আমরা বাংলাদেশের মানুষরা খানিকটা গান পাগলা! আমাদের দেশের আনাচে কানাচে কত ধরনের গান যে ছড়িয়ে আছে, এইসব গানে আছে গল্প, আছে চটুলতা, গভীরতা, আবার অতলস্পর্সী স্তব্ধতা। আনন্দ উৎসবে গানের একটা বিরাট ভূমিকা থাকে। আছে সুখের গান, দুঃখের গান, আনন্দের গান… কাজে ব্যস্ত থাকা মানুষও কাজের ফাঁকে ফাঁকে গান গেয়ে আনন্দ পায়। মাঝি নৌকা বাইতে বাইতে ধরে ভাটিয়ালী গান, রাখাল গরু চরানোর ফাঁকে বাঁশিতে তোলে সুর, গান মানুষকে দেয় এক চরম প্রশান্তি। আবার কিছু আছে পালাগান যার মধ্যে আছে প্রেমিক প্রেমিকার জীবন যুদ্ধের কাহিনী, ময়মনসিংহ গীতিকা এমনই একটি পালাগানের সংকলন। সাহিত্যে এর মূল্য অসীম। আজ এখানে আমরা কিছু প্রাচীন ও প্রচলিত পালাগানের কথা বলবো যার নাম ময়মনসিংহ গীতিকা মৈমনসিংহ গীতিকা হচ্ছে ময়মনসিংহ অঞ্চলের প্রাচীন পালাগানের সংকলন।এই পালাগানগুলো সেই আদিকাল থেকে মানুষের মুখে মুখে প্রচারিত হয়ে আসছে। ডক্টর দীনেশচন্দ্র সেন এই পালাগানগুলি শুনে সেগুলি সংকলনে আগ্রহী হন। ১৯২৩-৩২ সালে তিনি এই গানগুলো সম্পাদনা করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশ করেন। গীতিকার ভূমিকায় দীনেশচন্দ্র সেন বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনা আলোচনা করে ধারণা করেন পালাগানের মূল ঘটনা সত্য।
ময়মনসিংহের দুটি মহকুমা কিশোরগঞ্জ ও নেত্রকোনা হবার কারনে গীতিকাটির নাম হয় ময়মনসিংহ গীতিকা। এই গীতিকাটি বিশ্বের ২৩টি ভাষায় প্রকাশিত হয়। ড. দীনেশ চন্দ্র সেন গীতিকাগুলি সংগ্রহ করেন কবি চন্দ্র কুমার দে’র মাধ্যমে। চন্দ্রকুমার দে নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া থানার রঘুনাথপুরের অধিবাসী ছিলেন।ড. সেন প্রথম গীতিকা গুলির সাথে পরিচিত হন কিশোরগঞ্জের কেদারনাথ মজুমদারের মাধ্যমে, তিনিই প্রথম ‘ময়মনসিংহের ইতিহাস’ নামে একটি বই লিখেন, তিনি ‘সৌরভ’ নামে একটি পত্রিকা বের করতেন, যেখানে চন্দ্র কুমার দে’র লোক সাহিত্যের উপর বেশ কয়েকটি প্রবন্ধ ছাপা হয়। ১৯১৩ সালে সৌরভ পত্রিকায় মহিলা কবি চন্দ্রাবতীর উপর প্রকাশিত একটি প্রবন্ধ পড়ে মুগ্ধ হন ড. দীনেশ চন্দ্র সেন। পত্রিকার সম্পাদক কেদার নাথ মজুমদারের সহযোগীতায় তার চন্দ্র কুমার দে’র সাথে পরিচয় হয়, তারপর তাকে দিয়ে দিনের পর দিন গ্রামে গ্রামে ঘুরে গীতিকা গুলি সংগ্রহ করান।
ময়মনসিংহ গীতিকার বই প্রকাশিত হবার পর শিক্ষিত সমাজে এক অভূতপূর্ব সাড়া পড়ে যায়। অজ পাড়াগাঁয়ের মানুষেরা ও যে এত সুন্দর শিল্প সৃষ্টি করতে পারে প্রথমে তারা সেটা বুঝতেই পারেননি ! মৈমনসিংহ গীতিকা সমাদর পেলে দীনেশচন্দ্র সেন ময়মনসিংহ, নোয়াখালি, চট্টগ্রাম অঞ্চল থেকে আরও অনেক গীতিকা সংগ্রহ ও সম্পাদনা করে পূর্ববঙ্গ গীতিকা (১৯২৬) নামে মোট তিনটি খন্ডে প্রকাশ করেন। দীনেশচন্দ্র সেন ইংরেজি ballad-এর বাংলা পরিভাষা হিসেবে ‘গীতিকা’ শব্দটি নেন। বাংলা গীতিকা বর্ণনামূলক গীতি-আলেখ্য; তবে এতে প্রচুর নাটকীয় ঘটনার এবং চরিত্রের সংলাপও আছে। একজন গায়েন ঘটনার বিবরন করেন ও চরিত্র অনুযায়ি গান পরিবেশন করেন।দোহাররা ধুয়া গায় আর যন্ত্রীরা বাদ্যযন্ত্র বাজায়। গ্রামের সাধারণ মানুষেরাই এগুলি দেখেন এবং গীতিকার গীতিরস ও নাট্যরস উপভোগ করেন।
ময়মনসিংহ গীতিকা ইংরেজী ভাষায় অনূবাদ ও প্রকাশের পর বিদেশের মনীষী রোমা রোলাঁ, ড. সিলভা লেভি, স্যার জর্জ গ্রীয়ারসন, উইলিয়াম রদেনস্টাইন, ফ্রান্সিস. এইচ. স্ক্রাইন, ই.এফ. ওটেন গীতিকা সম্পর্কে উচ্চসিত প্রশংসা করেন। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ তার ‘বাংলা সাহিত্যের কথা’ গ্রন্থে বলেন-‘গীতিকা গুলোর সাহিত্যিক মূল্য বিদেশী সাহিত্য রসিকেরা কি দিয়াছেন, তাহা জানিলে বোধ হয় আমরা আমাদের ঘরের জিনিসকে একটু বেশি আদর করিব।’ পালাগানগুলো গ্রামবাংলার প্রচলিত সুরে গাওয়া হয়, তবে সুরের চেয়ে কাহিনীরই প্রাধান্য থাকে বেশি। কাহিনীর মধ্য দিয়ে এর রস শ্রোতার কাছে পরিবেশন করা হয়। ছোট গল্পের মতই একটি মাত্র কাহিনীর ধারাবাহিক বর্ননা করে এগুলো পরিবেশন করা হয়। সাহিত্য বিচারে ময়মনসিংহ গীতিকা লোকগীতির অংশ বিশেষ, এটি মূলত মুক্ত প্রেমের জয়গান। এই পালাগানগুলোর ভাষা সহজ সরল সাধারণ মানুষের ভাষা, কিন্তু মর্মস্পর্শী। যেমন ———
গীতিকাগুলোর মধ্যে মহুয়ার পালাটি বেদের এক অপূর্ব সুন্দরী মেয়ে মহুয়ার সঙ্গে বামনকান্দার জমিদার ব্রাহ্মণ যুবক নদের চাঁদের প্রেমকাহিনী নিয়ে রচিত। পল্লীকবি দ্বিজকানাই দক্ষতার সাথে এই বেদনাত্মক প্রেমকাহিনী বর্ণনা করেছেন। মহুয়া পালার নায়িকা যখন জল আনতে নদীর ঘাটে যায় তখন নায়ক নদের চাঁদ গান ধরে—
‘‘জল ভর সুন্দরী কন্যা জলে দিছ ঢেউ । হাসি মুখে কওনা কথা সঙ্গে নাই মোর কেউ।।’’
শুধু তাই নয় মহুয়ার রূপের সৌন্দর্যে মুগ্ধ নায়ক নির্লজ্জের মত কোন ভনিতা ছাড়াই তার প্রেমকে প্রকাশ করে।
‘‘কঠিন আমার মাতা-পিতা কঠিন আমার হিয়া । তোমার মত নারী পাইলে আমি করি বিয়া।।’’
প্রেমিকাকে নিজের করে পাবার তার যে আকাঙ্খা তা পূরন করতে প্রেমিক যে কোন পথ অবলম্বন করতে পারে।
‘‘কোথায় পাইবাম কলসী কন্যা কোথায় পাইবাম দড়ি। তুমি হও গহীন গাঙ আমি ডুব্যা মরি।।
মৈমনসিংহ গীতিকায় ১০টি গীতিকা আছে, যথা—মহুয়া, মলুয়া, চন্দ্রাবতী, কমলা, দেওয়ান ভাবনা, দস্যু কেনারামের পালা, রূপবতী, কঙ্ক ও লীলা, কাজলরেখা ও দেওয়ানা মদিনা। ভনিতা থেকে কিছু গীত রচয়িতার নাম জানা যায়, যেমন মহুয়া—দ্বিজ কানাই, চন্দ্রাবতী- নয়ানচাঁদ ঘোষ, কমলা- দ্বিজ ঈশান, দস্যু কেনারামের পালা- চন্দ্রাবতী, দেওয়ানা মদিনা- মনসুর বয়াতি। কঙ্ক ও লীলার রচয়িতা হিসেবে ৪ জনের নাম পাওয়া যায়- দামোদর দাস, রঘুসুত, শ্রীনাথ বিনোদ ও নয়ানচাঁদ ঘোষ। অবশিষ্ট গীতিকার রচয়িতার নাম জানা যায় না। গীতিকায় রচয়িতার নাম থাকলেও তারা কেউ কবি হিসাবে পরিচিত ছিলেন না। আখ্যানগুলি লোকসমাজ থেকেই নেয়া হয়েছে। চিরন্তন গ্রামের সরল পরিবেশ, অতিথি পরায়নতা, মানুষের সাথে মানুষের অকৃত্রিম আন্তরিকতা আমরা ময়মনসিংহ গীতিকায় পাই———
‘‘আমার বাড়িত যাইওরে বন্ধু বইতে দিয়াম পিড়া। জলপান করিতে দিয়াম শালি ধানের চিড়া।। শালি ধানের চিড়া দিয়াম আর ও শবরী কলা। ঘরে আছে মইষের দইরে বন্ধু খাইবা তিনো বেলা।।’’
ময়মনসিংহ গীতিকার অধিকাংশ গীতিকা প্রেমসমৃদ্ধ, এতে গ্রামীণ প্রেমের বর্ণনা রোমান্টিকভাবে বর্ননা করা হয়েছে। কাজল রেখা, মহুয়া, মলুয়া, লীলা, চন্দ্রাবতী প্রভৃতি গীতিকার নায়িকাদের প্রেম ও ত্যাগের গভীরতা মানুষের হৃদয়কে নিবিড়ভাবে স্পর্শ করে। ধর্ম নয়, পার্থিব জীবনের কথা গীতিকার প্রধান বৈশিষ্ট্য। মৈমনসিংহ গীতিকার দস্যু কেনারামের পালা ছাড়া বাকি ৯টি পালার মূল বিষয় হচ্ছে নরনারীর প্রেম। প্রেমের পরিণতি কোনোটির মিলনাত্মক, কোনোটির বিয়োগান্তক। নায়িকাদের নামে গীতিকাগুলির নাম রাখা হয়েছে। এই সব গীতিকায় পুরুষের তুলনায় নারী চরিত্রের ভূমিকা উজ্জ্বল ও প্রাণবন্ত। প্রেমের ক্ষেত্রে তারাই বেশি ত্যাগ স্বীকার করেছেন। নারী-চরিত্রের মহিমা প্রকাশ করে দীনেশচন্দ্র সেন এই গ্রন্থের ভূমিকায় বলেন, ‘এই গীতিকাগুলির নারী চরিত্রসমূহ প্রেমে দুর্জয় শক্তি, আত্মমর্যাদার অলঙ্ঘ পবিত্রতা ও অত্যাচারীর হীন পরাজয় জীবন্তভাবে দেখাইতেছে। নারীপ্রকৃতি মন্ত্র মুখস্থ করিয়া বড় হয় নাই—চিরকাল প্রেমে বড় হইয়াছে।’
ময়মনসিংহ গীতিকা যারা রচনা করেছেন, তাদের জন্মকাল, কাব্যের সময়কাল, সামাজিক পটভূমি, ভাষা এগুলি ব্যাখ্যা করে এই ধারনা করা হয় যে, গীতিকাগুলি মধ্যযুগে রচিত হয়েছিল। কাজলরেখার গল্প খানিকটা রূপকথা ভিত্তিক, আর এর বিষয়বস্ত্ত প্রাচীন। এটা ছাড়া অন্য সব গীতিকায় সামন্ত যুগের সমাজচেতনার ও মূল্যবোধের ছায়া রয়েছে। রাজা, জমিদার, দেওয়ান, কাজী, কারকুন, সওদাগর, পীর-দরবেশ, সাধু-সন্ন্যাসী প্রভৃতি চরিত্র মধ্যযুগের মুসলিম শাসন-ব্যবস্থাকেই বোঝায়। সামন্তসমাজের মূল্যবোধ ধারণ করেও মানবপ্রেমের মহিমা, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য, নৈতিকতা মৈমনসিংহ গীতিকাকে সাহিত্যিক মূল্য ও মর্যাদা দিয়েছে। মনসুর বয়াতি রচিত দেওয়ানা মদিনার পালায় বানিয়াচঙ্গের দেওয়ান সোনাফরের ছেলে আলাল ও দুলালের বিচিত্র প্রেমের কাহিনী বর্ণনা করা হয়েছে। এ কাহিনীতে মদিনার ত্যাগ ও নীরব সহ্যক্ষমতার মধ্য দিয়ে কবি নারীর স্বকীয়কে নিপুণভাবে তুলে ধরেছেন। গীতিকাগুলোর সবখানেই নারীর প্রেমের অনুভূতি, শক্তিকে সার্থকতার সাথে তুলে ধরেছে।বিশেষ করে বিয়োগাত্মক প্রেমকাহিনী গীতিকাগুলোর গ্রহনযোগ্যতা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।।
ময়মনসিংহ গীতিকার উদার মুক্ত-ক্ষেত্রে প্রেমের অনাবিল যে ধারা ছুটেছে তা প্রস্রবণের মত অবাধ ও নির্ঝরের মত নির্মল। এ গীতিকা থেকে আমরা মালঞ্চমালা, কঙ্খনমালা, কাঞ্চনমালা এবং পুষ্পমালার কথা পাই প্রেমের রাজ্যে এরা সহোদরা। তারা প্রেমের শক্তিতে বলীয়ান। লীলার লীলাবসান, সোনাই-এর নির্বাক ও নির্ভীক মৃত্যু, কাজল-রেখার চরিত্রের সহিষ্ণুতা এবং প্রেমনিষ্ঠার জীবন্ত সমাধি। স্বামীর প্রতি মলুয়ার ভালোবাসা অকৃত্রিম। এতে ধর্ম বা মত প্রচার নেই বা কোন যুগোচিত সমস্যার সমাধান নেই। এই গীতিকার আদর্শ সনাতন প্রেমের আদর্শ এবং এর প্রেম সুধা অফুরন্ত। যত দিন মানুষের হৃদয়ে প্রেম থাকবে এই প্রেম সুধাও বয়ে যাবে।
পাঠকদের জন্য ময়মনসিংহ গীতিকার মলুয়া পালা থেকে কিছু অংশ——-
“আগরাঙ্গ্যা সাইলের খেত পাক্যা ভূমে পড়ে পন্থে আছে বইনের বাড়ী যাইব মনে করে।। মায়ের পেটের বইন গো তুমি শুন আমার বাণী। শীগারে যাইতে শীঘ্র বিদায় কর তুমি। ঘরে ছিল সাচি পান চুন খয়ার দিয়া। ভাইয়ের লাগ্যা বইনে দিল পান বানাইয়া।। উত্তম সাইলের চিড়াগিষ্টেতে বান্ধিল ঘরে ছিল শবরি কলা তা ও সঙ্গে দিল।। কিছু কিছু তামুক আর টিক্কা দিল সাথে মেলা কইরা বিনোদ বাহির হইল পথে।। যত দূর দেখা বইনে রইল চাইয়া
ভাষায় রঙরস আছে, কারুকাজ আছে কিন্তু কৃত্রিমতা নেই। এগুলোর মধ্যে অতি সাধারণ মানুষের চিন্তা-চেতনা, জীবনবোধ, আবেগ অনুভূতির পরিচয় মেলে। ময়মনসিংহ গীতিকার কাহিনীগুলো মূলত নারীর প্রেম-শক্তির জয় গান এবং নারীর ব্যক্তিত্ব, আত্মবোধ, স্বাতন্ত্র্য ও বৈশিষ্ট্য এতে প্রকাশমান। এ গানের নায়িকারা প্রেমশক্তির অধিকারিণী হয়ে তাদের নারীধর্ম ও সতিত্ব রক্ষা করেছে। প্রেমের জন্য দুঃখ, তিতিক্ষা, আত্মত্যাগ ইত্যাদি সর্বসমর্পণ করে নারী যে কী অসীম মহিমা লাভ করতে পারে, গীতিকাগুলো তারই পরিচায়ক। পল্লী-কবির সহজ সরল দৃষ্টি শাশ্বত নারীর অকৃত্রিম রূপ এখানে ফুটে উঠেছে। তাদের স্বভাবের মাধুর্য ও সৌন্দর্যের সাথে সর্বসংস্কার মুক্ত প্রেমের বিকাশ ঘটেছে। পল্লীসমাজের সহজ প্রেম গীতিকাগুলোর উপজীব্য হয়ে তৎকালীন সমাজকে প্রতিফলিত করেছে। তাই সামাজিক কবিতা হিসাবে এগুলো অবশ্যই মূল্যবান। গীতিকাগুলোর কবিরা আজ নেই, কিন্তু এসব কাহিনীর পাত্র পাত্রীদের দুঃখে শ্রোতাদের চোখের পানি কখনো ফুরাবে না।