রমজানের শেষ শুক্রবার অলবিদা, খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা বার। বাদশা [তাঁর কাব্যে লেখক মুন্সি ফৈজুল্লা শেষ দুই সম্রাট দ্বিতীয় আকবর শাহ এবং বাহাদুর শাহ জাফরের সময়ের রাজত্বের কথা বলছেন অর্থাৎ ১৮৫৭-র বিপ্লবের আগের কয়েক বছরের মূহূর্তগুলি] বিশাল মিছিল করে জামা মসজিদে গিয়ে সকলের সঙ্গে জমায়েত হতেন। মসজিদের সিঁড়িতে মহামহিম সম্রাটের জন্যে কারুকার্যময় সুনির্দিষ্ট সূক্ষ্ম আকারের একটি রূপোর উজ্জ্বল কেদারা ‘হাওয়াদার’এ তাঁকে বয়ে নিয়ে আসা হাতিটির পাশে বসানো থাকত। বাদশা সেটিতে বসতেন, তাঁকে মসজিদে বয়ে নিয়ে যাওয়া হত। তিনি হাউজে পৌঁছে নামতেন অজু করার জন্যে। তাঁর দেহরক্ষী চিৎকার করে তার গমন পথের সামনে সক্কলকে সরে দাঁড়াতে বলত। শাহজাদা, অভিজাত, আমীরেরা তাঁর গমন পথ অনুসরণ করতেন।

উপাসনার সময় বাদশার উপাসনার পাটিটা ইমামের পিছনে বসানো হত। বাঁ দিকে বসত তাঁর সাম্রাজ্যের সম্ভাব্য উত্তরাধিকারী শাহাজাদা, অন্যান্য শাহজাদা তাঁর ডান দিকে উপাসনার জন্যে বসতেন। সব আয়োজন শেষ হলে তিনি ইমামকে খুতবা পড়তে নেওতা দিতেন। ইমাম খুতবা পড়ার মঞ্চে দাঁড়াতেন। দারোগাইকুর, অস্ত্রাগারের সর্বাধ্যক্ষ ইমামের কোমরে একটি তরোয়াল ঝুলিয়ে দিতেন। ইমাম তরোয়ালের বাঁট ধরে খুতবা পড়া শুরু করতেন।

সম্রাটকে নিয়ে ঈদের শাহী মিছিল

খুতবা পড়া শেষ হলে, [মুঘল সাম্রাজ্যের] বেহেস্তে যাওয়া প্রত্যেক সম্রাটের নাম একে একে উচ্চারণ করা হত। নামগুলি সারিবদ্ধভাবে পাঠের পর যখন বর্তমান শাসকের নামোচ্চারণের সময় আসত, তখন খেলাত দেওয়ার সর্বাধ্যক্ষ্য এগিয়ে এসে ইমামকে একটি খেলাত দান করতেন। ইমাম এখন অঙ্গীকার করা শুরু করলেন। এরপর ধর্মসভার উপাসনা শুরু হত। খুতবা পড়ার পরে ইমাম শুক্রবারের নামাজ শুরু হওয়ার সময়ের দুটি রাকাত (নামাজ পড়ার সময় নির্দেশিত নড়াচড়া এবং শব্দ) পড়তেন।

বাদশার উপাসনা শেষ হলে, তাঁকে আছর শরিফের (একটি ছোট ঘর যেখানে নবীর স্মৃতি অবশেষ রাখা থাকে। জামে মসজিদের একটি গ্যালারিতে এটি এখনও রয়েছে) সামনে নিয়ে যাওয়া হয়। তিনি নবীর স্মৃতি অবশেষগুলিকে সম্মান জানিয়ে কেল্লার প্রাসাদে ফিরে যেতেন।

১৭৮৫ তে লাল কেল্লা

রমজানের ২৯ তম দিনে চাঁদ দেখার জন্যে প্রতিনিধি পাঠানো হত। প্রত্যেকেই চাঁদ দেখার জন্যে অধীর আগ্রহে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতেন। এই আচারটাই রমজানের শেষ হওয়ার ইঙ্গিতবাহী। যদি কেউ চাঁদ দেখতেন, অথবা কোনও গ্রাম থেকে চাঁদ দেখার স্বাক্ষরিত বার্তা এসে পৌঁছত, শুরু হত উৎসবের কাল। নাকাড়াখানা থেকে ২৫টা তোপধ্বনি করে পরের দিনের ঈদের উৎসবের বার্তা দেওয়া হত। সেই রাতে যদি চাঁদ দেখা না যেত তাহলে রমজানের ১৩ তম দিনে কামান দাগা হত।

ইদুলফিতর

রাতেই ইদগাতে কামান, শামিয়ানা আর গালিচা পাঠানো হল। হাতির গায়ে রংবেরঙের ছবি আঁকার পর্ব শুরু হয়। প্রভাত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাদশা রাতের জামাকাপড় পাল্টে স্নান করে তাঁর মণিরত্নে ভরা শাহী পরিধেয় এবং তুল্যমূল্য গয়নাগাটি পরিধান করেন। তার সামনে দস্তরখান [টেবলে পাতা চাদর] বিছিয়ে তার ওপরে সেমাই দুধ, মিষ্টান্ন এবং মোমবাতি আর প্রচুর শুকনো ফল এবং সাদা ভাত সাজিয়ে দেওয়া হয়। এগুলোর ওপরে ভাঙা সবুজ ছোলা ছিটিয়ে দেওয়া হয়। দেবসেবায় উতসর্গীত খাদ্যদ্রব্যে বাদশা তাঁর সমস্ত ভাবনা চিন্তা নিবদ্ধ করেন। একে একে তিনি প্রত্যেকটি খাদ্যদ্রব্যের স্বাদ গ্রহণ করতে শুরু করেন। খাদ্যগ্রহন অনুষ্ঠান শেষে হাত মুখ ধুয়ে তিনি বাইরে বেরোন। তাঁকে বেরোতে দেখে জাসলনি মুহূর্তের মধ্যে চিৎকার করে সম্রাটের উপস্থিতির সংবাদ জানিয়ে দিতে থাকে। তিনি জনসম্মিলনে যোগ দেন ট্রাম্পেটের আওয়াজের মধ্যে। উৎসবের মিছিল শুরু হয়।

বাহাদুর শাহ জাফরের শাহী চিহ্ন

ফৌজদার খান হাতিকে হাঁটু গেড়ে করে বসায়। হাতির থেকে এক ফুট দূরত্বে একটি সূক্ষ্ম কারুকার্যময় হাওয়াদার কেদারা রাখা হয়। বাদশাকে নিয়ে হাতি সহ মিছিলটি এবারে দেওয়ানিআমের দিকে চলতে শুরু করে। তাঁর সম্মানে ২১ বার তোপধ্বনি চলতে থাকে বারংবার। এবারে তিনি ঈদগার দিকে চললেন। তিনি আসার আগে ইদগাকে দুইভাগে ভাগ করা হয়েছে। কামান আবার গর্জন করে নতুন করে তাঁর উপস্থিতি জানান দেয়। তিনি হাতি থেকে নেমে দাঁড়ান। হাওয়াদার বাহিত হন। তাঁর উত্তরাধিকারী সম্মানিত ব্যক্তিদের বয়ে নিয়ে যাওয়ার পালকি, নালকিতে বসেন। সক্কলে হেঁটে চলে।

বাদশা উৎসব মঞ্চ থেকে নেমে আসেন। ইদগাতে তৈরি করা তাঁর শিবিরের দিকে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয়। তিনি শাহী তাঁবুতে গিয়ে প্রবেশ করেন। এখানে তাঁর উপাসনার জন্যে উদ্দিষ্ট মাদুরটি পেতে রাখা হয়েছে। মুয়াজ্জিন তকবির, আল্লাহু আকবর হেঁকে ওঠেন। প্রত্যেকে সার করে দাঁড়িয়ে ইমামের সঙ্গে নামাজ পড়তে শুরু করেন। নামাজের পরে প্রত্যেক উপাসক চলে যান। শুধু থাকেন সম্রাট আর তাঁর সম্ভাব্য উত্তরাধিকারী। ইমামকে আবার খুতবা পড়তে নির্দেশ দেওয়া হয়। দারোগাইকুর, অস্ত্রাগারের সর্বাধ্যক্ষ নতুন করে ইমামের কোমরে একটি তরোয়াল ঝুলিয়ে দিতেন। ইমাম তরোয়ালের বাঁট ধরে খুতবা পড়া শুরু করতেন। বাদশার নাম উচ্চারনের সময় এলে খেলাত দেওয়ার সর্বাধ্যক্ষ্য ইমামকে আবারও একটি খেলাত দান করতেন। এবারে খুতবার সম্মানে একটি তোপের সালামি দেওয়া হয়। হাওদাওয়ালা হাতি নেগদম্বর এগিয়ে আসে, বাদশা কেল্লার দিকে রওনা হয়ে যান। কেল্লায় পৌঁছে তিনি ময়ূর সিংহাসনে উপবিষ্ট হয়ে দেওয়ানিখাসএ দরবার শুরু করেন। প্রত্যেকে তাঁকে সম্মান জানিয়ে নজরানা দেওয়া শুরু করেন এবং তিনি সকলকে মালা আর রাজত্বের চিহ্নওয়ালা পাগড়ি উপহার দেন। দেওয়ানিখাসএ দরবার শেষে তিনি জেনানান মহলে প্রবেশ করলে তাঁকে রূপোর সিহাসনে বসানো হত। এরপর জেনানা থেকে একের পর এক মহিলা বার হয়ে এসে তাঁকে নজরানা দিতেন।

কভারের ছবি : জামা মসজিদের সামনে শাহী জমায়েত