মুঘলরা ছিলেন মধ্য এশিয়ার এক যাযাবর জাতি। তারা প্রাথমিক অবস্থায় যেখানকার বাসিন্দা ছিলেন, সেখানে হাতি নামের কোনো প্রাণীর অস্তিত্বই ছিলো না। তারা ছিলেন অশ্বারোহী জাতি। ভারতীয় উপমহাদেশে আসবার পর এখানকার ঋতুবৈচিত্র্য, এর প্রকৃতি, সমস্ত কিছুই তাদেরকে বিস্মিত করেছিলো। বিশেষ করে হাতি সম্পর্কে তাদের আগে কোনো অভিজ্ঞতা ছিলো না বলে ভারতবর্ষে হাতির রাজকীয় চাল-চলন, আকারেরর বিশালতা ও বৈচিত্র্যপূর্ণ আচরণ তাদেরকে এক মুগ্ধকর জগতে নিয়ে গেলো। এ কারণে ভারতবর্ষে এসে হাতিশালা গড়ে তুললেন তারা এবং দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে নানা জাতের বিস্ময়কর হাতিগুলোকে তাদের হাতিশালায় সংগ্রহ করতে শুরু করলেন।

আবুল ফজলের লেখা ‘আইন-ই-আকবরী’-তে হাতির সঙ্গে সম্রাট আকবরের সম্পর্ক কতোটা গভীর ছিলো, তার একটি বিশদ বর্ণনা পাওয়া যায়। আকবরের জন্য ১০০ টিরও বেশি হাতি রাখা হতো। তার নিজের চলাচলের জন্য রাখা হাতিটিতে মাঝে মাঝেই তিনি চড়ে বসতেন, কোনো মাহুতের সাহায্য ছাড়াই। এই হাতিকে নিয়ে নানা রকম মজাদার খেলা ও কলাকৌশল দেখিয়ে সমস্ত হস্তী-বিশারদ এবং অমাত্যদেরকে সম্রাট একেবারে চমকে দিয়েছিলেন।

আকবর, হুমায়ুন বা বাবর –এদের মধ্যে কারো সময়েই পূর্ব বাংলাকে জয় করা সম্ভব হয় নি। বাংলা জয় সম্ভব হয়েছিলো সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমলে এবং ইসলাম খান তা করে দেখিয়েছিলেন। ইসলাম খান যখন বারো ভূঁইয়াদের সঙ্গে যুদ্ধে জয়লাভ করলেন, তখন পরাজিত বারো ভূঁইয়াদের জন্য তার নির্দেশ ছিলো, যতো দাঁতালো হাতি আছে সমস্তটাই তুলে দিতে হবে সুবাদারের প্রতিনিধিদের কাছে। মুসা খান, ওসমান খান -এদের কাছ থেকে পাওয়া হাতিগুলোকে পরবর্তীতে শাহী দরবারে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিলো।

মুঘলদের হাতি-প্রীতি এই ছবি দেখলে বুঝা যায়

সম্রাট জাহাঙ্গীরে তার পছন্দের হাতিতে

সম্রাট জাহাঙ্গীর সম্পর্কে আমরা জানতে পেরেছি তার নিজের লেখা স্মৃতিকথা থেকে। এ ছাড়াও অন্যান্য মুঘল ঐতিহাসিকও তার হাতি-প্রীতি সম্পর্কে অনেক বর্ণনা দিয়েছেন। জানা গিয়েছে, বাংলার সুবাদারদেরকে তিনি নিয়মিত নির্দেশ পাঠাতেন বাংলা থেকে আরো অনেক সংখ্যক হাতি মুঘল দরবারে পাঠিয়ে দেয়ার জন্য। সুবাদারদের বিজিত রাজ্য পরিচালনার সাথে সাথে ঐ রাজ্যের হাতিগুলোকেও সংগ্রহ করে কেন্দ্রে পাঠিয়ে দেয়ার নিয়ম ছিলো। এটি তাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ ছিলো। এই প্রক্রিয়া পালন করতে গিয়ে কামরূপের পাহাড়, আসাম ও ত্রিপুরার রাজাদের সাথে তাদের অনেক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে হয়েছে। এই ঘটনা ‘বাহারিস্তান-ই-গায়েবী’ ও সম্রাট জাহাঙ্গীরের স্মৃতিকথা ‘তুজুক-ই-জাহাঙ্গীরি’-তে অনেক সুন্দর করে বর্ণনা করা আছে।

প্রকৃতিপ্রেমী সম্রাট জাহাঙ্গীরের পশু-পাখি সম্পর্কে কৌতুহল ছিলো সীমাহীন এবং সে কারণে বিভিন্ন রাষ্ট্র থেকে আসা অ্যাম্বাসেডাররা তাকে নানা রকমের পশু-পাখি উপহার দিয়ে মুগ্ধ করার চেষ্টা করতেন। প্রাণী সম্পর্কে প্রচুর পড়াশোনা করতেন সম্রাট জাহাঙ্গীর। আর এভাবেই তিনি সাদা হাতি সম্পর্কে জানতে পেরেছেন।

সম্রাটের হাতিশালে হাতির কোনো অভাব ছিলো না, কিন্তু সাদা হাতি সম্বন্ধে জানবার পর থেকে একটি সাদা হাতির অভাব বোধ করছিলেন তিনি। আর সাদা হাতি শুধু ভারতবর্ষেই বিরল নয়, বরঞ্চ মায়ানমার ও থাইল্যান্ডেও সাদা হাতি তেমন একটা পাওয়া যেতো না। কৌতুহলী ও জেদী সম্রাটের জন্য একটি সাদা হাতি সংগ্রহের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন জায়গায় গোয়েন্দা পাঠানো হলো এবং অবশেষে জানা গেলো, আরাকান রাজার কাছে একটি সাদা হাতি রয়েছে। এ ক্ষেত্রে বিদেশী বণিকদের লেখা গল্পগুলো তার কৌতূহলকে নিবৃত্ত করতে যথেষ্ট শক্তিশালী ভূমিকা পালন করলো।

মুঘলদের হাতি-প্রীতি আরেক হাতি নাম খুশি খান

মুঘলদের হাতি খুশি খান, ১৬৬০

মগ রাজার কাছে যে একটি সাদা হাতি রয়েছে, পর্তুগিজ পাদ্রী সেবাস্টিয়ান ম্যানরিক তা লিখে গিয়েছিলেন। ম্যানরিক ১৬৩০ সালে আরাকানে বেড়াতে গিয়ে এই সাদা হাতি দেখেছিলেন বলে মনে করা হয়। ম্যানরিকের লেখা থেকেই সম্রাট জাহাঙ্গীর এই হাতি সম্পর্কে জানতে পেরেছিলেন।

সম্রাট সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন, সেই হাতি তার চাই-ই চাই। কি করে সেই হাতি পাওয়া যাবে, তা নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে শুরু করলেন তিনি।

ড.আব্দুল করিম তার ‘হিস্ট্রি অফ বেঙ্গল, মুঘল পিরিয়ড ভলিউম-১’ –এ সাদা হাতি সম্পর্কে বিশাল বর্ণনা দিয়েছেন। তার মতে, সাদা হাতি অবশ্যই একটি বিরল প্রাণী। বৌদ্ধ ধর্মে সাদা হাতি এক বিশেষ মর্যাদার অধিকারী। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী মানুষেরা বিশ্বাস করতেন, গৌতম বুদ্ধই সাদা হাতি হিসেবে জন্মেছেন। সুতরাং এই সাদা হাতি যার কাছে থাকবে, তিনি নিশ্চয়ই অত্যন্ত সম্ভ্রান্ত ও গর্বিত কেউ হবেন। যে কোনো রাজা বা সম্রাট-ই যে এই প্রাণীটিকে নিজের করে পেতে চাইবেন, এটাই স্বাভাবিক।

সাদা হাতি চেনার একটি বিশেষ উপায় হলো, এই হাতির পেছনের পায়ে পাঁচটি নখ থাকবে। আরো একটি উপায় রয়েছে। সাদা হাতির গায়ে পানি ঢাললে এর গায়ের চামড়া লাল হয়ে ওঠে। আর সাধারণ হাতির গায়ে পানি ঢাললে চামড়া আরও বেশি কালো হয়ে ওঠে।

রাসেল ফিচ ১৫৮৬ সালে ব্রহ্মদেশ পেগুতে একটি সাদা হাতি দেখেছেন বলে নিজের বইতে বর্ণনা করেছেন। হাতিটি থাইল্যান্ড থেকে লুট করে আনা হয়েছিলো। তিনি তাজ্জব হয়ে গিয়েছিলেন হাতিটির যত্নের প্রক্রিয়া দেখে। হাতিটির পরিচর্যা ও দৈনন্দিন খাবার তৈরীর জন্য অসংখ্য ভৃত্যকে নিয়োগ করা হয়েছিলো। প্রথমে হাতিটিকে একটি নরম কুশনের মধ্যে বসানো হতো। তার জন্য খাবার এবং পানি নিয়ে আসা হতো সোনা ও রূপার পাত্রে। হাতিটিকে গোসল করানোর জন্যও ছিলো বিশাল এক ভৃত্য বাহিনী। এমন চমৎকার বিশাল প্রাণী সংগ্রহে সম্রাট জাহাঙ্গীরের মতো বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ যে আগ্রহী হবেন, তাতে আর আশ্চর্য কি!

মুঘলদের হাতি-প্রীতি এত ছিলো যে তারা শিকারে যেত হাতি নিয়ে

১৬০২ খ্রিস্টাব্দে যুবরাজ সেলিম (সম্রাট জাহাঙ্গীর) শিকার থেকে একটি হাতিতে ফিরে আসেন

১৬১১ সালে ইসলাম খান ভুলুয়া দখল করে নেন। ফলে রাজা অনন্ত মানিক্য আরাকানে চলে যান। তখন থেকে মুঘলদের সীমানা ফেনী নদী পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে যায়। বারো ভূঁইয়াদের দমন কাজ ইতিমধ্যেই শেষ। বাংলা জয় হয়ে গেছে। তাই জাহাঙ্গীর মনোযোগ দিলেন বাংলার সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলোর ওপরে এবং তার প্রথম দৃষ্টি গিয়ে পড়লো আরাকান রাজ্যে। কারণ সেখানেই আছে তার কাঙ্ক্ষিত সাদা হাতি।

সম্রাট নির্দেশনা পাঠালেন, যে কোনো মূল্যে সাদা হাতিটিকে তার আস্তাবলে নিয়ে আসতে হবে। শুধুমাত্র একটি হাতি পাবার জন্য কোনো রাষ্ট্রের সাথে যুদ্ধে জড়ানোর বিষয়টি অবাস্তব মনে হতে পারে। কিন্তু ‘বাহারিস্তান-ই-গায়েবী’ -তে মির্জা নাথান এই ‘নির্দেশনা’ শব্দটিই সম্পূর্ণভাবে তুলে দেয়ার ফলে আমরা জাহাঙ্গীরের ‘হুকুম’ সম্পর্কে একেবারে বিশদভাবে জানতে পেরেছি। তার সেই হুকুমটি তুলে ধরা হলো, “সুবাদার কাশেম খানকে আরও চেষ্টাশীল এবং অধিক কর্মতৎপর হতে হবে, যাতে সর্ব ইচ্ছা পূরণকারী মহান আল্লাহর অনুগ্রহে তিনি আরাকান অভিযানকে একটি আনন্দময় পরিণতির দিকে নিয়ে যেতে সক্ষম হন। মগ রাজার সাদা হাতিটিকে বন্দী করে মহান শাহী দরবারে পাঠানোর আদেশ দেয়া হলো”।

সুবাদার কাশেম খান যদি এই হাতিটি সম্রাটের কাছে পৌঁছে দিতে পারতেন, তাহলে অবশ্যই মুঘল দরবারে তার সম্মান বহুল অংশে বেড়ে যেতো। কিন্তু তার পক্ষে এই সম্মান অর্জন করাটা সহজ হয় নি। সেই যুদ্ধ পরিচালনায় কিছু ভুল সিদ্ধান্ত নেয়ার ফলে তিনি চরমভাবে পরাজিত হন। মুঘল বাহিনী যুদ্ধের এই পরিণতিতে ভীষণ লাঞ্ছিত হয়। তাই সাদা হাতি পাওয়ার সম্ভাবনায় গুড়ে বালি।

মুঘলদের হাতি-প্রীতি

প্রিন্স আওরঙ্গজেব 1633 সালে উন্মত্ত যুদ্ধের হাতি সুধাকরের বিরুদ্ধে চড়ছেন।

তবে সুবাদার হিসেবে কর্মরত অবস্থায় কাশেম খান বিভিন্নভাবে চেষ্টা করেছিলেন সম্রাটকে সাদা হাতিটি উপহার দিতে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা করতে পারেন নি তিনি। ১৬১৭ সালে তাকে পদচ্যুত করে নিজ দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় এবং তার জায়গায় ইব্রাহীম খান ফতেহকে দেয়া হয় বাংলার সুবাদারের দায়িত্বে। কাশেম খানের পর ইব্রাহীম খানও একই উদ্দেশ্য নিয়ে পথ চলতে শুরু করেন। যেভাবেই হোক, সাদা হাতিটিকে জয় করতেই হবে। আর এর জন্য যুদ্ধ ছাড়া এই হাতি পাবার আর কোন উপায় তিনি দেখলেন না। যুদ্ধ করবার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন তিনি।

ইব্রাহীম খান বুঝতে পেরেছিলেন, আরাকানে অভিযান চালাতে হলে তাকে প্রথমে মগদের দখলকৃত চট্টগ্রাম, ত্রিপুরা ও সীতাকুণ্ড জয় করতে হবে। বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে তিনি ত্রিপুরার মধ্য দিয়ে যাবেন বলে স্থির করলেন। কারণ ত্রিপুরাবাসী তাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে বলে কথা দিয়েছে।

ইব্রাহীম খান শুরু করলেন তার যাত্রা। কিন্তু এই পাহাড়-পর্বত ডিঙ্গিয়ে জঙ্গল সাফ করে সেখানে পৌঁছাতে পৌঁছাতে তার রসদ শেষ হয়ে গেলো। অনেক সৈন্যও মারা গেলেন। ঘোড়াগুলো নিয়ে বিপাকে পড়লেন তিনি এবং আরো একবার সাদা হাতি অর্জনের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলো।

আসলে শুধুমাত্র সাদা হাতি অর্জনের জন্য না হলেও মগদের পরাজিত করা খুব জরুরি ছিলো। সে সময় মগদের অত্যাচারে মুঘলদের এই বঙ্গ অতিষ্ঠ হয়ে গিয়েছিলো। পরবর্তীতে অবশ্য শায়েস্তা খান চট্টগ্রাম দখল করে মগদের বিতাড়িত করেছিলেন। কিন্তু সম্রাট জাহাঙ্গীরের অতিকাঙ্ক্ষিত সেই সাদা হাতি পাবার স্বপ্ন অধরাই রয়ে গিয়েছিলো।

 

রেফারেন্সঃ সম্রাট জাহাঙ্গীর ও সাদা হাতি