মহাভারতের পাতায় পাতায় অসংখ্য রাজ-রাজরা, বীর যোদ্ধা, রথী-মহারথীর বীরত্বগাথাঁ লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। যুগে যুগে চারণকবিদের কবিতার ছন্দে তাঁদের কিংবদন্তীর আখ্যান অমর হয়ে আছে। নানা বৈচিত্র্যময় কাহিনীতে ভরপুর এই বিশাল মহাকাব্যে যেমন পান্ডব শ্রেষ্ঠ মহানায়ক অর্জুনের বীরত্বের কাহিনী পাওয়া যায়, তেমনি পাওয়া যায় খলনায়ক হিসেবে কুরুবংশের জ্যেষ্ঠ রাজপুত্র দুর্যোধন, কপটচারী শকুনীর নানা শঠতা ও কূটকৌশলের কাহিনী, কর্নের ঔদার্য ও মহানুভবতার গাঁথা ইত্যাদি। মোটের উপর তাঁরা ছিলেন সেইসময়ের এই ভারতীয় উপমহাদেশের দুর্দান্ত প্রতাপশালী আর্যদের প্রতীভূ। রাজাদের কাহিনীতে এদেশের সাধারন খেটে খাওয়া সেইসমস্ত মানুষের গল্প খুব একটা পাওয়া যায় না, যারা পরিচিত ছিলো অনার্য নামে। আর্যরা নিজেদের প্রভাব ও ক্ষমতাকে প্রতিষ্ঠা করতে সমাজে চালু করেছিলো বর্ণপ্রথার মতো এক জগদ্দল প্রথা। যেখানে মানুষের মর্যাদা, পেশা নির্ধারন হতো তার জন্মের দ্বারা।নিজপ্রতিভা ও কর্মের মাধ্যমে কেউ সমাজে প্রতিষ্ঠা পেতে চাইলে তাকে অবদমিত করা হতে সমাজের তৎকালীন বিধিবিধান দ্বারা। একলব্যের কাহিনী যেনো আমাদের সেই কথাই মনে করিয়ে দেয়। “মহাভারত” এর অসংখ্য বর্ণময় চরিত্রের মধ্যে একলব্য যেনো কালের গর্ভে বিস্তৃত একচরিত্র। কিন্তু যিনি স্বীয় প্রতিভা, অধ্যাবসায়, গুরুভক্তি, আত্মত্যাগের দ্বারা অন্যান্য সবাইকে যেনো ম্লান করে দিয়েছেন।

তৎকালীন আর্যাবর্তে অন্যতম শক্তিশালী রাজ্য হস্তিনাপুরের রাজপুত্রদের অস্ত্রগুরু মহর্ষী ভরদ্বাজ পুত্র মহারথী দ্রোণ। যিনি শুধুমাত্র রাজপুত্রদেরই অস্ত্রশিক্ষা দেন। তাঁর সবচাইতে প্রিয় শিষ্য হচ্ছেন পান্ডব কুমার অর্জুন। দ্রোণাচার্য তাঁর প্রিয় শিষ্যকে কথা দিয়েছিলেন যে তিনি তাঁকে আর্যাবর্তের শ্রেষ্ঠ ধনুর্বীর হিসেবে গড়ে তুলবেন। সেইমতোই তাঁর অস্ত্রশিক্ষার পাঠদান চলছিলো। আচার্য্য দ্রোণের খ্যাতির কথা শুনে একদিন তাঁরকাছে ধনুর্বিদ্যা শেখার আগ্রহ নিয়ে এলো এক সাধারন কিশোর। তাঁর সাধারন বেশভূষা দেখে দ্রোণ নিশ্চিত হলেন যে এই ছেলে কোনোও রাজার ছেলে নয়। ছেলেটি তাঁর পরিচয় দিলো একলব্য নামে। দ্রোণ আরও জানতে পারলেন সে নিষাদরাজ হিরন্যধনুর পুত্র একলব্য। এই হিরন্যধনু আবার হস্তিনাপুরের শত্রুরাজ্য মগধরাজ জরাসন্ধের সেনাপতি হিসেবে ও কাজ করতেন। যদিও একলব্যের পিতা হিরন্যধনু একজন রাজা ছিলেন, কিন্তু তিনি জাতীতে ছিলেন অনার্য যাদের আর্যরা নাম দিয়েছিলেন “নিষাদ” নামে।

দ্রোণাচার্য

এই নিষাদরা অরণ্যচারী ছিলো এবং তাদের বৃত্তি ছিলো জংগলের পশুপাখি শিকার। সেইসময়ে প্রথা ছিলো শুদ্র তথা অনার্য কেউ ধনুর্বিদ্যা রপ্ত করতে পারবে না। আর ক্ষত্রিয়দের মাঝে ধনুর্বীররাই বিশেষ মর্যাদার অধিকারী হতেন। সামাজিক বিধির নিষেধাজ্ঞার পাশাপাশি দ্রোণ আরোও একটা ব্যাপারে চিন্তা করলেন। যদি তিনি একে ধনুর্বিদ্যার শিক্ষা দেন তবে সে পরবর্তীতে বড় যোদ্ধাতে পরিনত হয়ে হস্তিনাপুরের জন্য হুমকি হতে পারে। কারন একলব্যের সাথে কথা বলে দ্রোণ তার প্রতিভার কিছুটা আঁচ করতে পেরেছিলেন। তিনি একলব্যকে বিদ্যা শিক্ষা দিতে নিজের অপারগতা সাফ জানিয়ে দেন। এতে একলব্য প্রচন্ড কষ্ট পায়। সে অবাক হয়, একজন গুরু কিভাবে একজন আগ্রহী শিষ্যকে খালি হাতে ফিরিয়ে দিতে পারেন…??? তার ধারনা ছিলো গুরু হৃদয় সমুদ্রের মতো বিশাল। কিন্তু আচার্য দ্রোণ তাঁকে এইভাবে বিমুখ করবেন তা সে ভাবতেও পারে নি। বড় আশা করে অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে এসেছিলো সে গুরুর কাছে কিন্তু সেই গুরু এইভাবে তাকে ফিরিয়ে দেবে ভাবতেই পারে নি কখনও। সে যে মনে প্রাণে আচার্য দ্রোণকেই তার গুরু হিসেবে ভেবে এসেছে। ব্যার্থ মনোরথে একলব্য দ্রোণের পায়ে মাথা রেখে প্রণাম করে তাঁর কাছ থেকে বিদায় নেয়।হতাশাগ্রস্ত, ক্লান্ত-শ্রান্ত একলব্য গহীন জংগলে আত্মগোপন করে। সেখানে সে তার পর্ণ কুটিরে নিজের স্বপ্নভঙ্গের কথা ভাবতে লাগল। জন্মের উপর তো কারোর হাত থাকে না। সে তো স্বয়ং নিজের কূল নির্ধারন করে নি। পরক্ষণেই তাঁর মনে চিন্তা এলো সে তো দ্রোণাচার্যকে নিজের গুরু হিসেবেই মেনে এসেছে। তার মনের মধ্যে তো গুরুদেব আছেনই। তাঁকে তো সে অস্বীকার করতে পারবে না। গুরুদেব যে তাঁর কল্পনায় আছেন। দ্রোণাচার্যের সেই মানসরুপকে মনে মনে অন্জলি দিয়ে একলব্য কঠোর সাধনা আরম্ভ করলো।গুরুদেব এর এক মৃন্ময় মূর্তি তৈরী করে তাঁকে উপস্থিত ভেবে দিনরাত নির্ভুল লক্ষ্যে বাণ চালনার অনুশীলন শুরু করলো একলব্য । তাঁর একটাই লক্ষ্য, একটাই অভিপ্রায়।

দ্রোনাচার্যের মূর্তির সামনে একলব্য source: bp.blogpost.com

নির্ভুল নিশানায় বাণ তাকে চালাতেই হবে। এভাবেই কঠোর অনুশীলনে দিন, মাস, বছর অতিবাহিত হয়। একাগ্রচিত্তে নিবিড় অনুশীলনে ধনুর্বিদ্যায় অসামান্য পারদর্শিতা অর্জন করে একলব্য। ঐদিকে দ্রোণাচার্যের আশ্রমেও তাঁর শিষ্যদের মধ্যে অর্জুন ধনুর্বিদ্যায় সকলকে ছাড়িয়ে যায়। এরমধ্যে একদিন কুরুরাজপুত্ররা তাদের আশ্রমের বাইরে মৃগয়ায় যায়। তাঁদের সাথে একটি কুকুরও ছিলো । কুকুরটি ঘুরতে ঘুরতে একলব্যের কুটিরের কাছে এসে অনুশীলনরত একলব্যকে দেখে চিৎকার করে ডাকাডাকি শুরু করে। এতে মন:সংযোগের বিঘ্ন ঘটায় একলব্য সাতটি বাণ দিয়ে নিপুণতার সাথে কুকুরের জিহ্বায় ছিড়ে দিলো যাতে কুকুরটি প্রাণে মরলো না আবার ডাকতেও পারলো না। এই অবস্থায় কুকুরটি দৌড়ে অর্জুনের কাছে পৌছে যায়।

কুকুরের জিহ্বায় এতো নিঁখুত বাণ চালনা দেখে অর্জুন হতবাক হয়ে যায়। এতদিন ধরে সে জেনে আসছে যে, সে ই শ্রেষ্ঠ ধনুর্বীর হবে, কিন্তু এই কার্য তো তাঁরও অসাধ্য। কুমার অর্জুন দ্রোণাচার্যের কাছে গিয়ে অনুযোগ করলেন যে এ কোন কুশলী ধনুর্বীরের কাজ। দ্রোণাচার্য অর্জুনকে অভয় দিয়ে তাকে সাথে নিয়ে খুজে খুজে একলব্যের আস্তানায় গিয়ে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলেন। তার মাটির মূর্তির সামনে দীর্ঘ,জটাযুক্ত,চুল দাড়ির সেই ছেলেটি বাণচালনার অভ্যাস করছে,যাকে তিনি অস্ত্রশিক্ষা দিতে অস্বীকার করেছেন।

তিনি বুঝতে পারলেন যে নিজের নিষ্ঠা আর অধ্যাবসায় দিয়ে ছেলেটি নির্ভুল নিশানা ভেদে সক্ষম হয়েছে। একলব্য ও জানালো যে তার বিদ্যা শিক্ষা আচার্য দ্রোণেরই দান, তাঁকেই সে গুরু হিসেবে জেনেছে। দ্রোণ ছেলেটির অধ্যাবসায়, একাগ্রতা ও গুরুভক্তি দেখে অবাক হলেন। এ যদি সত্যিকারে তাঁর কাছে অস্ত্রবিদ্যা শিখতো তাহলে যে কি হতো তাই তিনি ভাবলেন। কিন্তু নিজের প্রিয় শিষ্য অর্জুনকে দেয়া কথা রাখতে গিয়ে বা নিজের জাত্যাভিমানের কারনে একলব্যের এই প্রতিভাকে তিনি থামিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। দ্রোণ এইবারে চাললেন মোক্ষম চাল , তিনি গুরুদক্ষিণা চাইলেন একলব্যের কাছে। একলব্যও রাজি হলো তাঁর প্রিয় গুরুদেবকে খুশিকরতে গুরুদক্ষিণা দিতে। দ্রোণ দক্ষিণা হিসেবে চাইলেন একলব্যের হাতের বুড়ো আংগুল। বিনয়ী একলব্য খুশিমনে পূরন করেছিলেন গুরুর চাওয়া। নি:সংকোচে ধারালো ছুরি দিয়েএকলব্য তার হাতের আংগুল ছেদন করে দ্রোণের সামনে সমর্পন করে। এরপর একলব্যকে পুনরায় বাণ চালনা করে লক্ষ্য ভেদের আদেশ দিলেন। একলব্য আগের মতো নির্ভুলভাবে বাণ চালাতে পারলো না। নিশ্চিন্ত হলেন দ্রোণ। তাঁর প্রিয় শিষ্য অর্জুনের আর কোনোও প্রতিদ্বন্দ্বী থাকলো না। এই ঘটনার পর দ্রোণ একলব্যের গুরুভক্তি, সরলতায় লজ্জা পেয়ে অনুতপ্ত হয়েছিলেন কিনা সে প্রসঙ্গে সুনির্দিষ্টভাবে জানা যায় না।

একলব্য গুরুদক্ষিণা

এরপর একলব্যও তার রাজ্যে গিয়ে নিষাদদের রাজা হন। কিছু কিছু বর্ণনায় পাওয়া যায় তিনি পরবর্তীতে বামহাত ও পা দ্বারা বাণচালনার অভ্যাস গড়ে তোলেন এবং এতেও তিনি সুদক্ষ হয়ে ওঠেন। তিনি যখন বাসুদেব শ্রীকৃষ্ণের দ্বারকা নগরীতে হামলা করার চেষ্টা করেন, তখন শ্রীকৃষ্ণ একলব্যের পরাক্রম থেকে যাদবদের বাচাঁনোর জন্য একলব্যকে বধ করেন। তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র কেতুমান নিষাদদের রাজা হন এবং পরবর্তীতে তিনি কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের সময় কৌরবপক্ষে যুদ্ধ করেন এবং ভীমের হাতে নিহত হন।

একলব্যের এই কাহিনী গুরুভক্তির, নিষ্ঠা-অধ্যাবসায়ের, আত্মত্যাগের। সবকিছু ছাপিয়ে একলব্য যেন অধিকারবঞ্চিত, শোষিত এই ভারত মায়ের ভূমিপুত্রদের প্রতিভূ। যিনি রুখে দাড়িয়েছিলেন বহিরাগত আর্যদের প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে। নিজের প্রতিভা ও শ্রমের দ্বারা সমাজে তাদের সমকক্ষ হওয়ার স্পর্ধা করেছিলেন, প্রতিষ্ঠা পেতে চেয়েছিলেন। তিনি যেনো এটাই প্রমান করতে চেয়েছিলেন যে “মানুষ তাঁর কর্মে বড় হয় জন্মে নয়”।

লেখকঃ  Khalid Mahbub Khan