পাঁচজন মহিলা। কারুর সঙ্গে কারুর পরিচয় নেই। হাজার হাজার মাইল দূরে বসে তারা একে অন্যের অজান্তে কোন মৃত ব্যক্তির আত্মার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেন। মিডিয়ামের মাধ্যমে আচ্ছন্ন অবস্থায় স্বয়ংচালিত লেখার পন্থা অবলম্বন করে তারা অন্য জগতের খবর আনবার প্রয়াস পেলেন। এই পন্থা বেছে নেবার কারণ হচ্ছে-এটাই তাদের কাছে সবচেয়ে সহজ উপায় বলে মনে হল।
প্রাথমিক পর্যায়ে তারা যে সংবাদ সংগ্রহ করলেন তা রীতিমত বিকৃত ও হিজিবিজি বলে তাদের কাছে মনে হল। আর এই বিকৃত, অস্পষ্ট ও হিজিবিজি লেখা গুলো দেখে তারা বেশ একটু হতাশই হলেন। সবকিছু তাদের কাছে অর্থহীন বলে মনে হল। পরে যখন তারা ঐগুলোর তুলনামূলক ব্যাখ্যা করতেন তখন দেখতে পেতেন এগুলো তিনজন পরলোকগত লোকের কথা। বিষয়বস্তুগুলো একটার সঙ্গে অন্যটা জড়িত।
পরলোকগত এই তিনজন লোকই ছিলেন বৃটিশ সোসাইটি অব ফিজিকাল রিসার্চের প্রতিষ্ঠাতা। এঁদের নাম পর্যায় ক্রমে হেনরী সিজ্উইক, ফ্রেডারিক মায়ার্স ও এডমন্ড গার্ণি। ১৯০১ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে তারা তিনজনই মৃত্যুবরণ করেন। আর উপর উল্লিখিত পাঁচজন মহিলার তিনজন সম্পূর্ণ আলাদা আলাদাভাবে একে অন্যের অজ্ঞাতে তাঁদের পরীক্ষার কাজ শুরু করেন।
মিসেস এ.জি. ভ্যারল। তিনি ছিলেন ইংল্যান্ডের কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটির উচ্চশ্রেণীর একজন স্কলার। পাণ্ডিত্যে তাঁর খ্যাতি ছিল সুবিদিত। তিনি পরলোকগত এই তিনজন লোককেই জানতেন। এঁদের তিনজনের কাছ থেকেই তিনি ভাঙা ভাঙা সংবাদ পেতেন। বিশেষ করে মায়ার্সের কাছ থেকেই তাঁর কাছে সংবাদ আসতো বেশী।
পরবর্তীতে আমেরিকার লিওনোরা পাইপার নামে অপর এক মহিলা মায়ার্সের স্বাক্ষরযুক্ত সংবাদ পাওয়া শুরু করলেন। এদিকে ভারতবর্ষে কবি রুডিয়ার্ড কিপলিংএর বোন এলিস ফ্লেমিংও অনুরুপ সংবাদ পেতে থাকেন। আশ্চর্যের বিষয় তাঁর মেয়েও মায়ের মত ঐ রকম সংবাদ পাওয়ার সৌভাগ্যে সৌভাগ্যবতী হলেন। আবার ইংল্যান্ডে মিসেস উইলেট নামে অন্য এক মহিলা লক্ষ্য করলেন যে ,তিনি হিজিবিজি লেখার মধ্যদিয়ে এমন সব লোকের কাছ থেকে সংবাদ পেতে শুরু করেছেন, যাদের সঙ্গে তাঁর কস্মিন কালেও জানাশোনা ছিল না- এমন কি তাঁদের নামও তিনি জীবনে শোনেন নি।
পরবর্তী তিরিশ বছর ধরে অশেষ ধৈর্য ও নিষ্ঠার সাথে তারা কাজ চালিয়ে গেলেন। এভাবে কাজ করে তারা প্রায় তিন হাজার সংবাদ সংগ্রহ করলেন। তাঁদের সংগ্রহের ঝুলি রীতিমত ভারী হতে লাগলো। এ সংবাদগুলো ব্রুস করেস্পন্ডেন্স হিসাবে কাছে পরিচিত হয়েও উঠলো। আর এ গুলো একত্রিত করে বিষয় বস্তুর পরীক্ষা নিরীক্ষার পর ব্যাখ্যা খুঁজে পাবার চেষ্টা চললো। সামাজিক ভাবে অনুসন্ধান চালিয়ে এ সংবাদগুলোর যোগাযোগ খুঁজে বের করবারও উদ্যোগ চললো।
উপরিউক্ত বিভিন্ন মহিলার কাছ থেকে সংগৃহিত খণ্ড খণ্ড সংবাদ গুলো একটি জটিল সংবাদের অবতারণ করলো। বিশেষ করে ক্লাসিকাল সাহিত্য বিষয়ের উপর ভিত্তিকরে সংবাদগুলো আবর্তিত হচ্ছিল। মিসেস ভেরল ছাড়া অন্যান্য মহিলারা কেউই তেমন শিক্ষিতা ছিলেননা। এমন কি ক্লাসিক্স্ সম্বন্ধে তাঁদের কোন জ্ঞান , আগ্রহ বা অনুসন্ধিৎসা ও ছিলনা।
অন্য দিকে মৃত ব্যক্তিরা সকলেই ছিলেন ক্লাসিকাল বিষয়ে বিশেষ পণ্ডিত।
বৈজ্ঞানিক, পণ্ডিত, ব্যবসায়ী ইত্যাদি বিভিন্ন শ্রেণীর লোক এই হস্তলিপিগুলো নানা ভাবে পরীক্ষা করলেন। তারা এগুলো গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করে ধারণা করলেন যে-এগুলোর মুখ্য উদেশ্য হচ্ছে পৃথিবীতে এ বিষয়ে একটি সচেতন মন- মানসিকতা গড়ে তোলে।
একটা বিষয়ে সকলেই বিশেষ ভাবে বিবেচনা করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন যে এগুলো লেখিকারা ভিন্ন ভিন্ন মহাদেশের দূরদূরান্ত থেকে একত্র হয়ে এতবড় জটিল কাজে প্রতারণার আশ্রয় নেবার ক্ষমতা রাখেন না। যদি কোন রকম টেলিপ্যাথিক যোগাযোগ ও হয়ে থাকে এই লেখাগুলোতে এমন সব বিষয়ের অবতারণা ঘটানো হয়েছে যা সাধারণ বুদ্ধি দিয়ে কেউ বুঝতে পারবেনা। এতে যে বিভিন্ন ধারাবাহিক অবাস্তব জটিল ক্লাসিকাল ও পারস্পরিক সম্পর্ক যুক্ত প্রসঙ্গের অবতারণা করা হয়েছে তা শুধুমাত্র মিসেস ভারলের পক্ষেই বোঝা সম্ভব। বাকী মহিলাদের সীমিত জ্ঞানের পরিধি অতটা উন্নত মানের নয় যা দিয়ে তারা এগুলোর উপরে কোন রকম বক্তব্য তৈরী করতে পারেন। কাজেই এক্ষেত্রে লোককে ধোঁকা দেওয়ার প্রশ্নটি এককথায়ই নাচক হয়ে যায়।
মাধ্যম মিসেস ফ্লেমিংএর কাছে এমন একটি সংবাদ এলো যা সকলের কাছেই অত্যন্ত বিস্ময়কর। ১৯০৬ খৃষ্টাব্দে তিনি এমন একটি সংবাদ তুলে ধরলেন যার শেষে লেখা আছে ইংরেজি বর্ণমালার ‘এফ’ অক্ষরটি।এই এফ অক্ষরটি দিয়ে ফ্রেডারিক মায়ার্স নিজের উপস্থিতি জ্ঞাপন করে তাঁর একটি অভিলাষ লিপিবদ্ধ করেন। তিনি জানান যে তিনি তাঁর কিছু পুরোনো বন্ধুর সঙ্গে আলাপ করতে চান। এই লেখাটির মাধ্যমে মায়ার্সের একান্তিক আগ্রহ সুস্পষ্ট রূপে ব্যক্ত হল। তাঁর লেখার মধ্য দিয়ে জানা যায় যে এর বিবরণ মিসেস ভেরলের কাছে পৌঁছানো হোক। মিসেস হল্যান্ডের পক্ষে মিসেস ভেরলকে চানা তো দূরের কথা, জীবনে তাঁর নামও তিনি কখনও শোনেননি।
মায়ার্সের কাছ থেকে মাধ্যম যে সব সংবাদ সংগ্রহ করেন তার শেষ কথা গুলো ছিল এই রকম-‘ এটা এমন একটি জরুরী সংবাদ যা জানানোর ভার অর্পিত হয় একজন ঘুমন্ত ব্যক্তির কাছে,-প্রমাণ নাও ,প্রমাণ করতে চেষ্টা করে-যদি সময়ের অপব্যয় বলে মনে করে, এটা মিসেস ভারলের কাছে পাঠিয়ে দাও। তার ঠিকানা ৫নং সেলউইন গার্ডেনস।
অজ্ঞাত বিষয়ের উল্লেখঃ
মিসেস ভেরলের অস্তিত্ব সম্বন্ধে মিসেস হল্যান্ড যদিও অজ্ঞ ছিলেন তবু উল্লেখিত ঠিকানাটি কিন্তু যথার্থ ।মিসেস হল্যান্ড হাতের লেখা কাগজখাতা সোসাইটি ফর সাইকিকাল রিসার্চে পাঠিয়ে দিলেন। তার পরই বিভিন্ন হাতের লেখা কাগজগুলোর যোগসূত্র খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা শুরু হলো।
আবশেষে জি. ডি. ডর নামে একজন আমেরিকান গবেষক একটি পরীক্ষার উদ্ভাবন করলেন। মাধ্যম মিসেস পাইপারের মাধ্যমে তিনি মায়ার্সকে জিজ্ঞাসা করলেন ‘লীথ’-(Lethe) শব্দটি দিয়ে তিনি কি বুঝাতে চান? জবাব এলো অত্যন্ত বিস্তৃত ভাবে ।এই জবাবে এমন সব অজ্ঞাত বিষয়ের উল্লেখ করা হল যা কেবল মাত্র ক্লাসিক বিষয়ে উৎসর্গীকৃতপ্রাণ বিশেষজ্ঞ ব্যক্তির পক্ষেই এর উৎপত্তি ও প্রাসঙ্গিকতা খুঁজে বের করা সম্ভবপর। এই উত্তরগুলো অবশ্যই মিসেস পাইপারের সীমিত জ্ঞানের পরিধির বাইরে।
কিছুদিন পর ইংল্যান্ডে পদার্থ ও মনোবিজ্ঞান বিষয়ের গবেষক অলিভার লজ মিসেস উইলেটকে একই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করলেন ।এই মাধ্যম মিসেস উইলেট আমেরিকার এসব পরীক্ষা সম্বন্ধে নিতান্তই অজ্ঞ ছিলেন। লজ পূর্ববর্তী চিরায়ত নির্দেশক তথ্যগুলোর সঙ্গে তাঁর তথ্যগুলোর যথেষ্ট মিল খুঁজে পেলেন। সেই সঙ্গে মিসেস উইলেটের হস্তলিপিতে ‘ডর’ কথাটির উল্লেখ পাওয়া গেল। আর এই নামটি আমরা জানি অ্যামেরিকার পূর্ববর্তী অনুসন্ধানকারী জি. ভি. ডরের।
ভারতবর্ষে মিসেস ফ্লেমিং এর স্ক্রিপ্টেএ আমরা প্রায়শঃই দেখতে পাই হতাশা ও দুঃসহ যাতনার অভিব্যক্তি । লেখনির অনুচ্ছেদে সংবাদ প্রেরকের যোগাযোগ করার অদম্য আকাঙ্ক্ষা ফুটে ওঠে।
তুষারাবৃত কাঁচের অন্তরালেঃ
মিসেস ফ্লেমিং এর মাধ্যমে মায়ার্স লিখেছেন, আমার সংবাদ প্রেরণে যে অসুবিধার সম্মুখীন আমি হই তার সঙ্গে সবচেয়ে নিকটবর্তী উপমা হিসাবে আমি উল্লেখ করবো- আমি যেন এক পরত তুষারাবৃত কাঁচের উল্টোপিঠে দাঁড়িয়ে আছি। এই তুষার ঢাকা কাঁচ আমার দৃষ্টিকে আচ্ছন্ন করে, শব্দ চলাচলে বিঘ্ন ঘটায়। যেন এমন একজন সেক্রেটারীর কাছে আমার বক্তব্য রাখছি, যিনি অত্যন্ত অনিচ্ছুক ও নিতান্তই বোকা। নিদারুন একটি অক্ষমতার অনুভূতি আমাকে অহরহ দগ্ধ করে।
পরবর্তী পর্যায়ে মায়ার্স আরো লিখেছেন, ‘বাঁধা অতিক্রম করার চেষ্টা আমাকে আবারও করতে হবে- সঠিক সংবাদ জানার জন্য আমাকে চেষ্টা করতেই হবে- তোমাকে আমি কি ভাবে পূর্ণ রূপে বশীভূত করতে পারি? কি ভাবে এগুলো তোমার কাছে বিশ্বাসযোগ্য ও যথার্থ গ্রায্য করে তুলবো?
প্ল্যানচেট করে অ্যামেরিকায় মিসেস পাইপার ও ইংল্যান্ডের মিসেস উইলেট একই ধরণের সংবাদ পেতে থাকেন। মিসেস উইলেটের কাগজ পত্রে এটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে তিনি মানসিক ভাবে ঐ তিন ব্যক্তির সঙ্গে কথোপকথনের চেষ্টা করেন। তার এই পন্থা অনুসরণের কারণ হিসাবে উল্লেখ করেন যে এতে তার মাধ্যমে দ্বিতীয় একজন ব্যক্তি প্রশ্ন করার সুযোগ পায়। মায়ার্স, গার্ণী ও সিজ্উইক-তিনজনকেই পর্যায়ক্রমে প্রশ্ন করার অবকাশ পাওয়া যায়। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হল আলোচনার বিষয়বস্তু মিসেস উইলেটের বুদ্ধি ও জ্ঞানের সীমার বহু ঊর্দ্ধে চলে যেত।
সিজ্উইক প্রাইম মিনিস্টারের ভাই লর্ড বালফোরের সঙ্গেও আলোচনা করেন। তাদের আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল সংঘাতময় মতবাদ বা অনুমানের সঙ্গে মানব মন ও দেহের সম্পর্ক। গার্ণী আলোচনা করেন মানবাত্মার উৎপত্তি সম্বন্ধে ।মাধ্যমদের এই সব হস্তলিপি বা স্ক্রিপ্ট নিয়ে বহু বৎসর ব্যাপক ভাবে আলোচনা ও পরীক্ষা নিরীক্ষা চলে। আজ পর্যন্ত এসব ব্যাপারে কেউ সন্তোষজনক কোন সমাধান দিতে পারেন নি। কেউ বলতে পারেন নি কি ভাবে কোথা থেকে এই যোগাযোগগুলো সম্পন্ন হয়।
আটলান্টিকের এপারের মহাদেশের লোকের সঙ্গে ওপারের মহাদেশের লোকের এই অলৌকিক যোগাযোগের কারণ বা উৎস আজও রহস্যময়ই রয়ে গেছে।
বহু মতবাদ, কল্পনা ও অনুমানের ও সৃষ্টি হয়েছে। মৃত্যুর পরপারের কতিপয় ব্যক্তির মনোভাব অবিরল গতিতে এপারে পাঠানোর প্রচেষ্টা বহুকাল ধরে চললেও এর সঠিক কারণ কেউ ব্যাখ্যা করতে পারেননি। এমন কেউ কখনও জন্মাননি যিনি এঁদের চেয়ে বেশী বোদ্ধা ,যারা সহজেই পরপারের খবর গ্রহণ করবার জন্য যথেষ্ট সূক্ষ্ম অনুভূতি সম্পন্ন। জগত অবশ্যই তাঁদের অবগত প্রতীক্ষায় রইলো।
কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় উপরিউক্ত মহিলা মাধ্যমদের মৃত্যুর পর ওপার থেকে কেউ আর বস্তু-জগতের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেনি। ওপার থেকে এপারে তাদের কথা জানানোর প্রয়োজনীয়তা ও হয়তোবা ফুরিয়েগেছে!!
এই পৃথিবীতে এমন অনেক রহস্য আছে-বুদ্ধিতে যার ব্যাখ্যা চলেনা। বিজ্ঞান, দর্শন, নৃতত্ত্ব ,মনঃস্তত্ত্ব এবং ডিমোনোলজিও ব্যাখ্যা দিতে পারেনা। হয়ত ভবিষ্যতই এর সমাধান দিতে পারবে……।