মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের সুযোগে বহু বিদেশী শক্তি অস্থিতিশীল ভারতবর্ষে প্রবেশ করেছিলো। কিন্তু এই প্রতিযোগিতায় বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে নিজস্ব শাসন কায়েম করতে সক্ষম হয়েছিলেন ব্যাক্ট্রিয়া থেকে আসা ইন্দো-গ্রীক বা যবনরা এবং এই ইন্দো-গ্রীক সাম্রাজ্যের প্রধান শক্তি ছিলেন তাদের রাজা মেনিন্দার, যিনি অনেক সময় মিলিন্দা নামেও পরিচিত।
আলেকজান্ডার ভারতবর্ষ আক্রমণ করেছিলেন এবং ব্যর্থ হয়ে ফিরে গিয়েছিলেন —এই তথ্য যতোটা সুবিদিত, সেই আক্রমণের পর ভারতবর্ষের একাংশে যারা গ্রীক সাম্রাজ্যের বীজ বপন করেছিলেন, সেটি ততোটা আলোচিত নয়।
প্রখ্যাত মৌর্য সম্রাট চন্দ্রগুপ্তও রাজনৈতিক কৌশলের অংশ হিসেবে গ্রীকদের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন। সেই সূত্রে তার উত্তরপুরুষ সম্রাট অশোকও আংশিকভাবে গ্রীক বংশোদ্ভূত বলে ধারণা করেন গবেষকরা।
সম্রাট অশোকের মৃত্যুর পরই দুর্বল হতে শুরু করে মৌর্য সাম্রাজ্য এবং এতোদিনের স্থিতিশীল ভারতবর্ষ একটু একটু করে অস্থিতিশীলতার দিকে ধাবিত হয়। শেষ মৌর্য সম্রাট বৃহদ্রথ ছিলেন খুবই নরম প্রকৃতির মানুষ। বিদেশী গ্রীকদের সাথে বন্ধুত্ব এবং বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি তার অনুরাগ মেনে নিতে পারেন নি বৈদিক আদর্শে বিশ্বাসী তার সেনাধিনায়ক পুষ্যমিত্র শুঙ্গ। সুযোগ মতো বৃহদ্রথকে হত্যা করে মৌর্য সাম্রাজ্যের পতন ঘটিয়ে মগধের সিংহাসনে বসেন পুষ্যমিত্র শুঙ্গ।
ওদিকে আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর তার সেনাপতি সেলিউকাস নিকাতোরের বংশধরদের মাধ্যমে হিন্দুকুশ পর্বত ও আমু-দরিয়া নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত হয় ব্যাক্ট্রিয়া। গ্রীক বংশোদ্ভূত এই ব্যাক্ট্রিয়ানরাও এক সময় স্বাধীনতার দাবিতে বিদ্রোহী হয়ে ওঠেন, যার ফলে নিজেদের মধ্যেই অজস্র শত্রুতার জন্ম হয় সেখানে। স্বজাতির সুরক্ষার খাতিরে এই ব্যাক্ট্রিয়ান গ্রীকরা ভারতবর্ষের উত্তর প্রান্তের দিকে একটু একটু করে অগ্রসর হতে থাকেন।
বিদ্রোহী ব্যাক্ট্রিয়ানদের মাঝে একজন ছিলেন ইউথিডেমাস, যিনি স্বাধীন ইউথিডেমিড সাম্রাজ্যের সূচনা করেন। পরবর্তীতে তার ছেলে ডিমেট্রিয়াস ইউথিডেমিড সাম্রাজ্যের অধিপতি হন এবং বৌদ্ধাদর্শে দীক্ষিত মৌর্য সাম্রাজ্যের পতন তাকে আশঙ্কিত করে তোলে। বৌদ্ধাদর্শকে রক্ষার জন্যই হোক, কিংবা ভারতবর্ষে নিজেদের আধিপত্য বিস্তারের জন্যই হোক, কট্টর ব্রাহ্মণ শুঙ্গদের উচ্ছেদের উদ্দেশ্যে ভারতবর্ষের দিকে অগ্রসর হতে থাকেন ডিমেট্রিয়াস। আর ডিমেট্রিয়াসেরই একজন জেনারেল ছিলেন মেনান্দার।
মেনান্দারের জন্ম ‘ককেশাসে আলেকজান্দ্রিয়া’ বা বর্তমান ব্যাগ্রামের ‘কালাসি’ গ্রামে। ডিমেট্রিয়াসের মৃত্যুর পর ইউথিডেমিড জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে মেনান্দার পরবর্তী রাজা হিসেবে মনোনীত হন। তিনি ডিমেট্রিয়াসের মেয়ে আগাথোক্লিয়াকে বিয়ে করেন এবং ডিমেট্রিয়াসকে অনুসরণ করেই ভারতবর্ষে শাসন কায়মের জন্য মনস্থির করেন।
ইতিপূর্বে ডিমেট্রিয়াস হিন্দুকুশ পর্বত অতিক্রম করে গান্ধার ও তক্ষশীলা দখল করেছিলেন। বলা হয়, মেনান্দার আলেকজান্ডারের চেয়েও বেশি অঞ্চল জয় করেছিলেন এবং পাঞ্জাব জয় করার পর ভারতীয় উপমহাদেশের পশ্চিমে কাবুল উপত্যকা থেকে পূর্বে শুঙ্গ সাম্রাজ্যের অধীন পাটলিপুত্রের কিছু অংশ পর্যন্ত অধিকার করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তবে পরবর্তীতে কোনো কারণে তাকে পিছু হটতে হয়েছিলো এবং সাম্রাজ্যসীমা মথুরা পর্যন্তই সীমাবদ্ধ রাখতে হয়েছিলো।
মেনান্দার ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ ইন্দো-গ্রীক রাজা। তিনি তার সাম্রাজ্যের রাজধানী তক্ষশীলা থেকে সাকালায় স্থানান্তরিত করেছিলেন, যেটি বর্তমান শিয়ালকোটে অবস্থিত বলে ধারণা করা হয়।
ইন্দো-গ্রীক সাম্রাজ্যে হেলেনিস্টিক প্রশাসন ব্যবস্থা প্রচলিত হয়েছিলো। এর একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো, সেনাবাহিনী ও গ্রীক কলোনির ওপর নির্ভরশীলতা। রাজা ছিলেন এখানে সর্বোচ্চ শাসক। তবে রাজাকে যখন দূরের কোনো অভিযানে যেতে হতো, তখন তিনি সাধারণত তার ভাই, ছেলে বা ঘনিষ্ঠ কোনো আত্মীয়কে রাজ্য শাসনের ভার দিয়ে যেতেন। তবে চূড়ান্ত ক্ষমতাধর হিসেবে বিদেশী আগ্রাসনের হাত থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্য রাজাকে সেনাবাহিনীর ওপরই নির্ভর করতে হতো। সেনাবাহিনী গ্রীকদের জন্য নির্মিত কলোনিগুলোর নিরাপত্তা বিধান করতো। সুদূর গ্রীসে নগরের সুরক্ষার জন্য যে ব্যবস্থা নেয়া হতো, এখানেও সেই একই কায়দায় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হতো। ভারতবর্ষে এ ধরনের নগরের ধারণার প্রতিষ্ঠাতাও ছিলেন মেনান্দার। সুদূর ভারতবর্ষে থেকেও গ্রীক সংস্কৃতির মূল বৈশিষ্ট্যগুলো তিনি ধরে রেখেছলেন। পাশাপাশি ভারতীয় সংস্কৃতি, বিশেষত বৌদ্ধ ধর্ম দ্বারা তিনি বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন।
সে সময় অধিকাংশ গ্রীকরাই বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলেন। গ্রীক উপস্থিতির আগে বুদ্ধকে মানব রূপে চিত্রিত করা হয়নি, বরং প্রতীকীভাবেই দেখা হতো। ইন্দো-গ্রীকরাই এটি পরিবর্তন করেছিলেন এবং বুদ্ধকে মানব মূর্তিতে উপস্থাপন করেছিলেন। অ্যাপোলোডোটাস ও হারকিউলিসের মতো গ্রীক দেব-দেবীর মূর্তিগুলোকে তারা এর অনুপ্রেরণা হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন। এই গ্রীকো-বৌদ্ধ শিল্পটি চীন, কোরিয়া ও জাপান পর্যন্তও ছড়িয়ে পড়েছিলো।
সুসংগঠিত, জ্ঞানী, দক্ষ ও একজন বিশ্বস্ত পর্যবেক্ষক হিসেবে সুপরিচিত ছিলেন ইন্দো-গ্রীক রাজা মেনিন্দার। তিনি অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের বিষয়গুলো সম্পর্কে সঠিক সময়ে তার নিজস্ব পবিত্র স্তবক দ্বারা নির্দেশ দিয়ে সব অনুষ্ঠান পরিচালনা করতে সক্ষম ছিলেন। কলা ও বিজ্ঞান সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞান তার ছিলো। এ ছাড়াও দর্শন, গণিত, আইন, সঙ্গীত এবং চিকিৎসাবিদ্যাসহ অসংখ্য বিষয়ে পারদর্শী ছিলেন তিনি। চারটি বেদ, পুরাণ, ইতিহাস, জ্যোতির্বিজ্ঞান, যাদু, রণকৌশল ও কবিতাও ছিলো তার অধ্যয়নের বিষয়। এক কথায়, পুরো উনিশ কলায় পারদর্শী ছিলেন রাজা মেনিন্দার। তার সমকক্ষ হওয়া ছিলো কঠিন, তাকে অতিক্রম করা ছিলো অসম্ভব। বিভিন্ন বিদ্যাপীঠের প্রতিষ্ঠাতাদের চেয়েও শ্রেষ্ঠ বলে স্বীকৃত ছিলেন তিনি। যেমন তার জ্ঞান, তেমন তার দেহাবয়ব, তেমন তার গতি ও বীরত্ব। সমগ্র ভারতবর্ষে তার তুলনা করবার মতো কাউকে পাওয়া যায় নি। তিনি সম্পদ ও সমৃদ্ধিতে পরাক্রমশালী ছিলেন এবং তার সশস্ত্র বাহিনীর সংখ্যাও ছিলো অপরিমেয়। ভবিষ্যতের সমস্ত বিপদের জন্য তিনি ছিলেন সদা প্রস্তুত।
ভারতবর্ষে শাসন গড়ে তুলবার পর মেনিন্দার এমন একজন যোগ্য ব্যক্তির খোঁজ করতে থাকেন, যিনি যে কোনো বিতর্কে বা যে কোনো প্রশ্নে রাজাকে হারিয়ে দেবার সামর্থ্য রাখেন। এভাবে খুঁজতে খুঁজতে এক পর্যায়ে তিনি একজন জ্ঞানী বৌদ্ধ ভিক্ষুর কথা জানতে পারেন, তার নাম নাগাসেনা। নাগাসেনাকে তিনি প্রাসাদে আমন্ত্রণ করেন এবং একের পর এক প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করতে থাকেন, যার বেশিরভাগই ছিলো বৌদ্ধাদর্শ ও জীবনদর্শন সম্পর্কিত প্রশ্ন। নাগাসেনা প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর ধীরে-সুস্থে ধৈর্য সহকারে দেন। দিন গড়িয়ে রাত হয়ে যায়, তবুও চলতেই থাকে এ প্রশ্নোত্তর-পর্ব। অবশেষে প্রায় ২০০টি প্রশ্নের জবার পাবার পর সন্তুষ্ট হন মেনিন্দার। তিনি মানতে বাধ্য হন যে, এই বৌদ্ধ মুনি সত্যিই একজন জ্ঞানী ব্যক্তি। বৌদ্ধাদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনিও বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেন এবং ভারতবর্ষে বৌদ্ধ ধর্মকে সুরক্ষিত করবার দায়িত্ব নেন।
নাগাসেনার সাথে মেনিন্দারের এই প্রশ্নোত্তর-পর্বই পরবর্তীতে ‘মিলিন্দা-পানহা’ নামের বইতে সংকলিত হয় এবং মূলত এই বিখ্যাত বইটির মাধ্যমেই ইন্দো-গ্রীক রাজা মেনিন্দার সম্পর্কে আমরা জানতে পারি। বইটি ইংরেজিতে ‘কোয়েশ্চেনস অফ মিলিন্দা’ নামে অনুবাদ করা হয়েছিলো। এই বইটি বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের কাছে ধর্মশাস্ত্রের মতোই সম্মানিত।
রাজা মেনান্দার তার বুদ্ধিবৃত্তিক শাসন ব্যবস্থা ও আচরণের জন্য ভারতীয় প্রজাদের মধ্যেও ভীষণ জনপ্রিয় ছিলেন এবং তার মৃত্যুর পর শহরগুলোতে কাড়াকাড়ি পড়ে গিয়েছিলো যে, কোথায় হবে তার শেষ শয্যা। জানা যায়, তিনি নির্বাণ লাভ করেছিলেন এবং তার দেহাবশেষের ছাইগুলো প্রজাদের মধ্যে ভাগ করে দেয়া হয়েছিলো। প্রজারা তার ছাইয়ের প্রত্যেক অংশের ওপর স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করেছিলেন।
মেনিন্দার প্রায় ৩০ বছর ভারতবর্ষ শাসন করেছিলেন। তার মৃত্যুর পর ইন্দো-গ্রীক সাম্রাজ্যের একক সত্তাটি ভেঙে পড়েছিলো। তার সাম্রাজ্যটি বেশ কয়েকটি ছোট ছোট ভাগে বিভক্ত হয়ে গিয়েছিলো। বিভক্ত রাজ্যগুলো পরস্পরের আধিপত্য বিস্তার নিয়ে যুদ্ধ-বিগ্রহে লিপ্ত হয়ে গেলে কয়েক প্রজন্ম পর মেনিন্দারের প্রতিষ্ঠিত অতীত শক্তি নিঃশেষ হয়ে যায়।
তার স্ত্রী আগাথাক্লিয়া তাদের অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলে স্ট্র্যাটোর প্রতিনিধি হিসেবে শাসন করেছিলেন কিছুকাল। তবে তিনি শুধু স্বামীর রাজ্যের একাংশই শাসন করতে পেরেছিলেন। বাকি অংশটা ভাগ হয়ে গিয়েছিলো বিভিন্ন শাসকদের মাঝে। মেনান্দারের ছেলে স্ট্র্যাটো যখন রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নেন, তখন তিনি অযোগ্য প্রমাণিত হন এবং পদচ্যুত হন।
ইন্দো-গ্রীক রাজবংশের পরবর্তী উল্লেখযোগ্য সদস্য দ্বিতীয় অ্যাপোলোডোটাস, যিনি খ্রিস্টপূর্ব ৮৫ থেকে ৬৫ সাল পর্যন্ত শাসন করেছিলেন, তিনি একজন দক্ষ শাসক ছিলেন এবং তার সময় রাজ্যে কিছুটা স্থিতিশীলতা ও কর্তৃত্ব পুনরুদ্ধার সম্ভব হয়েছিলো। দ্বিতীয় অ্যাপোলোডোটাস সিথিয়ানদের কাছ থেকে তক্ষশীলা উদ্ধার করে প্রমাণ করেছিলেন যে, তিনি একজন দক্ষ সেনাপতিও বটে। দ্বিতীয় অ্যাপোলোডোটাসই ছিলেন সর্বশেষ শক্তিশালী ইন্দো-গ্রীক শাসক। তার শাসনামলের পরই ইন্দো-গ্রীক সাম্রাজ্যের শক্তি দ্রুত হ্রাস পেতে থাকে।
উত্তর দিক থেকে আসা আক্রমণকারী সিথিয়ানদের হাতে হাতছাড়া হয়ে যায় ইন্দো-গ্রীক সাম্রাজ্য। এভাবে ভারতবর্ষে মেনান্দারের হাতে নির্মিত সাম্রাজ্যটি ১০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত কোনোমতে টিকে ছিলো। তারপরই ধীরে ধীরে অবলুপ্ত হয়ে গিয়েছিলো।