রাজা-রানী মুদ্রা (King Queen type of coins)
ইতিহাসে বহু রাজা-সম্রাট এসেছে গেছে। অনেকে নিজের নাম ইতিহাসে অমর করে রাখার জন্য বিভিন্ন স্থাপত্যকীর্তি, স্তম্ভ নির্মাণ করিয়েছেন অথবা, স্বীয় নামাঙ্কিত মুদ্রা প্রচলন করেছেন। প্রাচীন ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে যত মুদ্রা পাওয়া যায়, তার প্রায় অধিকাংশ মুদ্রাতেই রাজা বা সম্রাটের নামই অঙ্কিত থাকে। কিন্তু ব্যতিক্রমী এমন কিছু মুদ্রাও আছে যেখানে রাজার সাথে রানীর নামও অঙ্কিত হয়েছে। এধরনের মুদ্রাকে King-Queen type of Coin বা রাজা-রানী ধাঁচের মুদ্রা বলা হয়। সেসব মুদ্রায় রাজার সাথে রাণীও পেয়েছেন সমান গুরুত্ব। এর পিছনে কারণ কী ছিল? রানীর প্রতিটি রাজার ভালোবাসা,শ্রদ্ধাবোধ? ধর্মীয় কারণ? নাকি রাজনীতি?
এমন কিছু বিরল মুদ্রা নিয়েই আলোচনা করছি নিচে-
চন্দ্রগুপ্ত প্রথম-কুমারাদেবীঃ
চন্দ্রগুপ্ত প্রথমকে বলা হয় গুপ্ত সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা। গুপ্ত আমলের মুদ্রাগুলো সবসময়ই ইতিহাসবিদ ও প্রত্নতত্ত্ববিদদের জন্য আকর্ষণের বস্তু। গুপ্তযুগের বিভিন্ন প্রাপ্ত মুদ্রার মধ্যে একধরনের ব্যতিক্রমী মুদ্রা পাওয়া যায়,যেটা হল রাজা-রানী ধাঁচের মুদ্রা (King-Queen type of coin)।মহারাজাধিরাজা চন্দ্রগুপ্ত প্রথম নিচের নামের সাথে তাঁর রানী কুমারাদেবীর নামও অঙ্কিত করে এই মুদ্রা প্রচলন করেন।
প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ এ এস আলতেকারের মতে, সম্ভবত রাজা-রানী দুজনে যৌথভাবে সাম্রাজ্য চালাতেন, তাই মুদ্রায়ও দুজনকে সমগুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তিনি তাঁর বই “Coinage of the Gupta Empire” এ উল্লেখও করেছেন যে, বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায় যে, গুপ্ত সাম্রাজ্যের বিকাশ ও বিস্তারে লিচ্ছবি রাজকুমারী কুমারাদেবীর সাথে বিবাহ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আর সি মজুমদারের মতে, লিচ্ছবিদের সাথে এই বৈবাহিক সম্পর্কই গুপ্ত সাম্রাজ্যের রাজনৈতিক ক্ষমতা ও প্রভাব বৃদ্ধি করে এবং উত্থানে সহায়তা করে এবং এই বিয়ের মাধ্যমেই চন্দ্রগুপ্ত“মহারাজাধিরাজা” হয়ে উঠেন। তবে, অনেক ঐতিহাসিকেরি মতে এই মুদ্রা চন্দ্রগুপ্ত না তাঁর ছেলে সমুদ্রগুপ্ত প্রচলন করেছিলেন তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে।
মুদ্রার একপাশে দেখা যায় সুসজ্জিত রাজকীয় বেশে রাজা রানী মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছেন এবং রাজা রানীকে কিছু একটা দিচ্ছেন এবং এ বস্তুটা বিভিন্ন মুদ্রা বিভিন্ন রকম, কোথাও আংটি, কোথাও সিঁদুরদানি। মুদ্রার অপর পিঠে অঙ্কিত আছে এক দেবীর প্রতিকৃতি এবং রাজা -রানীর নাম। এছাড়াও ‘লিচ্ছবিয়া’ কথাটির উল্লেখ আছে,যা সম্ভবত রানীর বংশের নাম নির্দেশ করছে।
ত্রিপুরার রাজ মুদ্রাঃ
ত্রিপুরার বিভিন্ন প্রাচীন মুদ্রায় রাজাদের পাশাপাশি রানীদের নামও পাওয়া যায়। ভারতীয় উপমহাদেশের মুদ্রার ইতিহাসে এটি ব্যতিক্রমী হলেও ত্রিপুরার রাজ পরিবারের বেলায় এটি বেশ প্রচলিত ব্যাপার ছিল। মুদ্রার একপাশে বাংলা অক্ষরে খোদিত রাজা ও রানীর নাম এবং অপর পিঠে সিংহের প্রতিকৃতি (বাংলা সালতানাতের সাথে ঘনিষ্ট সম্পর্ক থাকায়,খুব সম্ভবত সুলতান নাসিরউদ্দিন মাহমুদের অনুকরণে)।
এর প্রচলন হয়, রাজা রত্নমানিক্যের হাত ধরে। ত্রিপুরার রাজাদের মধ্যে তিনিই প্রথম তাঁর রানী লক্ষ্মী মহাদেবীর নামাঙ্কিত মুদ্রার প্রচলন করেন। এরপর এ প্রথার ব্যাপক প্রচলন ঘটে ও তাঁর পরবর্তী রাজারাও নিজের নামের পাশাপাশি রানীর নামাঙ্কিত মুদ্রা তৈরি শুরু করেন। যেমন, রাজা রাজধর মানিক্য ও রানী সত্যবতী, রাজা ধন্যমানিক্য ও রানী কমলাদেবী।এর একটিমাত্র ব্যতিক্রম পাওয়া যায়, রাজা দেবমানিক্যের বেলায়। সিংহাসনে আরোহনের পর তিনি নিজের নামে মুদ্রা প্রচলন করেন রানীর নাম ছাড়া। পরবর্তীতে অবশ্য দেবমানিক্যের রানীর নামসহ মুদ্রাও পাওয়া যায়। ধারনা করা হয়, রানীর নাম ছাড়া মুদ্রা প্রচলনের সময় রাজা বিবাহিত ছিলেন না।
ত্রিপুরার রাজাদের এই রানীর নামাঙ্কিত মুদ্রা প্রচলনপর কারন খুব একটা স্পষ্ট জানা যায় না।ঐ সময়ে রানীরা প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকারও তেমন প্রমান পাওয়া যায় না।(ত্রিপুরার রাজইতিহাস রাজমালা বইতেও রানীদের ব্যাপারে কিছু পাওয়া যায় নি)।
Rhodes & Bose এর “The Coinage of Tripura” বই অনুসারে, এর পিছনের কারন সম্ভবত ধর্মীয়। ত্রিপুরা রাজবংশের মুদ্রায় সিংহের প্রতিকৃতি থাকতো।আর সিংহ দেবী দুর্গার বাহন এবং সেই কারণেই সম্ভবত দেবীকে সম্মান জানিয়ে মুদ্রায় রানীর নামও উল্লেখ করা হয়(যেহেতু, হিন্দু বিশ্বাস অনুযায়ী, প্রত্যেক নারীই দেবী দুর্গার প্রতিরূপ)।
রাজা সাতকর্ণী ও রানী নগনিকাঃ
রাজা প্রথম সাতকর্ণী/ গৌতমী পুত্র সাতকর্ণী ছিলেন সাতবাহন সাম্রাজ্যের ষষ্ঠসম্রাট।(প্রথম খ্রিস্টাব্দ) সাতবাহন সাম্রাজ্য ভারতের ডেকান,অন্ধ্রপ্রদেশ, তেলেঙ্গানা, মহারাষ্ট্র অঞ্চলে বিস্তৃত ছিল।তাঁর স্ত্রী ছিলেন রানী নগনিকা।তিনি মারাঠি রাজা ত্রানক্যিয়ার মেয়ে ছিলেন।তিনিই সম্ভবত ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসের প্রথম রানী যাঁর নামে মুদ্রা প্রচলন হয়।ভারতের নানেঘাট অঞ্চলের কাছে জুনার এলাকায় গুহায় খোদিত শিলালিপিতে এধরনের মুদ্রার উল্লেখ পাওয়া যায়।ঐসব শিলালিপি অনুসারে বিভিন্ন যজ্ঞউপলক্ষে মুদ্রা তৈরি করা হতো।ঐ শিলিলিপি অনুসারে, রাজা সাতকর্ণীর আদেশে সম্ভবত অশ্বমেধ যজ্ঞ উপলক্ষে রাজা সাতকর্ণী ও রানীনগনিকার নামে মুদ্রা তৈরি করা হয়।
খ্রিস্টপূর্ব ১ম শতাব্দীর দুটো রৌপ্য মুদ্রায় রানী নগনিকার নাম ব্রাহ্মী লিপিতে ‘নগনিক্যা ‘ হিসেবে মুদ্রার ঠিক মাঝখানে অঙ্কিত আছে এবং এই মুদ্রা দুটোয় রাজার নাম রানীর নামের নিচে আছে।
রানী সোমালা দেবীঃ
রানী সোমালা/সোমলেখা দেবী ছিলেন চৌহান বংশের রানী।তাঁর স্বামী আয়াজা রাজার সাথে যৌথ শাসক হিসেবে তাঁর নামের উল্লেখ করে মুদ্রা পাওয়া যায়।
পরবর্তীতে অবশ্য স্বামীর মৃত্যুর পর তিনি একক শাসক হিসেবে রাজ্য শাসন করেন এবং তাঁর নিজের একক মুদ্রাও প্রচলন করেন।
রানী সোমলেখার নামে বিভিন্ন বিচিত্র রকমের ব্রোঞ্জ মুদ্রা পাওয়া গেছে যাতে অশ্বারোহী অথবা গজারোহী পুরুষের (সম্ভবত তাঁর স্বামী) মোটিফ অঙ্কিত আছে।
জাহাঙ্গীর–নূরজাহানঃ
মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীর ও নূর জাহানের অমর প্রেমকাহিনী ভারতীয় উপমহাদেশে বহুলচর্চিত ও প্রচলিত। মুঘল সম্রাটেরা বিভিন্ন সময় তাঁদের বিভিন্ন কীর্তিতে তাঁদের সৌন্দর্যচেতনা,চিত্রকলা ও শিল্পের প্রতি ভালোবাসা এবং রোমান্টিকতার ছাপ রেখে গেছেন।
মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীর তাঁর প্রিয়তমা পত্নীর প্রতি ভালোবাসার প্রকাশ করে তাঁর নামাঙ্কিত করে মুদ্রা প্রচলন করেন।রূপার তৈরি মুদ্রার গায়ে অসম্ভব সুন্দর আরাবি ক্যালিগ্রাফিতে খোদাই করা তাঁদের নাম জ্বলজ্বল করে তাঁদের অমর প্রেমের সাক্ষ্য দেয়।
“By order of Shah Jahangir gained a hundred beauties
gold by the name of Noor Jahan Badshah Begum.”
– Couplets on Mughal Coins of India, chronicled by Manik Jain
সম্ভবত জাহাঙ্গীর ও নূরজাহান তাঁদের ভালোবাসাকে ইতিহাসে অমর করে রাখতে চেয়েছিলেন। তবে এই মুদ্রা কেবলমাত্র ভালোবাসার প্রকাশ ঘটানোর জন্যই অঙ্কিত হয়ে ছিল নাকি এর পিছনে রাজনৈতিক কারণ ও ছিল? এ ব্যাপারে অনেক ইতিহাসবিদদেরই সন্দেহ রয়েছে। কারণ, নূরজাহান অত্যন্ত ক্ষমতাধর ব্যক্তি ছিলেন।মুঘল রাজপরিবারে ধীরে ধীরে প্রভাব বিস্তার থেকে মুঘল সম্রাজ্ঞী হয়েওঠা এই মহিলা মুঘল রাজনীতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ছিলেন।অনেকের মতে, একসময় মুঘল সাম্রাজ্য তাঁর অঙ্গুলি হেলনেই চলত। তবে প্রেম হোক, ধর্ম হোক বা রাজনীতি, এধরনের ব্যতিক্রমী মুদ্রা যে প্রাচীন ইতিহাসের এক অনন্য দিক তুলে ধরে তা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। এতক্ষুদ্র সব মুদ্রা,অথচ পিছনে কত বড় বড় ইতিহাস!
তথ্যসূত্রঃ
১) উইকিপিডিয়া
২)বাংলাপিডিয়া
৩) “The Coinage of the Gupta Empire”- A S Altekar
৪) ” The Coinage of Tripura” -Rhodes and Bose
৫)https://www.google.com/amp/s/www.livehistoryindia.com/amp/story/herstory%252F2017%252F06%252F23%252Fthe-queen-who-left-a-mark
৬)https://www.google.com/amp/s/www.mintageworld.com/blog/coinage-of-tripura-kingdom/
৭)https://www.google.com/amp/s/www.thedailystar.net/supplements/28th-anniversary-supplements/the-lifestyle-parenthesis/news/the-name-the-queen-1706182%3famp