[মাস্কেট হাতে নুরজাহান; রামপুর রাজা লাইব্রেরি; আঁকিয়ে আবুল হাসান]

জেনানা মহলে অস্ত্রধারী, এমন কী বন্দুকধারীও পাহারা থাকত। পাহারাদারেরা মহিলাও হতেন। মুঘল মহিলাদের অনেকেই অস্ত্র চালানোয় দক্ষ ছিলেন, যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শীও ছিলেন। তারা রক্ষণাত্মক এবং আক্রমণাত্মক অস্ত্রের তত্ব এবং ব্যবহারও দক্ষভাবে জানতেন। বাবরের কন্যা, হুমায়ুনের বোন, আকবরের ফরমানে ব্যতিক্রমী বাবর এবং হুমায়ুনের স্মৃতিকথা হুমায়ুননামার রচয়িতা গুলবদন বলছেন হুমায়ুনের সিংহাসনে আরোহনের সময় যে ‘অতীন্দ্রিয় ভোজের[মিস্টিক ফিস্ট] ব্যবস্থা হয়েছিল, সেখানে উপস্থিত বহু মুঘল যুবতী পুরুষদের পোষাক পরিচ্ছদ এবং অন্যান্য গয়নাযোগ্য উপকরণ যেমন আঙটি পরে, পিঠে তীর বেঁধে উপস্থিত হয়েছিলেন; উৎসবে মেয়েদের মধ্যে অনেকে পোলোও খেলছিলেন, অনেকে তীর ধনুক নিয়ে তীরান্দাজি করছিলেন। আমরা ধরে নিতে পারি হুমায়ুনের সময়েই জেনানা মহলের বাসিন্দারা ধর্নুর্বিদ্যায় প্রখর হয়ে উঠেছিলেন এবং একই সঙ্গে বন্দুক চালনায় মাহিরতাও অর্জন করেন। তাহলে আমরা আরও ধরে নিতে পারি তারা অবশ্যই শাহী পুরুষ এবং অভিজাতদের সঙ্গে শিকারের সঙ্গী হতেন। গুলবদন বলছেন হুমায়ুনের সময় বহু মহিলা শিকারে যেতেন এবং জাহাঙ্গিরের জেনানাতেও এটা স্বাভবিক ঘটনা ছিল। তবে মুঘল সাম্রাজ্যের জেনানার সব থেকে বড় এবং প্রখ্যাত শিকারীর নাম ছিল নুরজাহান। ১৬১৬র পর থেকে তিনি বহুবার এ বিষয়ে হুনর প্রদর্শন করেন। জাহাঙ্গির লিখছেন সেই বছর নুরজাহান শিকারে গিয়ে একটি অসামান্য আকারের, রঙের অদেখা সৌন্দর্যের কারিশাকে(qarisha) গুলি করে হত্যা করেন। পরের বছর ১৬১৭য় ছটা গুলিতে ৪টে বাঘ মেরেছিলেন জাহাঙ্গির তুজুকে লিখছেন, now such shooting was never seen, that from the top of an elephant and inside of a howdah (amari) six shots should be made and not one miss…. As a reward for this good shooting I gave her a pair of bracelets (pahunchf) of diamonds worth 100,000 rupees and scattered 1,000 ashrafis (over her)। আশেপাশের গ্রামে একটি বাঘ ১৬১৯এ বার বার এসে গ্রামবাসীর ক্ষতি করছিল। সে সময় জাহাঙ্গির অহিংসার নীতি নিয়েছিলেন ‘ঠিক করেছি এই সময়ে আমি নিজের হাতে কোনও জীবিত প্রাণীর জীবন নেব না, নুরজাহানকে বলছি বাঘটাকে শায়েস্তা করতে’। বাঘ শিকারে যেতে নুরজাহান হাতির হাওদার মত উচ্চাসনে বসলেও ‘মানুষের মাংসের স্বাদ পাওয়া বাঘের বুনো গন্ধ নাকে পেলেই হাতি চঞ্চল হয়ে ওঠে এবং নিরন্তর নড়াচড়া করতে থাকে; এমতাবস্থায় উঁচু ডুলিতে বসে লক্ষ্য স্থির রেখে গুলিচালানোই ঝকমারি’। জাহাঙ্গির ছাড়া সাম্রাজ্যে যাকে সব থেকে ভাল বন্দুকচি মনে করা হত, মির্জা রুস্তমও(জাহাঙ্গিরের এবং সাহেব জামালের পুত্র। জাহাঙ্গির তাঁকে রুস্তম মির্জা নামে ডাকতেন। তাঁর কন্যা নাদিরা বানু বেগমের সঙ্গে দারার বিবাহ হয়) হাতিতে বসে তিনচারটে গুলি ছুঁড়লেও বাঘকে আঘাত করতে পারেন নি, কিন্তু নুরজাহান বেগম একবারেই একটি গুলিতে বাঘটির ভবলীলা সাঙ্গ করেন। তবে নুরজাহানের বন্দুল চালানোর কিংবদন্তিসুলভ ক্ষমতা নাকচ করেছেন পরের দিকের লেখকেরা, বিশেষ করে কাফি খান। কাফি খানের বক্তব্য নুর জাহান বন্দুক চালাতে শিখেছিলেন মুঘল জেনানায় তার প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী এবং সতীন জগৎ গোঁসাইনীর বন্দুক চালানোর ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠতে। যদিও কাফি খাঁ বর্ণিত ঘটনাটি অপ্রমানিত। দুই প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী ব্যক্তিত্বশালী মহিলা একদা শিকার করছিলেন। হঠাৎ তাদের সামনে সিংহ উপস্থিত হলে ‘নুরজাহান হতবাক এবং চিত্রার্পিত হয়ে যান’। জগৎ গোঁসাইনি তডিৎ গতিতে বন্দুক তুলে এক গুলিতেই সিংহকে সাবাড় করেন। সারাক্ষণ নিদ্রামগ্ন সম্রাট এই ঘটনায় হঠাৎ জেগে উঠে এক স্ত্রীর সাহসিকতাকে সরবে প্রশংসা এবং নুরজাহানের ভীরুতাকে তিরষ্কার করেন। মেয়েকে সম্রাটের রোষ থেকে বাঁচাতে নুরজাহানের মা বললেন মহিলাদের কাজ হল আনন্দদান করা এবং বন্দুক একমাত্র শোভা পায় যুদ্ধক্ষেত্রে সেনার হাতে, তখন জাহাঙ্গির অসন্তুষ্টি ভুললেন। তবে যতদূরসম্ভব এই গপ্পটা নুরজাহানের বিরোধীপক্ষ শাহজাহানের ঐতিহাসিকের তৈরি। আলোচ্য ঘটনাগুলো থেকে পরিষ্কার, জাহাঙ্গিরের সময় এবং সম্রাটের সঙ্গেই জেনানার মহিলারা সক্রিয়ভাবে শিকারে যেতেন। শিকারে নুরজাহানের দক্ষতা এতই চূড়ান্ত ছিল যে বিপদের সময়ে শাহী দরবার থেকেও তাঁর ডাক পড়ত।

সূত্র এলিসন ফিন্ডলি, নুরজাহান