যতা গড়ে তুলেছিলেন, যিনি গলকোণ্ডায় ঘোড়া সরবরাহ করতেন। মীর জুমলা এই সুযোগটি হারাতে চান নি। গলকোণ্ডা ছিলো তখনকার সময়ে বৈশ্বিক হীরা ব্যবসার কেন্দ্রস্থল। এখানে এসেই ভাগ্যের চাকা খুলে যায় মীর জুমলার। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হীরা ব্যবসায়ীরা এসে গলকোণ্ডায় জড়ো হন। মীর জুমলা এবার নিজেই শুরু করেন হীরার ব্যবসা। সাফল্য তার সামনে হাঁটু গেড়ে বসলো।
তার এই সফলতা ও নামডাক ধীরে ধীরে তাকে কুতুব শাহী সাম্রাজ্যের কাছাকাছি নিয়ে আসে। কুতুব শাহী সম্রাটের ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুযোগ আসলে সেখানেও মীর জুমলা নিজের বুদ্ধিবৃত্তিক সক্ষমতা প্রমাণ করতে ভুল করলেন না। তার ক্যারিশমাটিক সম্মোহনী ক্ষমতা ও প্রজ্ঞার মাধ্যমে তিনি তাদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে সক্ষম হন। সেই সাথে মাসুলিপাটনামে একটা লোভনীয় প্রকল্প বাগিয়ে নিতেও সমর্থ হন।
তার নেতৃত্বের গুণাবলি অবলোকন করে কুতুব শাহী সম্রাট তাকে গলকোণ্ডার প্রধানমন্ত্রী পদে ভূষিত করেন। কথিত আছে, সাম্রাজ্যে তার এতোই গুরুত্ব ছিলো যে, আব্দুল্লাহ কুতুব শাহ মীর জুমলার পরামর্শ ছাড়া একটি হীরাও কিনতেন না।
১৬৩০ সালে লেখা এক ইংরেজ ব্যবসায়ীর সূত্র থেকে জানা যায়, প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন ছাড়াও কার্যত পুরো সাম্রাজ্যের দেখাশোনাই করতেন মীর জুমলা। সেটা হোক কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে, কিংবা প্রশাসনিক ক্ষেত্রে। নিজের কঠোর পরিশ্রম ও মেধার দ্বারাই তিনি এগুলো অর্জন করেছিলেন। কিন্তু যখন যুদ্ধ শুরু হলো, মীর জুমলা তখন নিজেকে সম্রাট হিসেবে ঘোষণা করার প্রয়াস করেন এবং কুতুব শাহী সম্রাট তা আঁচ করতে পেরে ধীরে ধীরে মীর জুমলার প্রভাব খর্ব করতে থাকেন।
একটি ব্যাপারে মীর জুমলা বেশ মুন্সিয়ানা দেখান। তিনি কখনোই তার ব্যবসাকে রাষ্ট্রীয় কাজের সাথে জড়ান নি। তিনি বুঝেছিলেন, ব্যবসা আর রাষ্ট্র পরিচালনা দুইটি ভিন্ন বিষয় এবং দুটিকে আলাদাভাবে পরিচালনা করা জরুরি। তবে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হওয়ায় ব্যবসার ক্ষেত্রে তিনি বেশ সুবিধা লাভ করেছিলেন। সে সময় হীরা ব্যবসা পুরো বিশ্বেই খুব জনপ্রিয় ছিলো। মীর জুমলা তা বুঝতে পেরে গলকোণ্ডার কয়েকটি খনি কিনে ফেলেন এবং হীরার ব্যবসায় এক মনোপলির উত্থান ঘটান। গল্প প্রচলিত আছে যে, সে সময় মীর জুমলার কাছে প্রায় ৪০০ কেজি হীরা ছিলো।
তিনি সুতির কাপড়ের ব্যবসাও শুরু করেছিলেন। এই কাপড় ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, বার্মা, পারস্য ও আরবে রপ্তানি করা হতো। তার ব্যবসায়িক এজেন্টরা স্থায়ীভাবে সে সব দেশে তার ব্যবসার দেখ-ভাল করতেন। আবার বার্মা থেকে রুবি এবং ইন্দোনেশিয়া থেকে মশলা ও ধান আমদানিও শুরু করেছিলেন তিনি। এভাবে একটি বিশাল বাণিজ্যিক নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছিলেন মীর জুমলা।
তার ক্রমাগত সাফল্য, সম্পদের আকাশচুম্বী বৃদ্ধি ও রাজনৈতিক প্রভাব এতোটাই উত্থিত হয় যে, তা কুতুব শাহী সম্রাটকে অস্বস্তিতে ফেলে দেয়। ফলে তাদের মধ্যকার সম্পর্কে অবনতি ঘটে। কুতুব শাহী সম্রাটের সন্দেহবাতিকতা বুঝতে পেরে মীর জুমলা তার ব্যবসা গুটিয়ে ভারতবর্ষ পরিত্যাগ করার পরিকল্পনা করেন। কিন্তু তিনি এটি বুঝতে পারেন নি যে, তার কর্মকাণ্ডের ওপর তীক্ষ্ণ নজর রাখছিলেন সে সময়ের দাক্ষিণাত্যের সুবাদার আওরঙ্গজেব।
মীর জুমলা ও কুতুব শাহী সম্রাটের মধ্যকার উত্তেজনাকে কাজে লাগান আওরঙ্গজেব এবং মীর জুমলাকে মুঘলদের হয়ে কাজ করার প্রস্তাব দেন তিনি। এ কথা জানতে পেরে কুতুব শাহী সম্রাট মীর জুমলার স্ত্রী ও সন্তানদেরকে কারারুদ্ধ করেন। মীর জুমলা এবার আওরঙ্গজেবের কাছে সাহায্য চান।
মীর জুমলার প্রজ্ঞা, সফলতা ও তাকে নিয়ে প্রচলিত গল্প দিল্লিতে সম্রাট শাহজাহানের কানে পৌঁছে। তার নাম দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। তিনি দিল্লিতে আসলে স্বয়ং মুঘল গভর্নর তাকে বরণ করতে আসেন।
সম্রাট শাহজাহানের সাথে সাক্ষাৎ করতে আসার সময় মীর জুমলা উপঢৌকন হিসেবে সম্রাটের জন্য একটি মূল্যবান পাথর নিয়ে আসেন। অনেকে মনে করেন, এই পাথরটিই আসলে ‘কোহিনূর’। তাকে মুঘল প্রধানমন্ত্রী করা হয় এবং ধীরে ধীরে আওরঙ্গজেবের সাথে তার সখ্যতা গড়ে উঠে। একই সাথে মুঘল রাজনীতিতে ঘনীভূত সংকটেও মীর জুমলা হয়ে ওঠেন এক অন্যতম প্রধান চরিত্র।
এদিকে শাহজাহানের প্রিয় বড় ছেলে দারাশিকোহ মীর জুমলাকে পছন্দ করতে পারছিলেন না। তিনি সন্দেহ করলেন যে, আওরঙ্গজেবের সাথে মীর জুমলার গোপন যোগাযোগ আছে, যা নিকট ভবিষ্যতে তার বিপদের কারণ হতে পারে। তবে মীর জুমলা আওরঙ্গজেবের ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সহযোগী হিসেবে তার সাথে সম্পর্ক অব্যাহত রাখেন। দিল্লিতে থাকাকালীন আওরঙ্গজেবের কাছ থেকে মীর জুমলা একটি চিঠি পান, যেখানে আওরঙ্গজেব তাকে নিজের অভিভাবক ও রক্ষাকর্তা হিসেবে উল্লেখ করেন। ফলে আওরঙ্গজেবের সাথে মীর জুমলার সখ্যতা আরো বেড়ে যায় এবং উত্তরাধিকার যুদ্ধে স্বাভাবিকভাবেই মীর জুমলা দারাশিকোহর পক্ষ ত্যাগ করে আওরঙ্গজেবের পক্ষে যোগ দেন।
শাহ সুজার সাথে আওরঙ্গজেবের যুদ্ধ চলাকালে মীর জুমলা সরাসরি শাহ সুজাকে যুদ্ধে পরাজিত করেন। শাহ সুজার মৃত্যুর পর বাংলা প্রদেশের সুবাদার পদটি শূন্য হয়ে পড়ে। ১৬৬০ সালে ৬৯ বছর বয়সে বাংলা প্রদেশের সুবাদার বনে যান কিংবদন্তি মীর জুমলা। ঢাকায় আসার সাথে সাথেই তিনি উন্নয়ন কাজে হাত দেন, যার মধ্যে ছিলো দুটি রাস্তা তৈরী ও বেশ কয়েকটি দুর্গ নির্মাণ। ‘বিবি মরিয়মের কামান’, আর ‘মীর জুমলা পুল’ এখনো কালের সাক্ষী হয়ে বাংলায় তার অবদানের প্রমাণ দিচ্ছে।
পূর্ব দিকে মুঘল সাম্রাজ্যকে বিস্তৃত করার জন্য তিনি কুচবিহার আক্রমণ করেন এবং কুচবিহারকে মুঘলদের করদ রাজ্য হিসেবে মেনে নিতে এখানকার রাজাকে বাধ্য করেন তিনি। কুচবিহার জয়ের পর জনগণের উপর কোনো ধরনের অত্যাচার করতে সৈন্যদেরকে নিষেধ করে দেন তিনি।
কুচবিহারের পর তিনি আসাম আক্রমণ করতে অগ্রসর হন। কিন্তু সেখানে গিয়ে মুঘল সেনাবাহিনী একটি বিপজ্জনক অবস্থার মুখে পতিত হয়। তাদের খাবার ও রসদ ফুরিয়ে যেতে শুরু করে। এই অভিযানে তিন ভাগের দুই ভাগ মুঘল সৈন্য মারা যায়। তারপরও মীর জুমলা সৈন্যদের মনোবল ঠিক রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন।
ঝঞ্ঝাটপূর্ণ একটি জীবন থেকে উঠে আসা মীর জুমলা পরবর্তী জীবনে উচ্চাভিলাষী জীবন বেছে নিয়েছিলেন। প্রচলিত আছে যে, ব্যবসায়িক খদ্দেরদেরকে তিনি স্পেন থেকে নিয়ে আসা উচ্চমানের মদ উপহার দিতেন। এতো কিছুর পরও একজন দক্ষ যোদ্ধা হিসেবে তিনি পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে অসংখ্য অভিযানে নেতৃত্ব দিয়ে বিজয় ছিনিয়ে এনেছিলেন। আসাম আক্রমণের সময় তিনি নিজের জন্য বিশেষ সুবিধা দাবি করেন নি। তার সৈন্যরা যেমন স্বল্প খাদ্য পেয়েছিলো, সেই একই পরিমাণ খাদ্য তিনি নিজেও গ্রহণ করেছিলেন। এই ঘটনা তার অমিত শক্তি ও নেতৃত্বের প্রমাণ দেয়। বাংলার ইতিহাসে তার অবদান তাকে এক অবিসংবাদিত নেতার কাতারে দাঁড় করায়। একজন ব্যবসায়ী ধনকুবের এবং বাংলা সুবার সেনাবাহিনী-প্রধান হিসেবে মীর জুমলা ভাস্মর হয়ে থাকবেন ইতিহাসে।