সম্রাট হুমায়ুনকে রাজস্থান থেকে রাজপুত রানী কর্ণাবতী একটি চিঠি পাঠিয়েছেন, চিঠির সাথে আরো পাঠিয়েছেন নীল রঙের একটি বৈদূর্যমনি (Lapis Lazuli) আর হলুদ রঙের সুতার রাখি।

চিঠিতে কি লেখা ছিলো ?

“ আমি আপনাকে ভাই ডাকলাম। আমাদের রীতি অনুযায়ী ভাইকে রাখি পাঠালাম। আমি মহাবিপদে পড়েছি। গুজরাটের বাহাদুর শাহ্ আমার দূর্গ অবরোধ করেছেন।দূর্গ রক্ষার প্রয়োজনীয় শক্তি আমার নাই। দূর্গে এক হাজার রাজপুত নারী এবং তিন হাজার শিশু আছে। বাহাদুর শাহ্ দূর্গে প্রবেশ করলে মৃত্যুবরন করা ছাড়া আমাদের আর কোন উপায় নাই।

এই অবস্থায় বোন ভাইকে আহ্বান জানাচ্ছে, ভাই কি বোনকে উদ্ধারে এগিয়ে আসবে? বোন ভাইয়ের জন্য একটি বৈদূর্যমনি পাঠিয়েছে কারন বোন শুনেছে তার ভাই ছবি আঁকেন। বৈদূর্যমনি গুঁড়ো করলে যে নীল রঙ হয় তার দ্যূতি অসাধারন। বোন কর্ণাবতী আশা করছে তার ভাই এই রং ব্যাবহার করে একটা ছবি আঁকবেন।”

ইতি রানী কর্ণাবতী

রানী কর্ণাবতী ছিলেন রাজস্থানে অবস্থিত মেওয়ারের রাজধানী চিতোরের রাজা রানা সংগ্রাম সিংয়ের স্ত্রী। জন্মসূত্রে রাণী কর্ণাবতী ছিলেন বুন্দির রাজকন্যা।

শিল্পীর তুলিতে রানী কর্ণাবতী, Image Source: hindujagruti

১৫২৬ সালে যখন সম্রাট বাবর দিল্লীর সিংহাসনে বসেন তখন রাজপুত রাজারা মিলিত হয়ে রানা সংগ্রাম সিংয়ের নেতৃত্বে বাবরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। খানুয়ার যুদ্ধ ১৫২৭ খ্রিস্টাব্দে মোগল সম্রাট বাবর ও মেবারের রাণা সংগ্রাম সিংয়ের মধ্যে সংঘটিত হয়, সেই যুদ্ধে রাজা সংগ্রাম সিং আহত হন এবং কিছুদিন পর তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

১৫২৭ – ১৫৩৩ সাল পর্যন্ত রানী কর্ণাবতী রাজ্যের শাসনভার গ্রহন করেন এবং রাজ্য পরিচালনা করেন কারন তার পূত্র বিক্রমাদিত্য তখন খুব ছোট ছিলো। পরে পূত্র বড় হলে রাজ্যের শাসনভার বিক্রমাদিত্যের হাতে তুলে দেন। কিন্তু এতো অল্প বয়সে রাজ্য শাষন করার মতো ক্ষমতা বা দক্ষতা কিছুই তার ছিলোনা। বরং তার ঔদ্ধত্য এবং দূর্ব্যাবহারে সভাসদ ও অন্য রাজারাও তার প্রতি অসন্তুষ্ট ছিলো। শাষক হিসাবে সে ছিল একজন ব্যার্থ শাষক।

চিত্তরগড় দুর্গ; Image Source: Wikimedia Commons

এই সুযোগে গুজরাটের রাজা বাহাদুর শাহ চিতোর আক্রমনের জন্যে এগিয়ে যান। রানী কর্ণাবতী রাজপুত রাজাদের কাছে সাহায্য চান কিন্তু কোন রাজাই বিক্রমাদিত্যকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেননি। পরে রানী কর্ণাবতী সিসোদিয়ার কথা বলে সাহায্যের জন্যে অনুরোধ করেন। তার এ কথায় সব রাজপুত রাজারা একটি শর্তে সাহায্য করতে রাজি হন, সেটা হলো যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে রানী কর্ণাবতীর দুই পুত্র রাণা বিক্রমাদিত্য ও রাণা উদয় সিংকে বুন্দিতে পাঠিয়ে দিতে হবে। রাণী কর্ণাবতী এ শর্তে রাজি হন এবং দুই পুত্রকে বুন্দিতে পাঠিয়ে দেন। এতকিছুর পরও বাহাদুর শাহের সৈন্যবাহিনী ও তাদের ক্ষমতা ও শক্তি সম্বন্ধে রানি কর্ণাবতী খুব ভালো ভাবেই জানতেন তাই যুদ্ধে জয়লাভ করা নিয়ে দুশ্চিন্তায় ছিলেন।

সম্রাট হুমায়ুন

ঠিক এই সময়ে তিনি সাহায্যের আশায় রাজপুতদের দীর্ঘদিনের শত্রু মোঘল সম্রাট হুমায়ুনকে চিঠিটি পাঠান। ঐ চিঠিতে রানী কর্ণাবতী দিল্লীর তৎকালীন সম্রাট হুমায়ুনকে ভাই ডাকেন এবং তার সাহায্য চেয়ে চিঠি পাঠান। প্রধান উজির হুমায়ুনকে কর্নাবতীর ডাকে না যাওয়ার পরামর্শ দেন। তিনি আরো বলেন, এসময় হুমায়ুনের ভাই কামরান মির্জা পাঞ্জাব দখল করে আরও শক্তি সংগ্রহ করে চলেছে। পাঠান শের খাঁ বাংলা জয় করেছে, যে কোন সময় আগ্রা আক্রমন করতে পারে। তাছাড়া রাজপুতরা তো মোঘলদের শত্রু, তাদেরকে সাহায্যর কোন প্রয়োজন নাই।

কিন্তু হুমায়ুন সেসব কথা কানে তোলেন না।

রানী কর্ণাবতীর পাঠানো রাখি, ভাই ডাক ও সাহায্যের অনুরোধে সম্রাট হুমায়ুন আবেগতাড়িত হয়ে তাকে সাহায্যের জন্য এগিয়ে যান। তিনি বলেন, একজনের চরম বিপদে যখন আমি তার পাশে দাঁড়াবো তেমনি আমার চরম বিপদেও কেউ আমার পাশে দাঁড়াবে। ( হুমায়ুনের এই কথাটা সত্যি হয়েছিলো। রাজ্যহারা হুমায়ুনকে পারস্য সম্রাট সাহায্য করেন, সেখানেও চিঠির একটা বড় ভূমিকা ছিলো) রানী কর্ণাবতীর চিঠি সম্রাট হুমায়ুনকে এতটাই আবেগপ্রবণ করে তুলেছিল যে, তিনি প্রধান উজিরকে সৈন্যবাহিনী তৈরি করতে বলে গোয়ালিওর থেকে চিতোরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন।

শিল্পীর দৃষ্টিতে জওহর ব্রত পালনের মুহূর্ত; Image Source: RuchisKitchen

চিতোর যাবার পথে এক হ্রদের ধারে যাত্রা বিরতিকালে বাহাদুর শাহ বিশেষ দূতের মাধ্যমে হুমায়ুনের কাছে একটি পত্র পাঠান, যার মুল বক্তব্য ছিলো “ তিনি নিজেকে ধর্মযুদ্ধে নিয়োজিত করেছেন এবং রানী কর্নাবতীর বিরুদ্ধে তার এই যুদ্ধকে ওলেমারা “জেহাদ” আখ্যা দিয়েছেন। সেই দূর্গে অনেক মুসলমান নারীও আছেন এবং তাদেরকে তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিভিন্ন কর্মকান্ডে ব্যাবহার করা হচ্ছে। হুমায়ুন যেন এই যুদ্ধে না যান সেজন্য তিনি বেশ কিছু উপঢৌকনও পাঠান “।

এদিকে রাজপুত রাজারা এক হয়ে গুজরাটের রাজা বাহাদুর শাহের সঙ্গে বীরত্বের সাথে প্রাণপণ যুদ্ধ করেন। কিন্তু সে যুদ্ধে রাজপুত রাজারা পরাজিত হন। বাইরে হৈ চৈ শুনে রানী খবর নিতে গিয়ে শুনলেন, বাহাদুর শাহের সাথে যুদ্ধে হুমায়ুন পরাজিত এবং নিহত হয়েছেন, তাই বাহাদুর শাহের শিবিরে আনন্দ উল্লাস।

এদিকে আসন্ন হার নিশ্চিত জেনে আত্মসম্ভ্রম বাঁচাতে ‘জহরব্রত’ পালনের উদ্দেশ্যে রানী কর্ণাবতী অন্দর মহলে একটি বিশাল অগ্নিকুন্ডে সবাইকে নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মাহুতি দেন। রানীর আদেশে দূর্গের তিন হাজার শিশুকে কুয়ায় নিক্ষেপ করা হয়, যেন এরা শত্রুর হাতে পড়ে অত্যাচারীত না হয়।

হুমায়ুনের বাহিনী চলে আসার কারনে বাহাদুর শাহ দূর্গে ঢুকতে পারলেন না, পালিয়ে গেলেন। পালিয়ে তিনি মান্ডু দূর্গে আশ্রয় নেন । রানী কর্নাবতীর মৃত্যুতে হুমায়ুন প্রচন্ড আঘাত পান এবং বাহাদুর শাহের ওপর আক্রোশে ফেটে পড়েন। মাণ্ডুতে ত্রিশ হাজার অশ্বারোহী সৈন্য নিয়ে তিনি মান্ডু দূর্গ অবরোধ করেন। লম্বা মই লাগিয়ে তীরন্দাজরা দূর্গের পাঁচিলে উঠলো, একদল তীরন্দাজ দূর্গের প্রধান দরজা খুলে দিলো। বাহাদুর শাহ দড়ি বেয়ে দূর্গ থেকে পালিয়ে গেলেন। মান্ডু থেকে পালিয়ে বাহাদুর শাহ আহমেদাবাদের চম্পানি দূর্গে আশ্রয় নিয়ে মোঘলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে থাকেন। হুমায়ুন সেই দূর্গ আক্রমন করলে তিনি পালিয়ে কম্ব দূর্গে আশ্রয় নেন। হুমায়ুন কম্ব দূর্গে ঘন্টাখানেকের মধ্যে পৌঁছালে তিনি আবার পালান। কম্ব দূর্গের সমস্ত ধনরত্ন ও বাহাদুর শাহের ভবিষৎ বলতে পারা পোষা তোতাপাখি এসে পড়ে হুমায়ুনের হাতে।

জওহর ব্রত পালনের পূর্বে চিত্তরগড় দূর্গের দেয়ালে দেয়া রানীদের হাতের ছাপ; Image Source: India Opines

পরে বাহাদুর শাহ পর্তুগিজদের সাথে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়লে পর্তুগিজরা তাকে বন্দি করে পর্তুগিজ অধিকৃত দিউতে পাঠিয়ে দেয়। সেখানে পর্তুগিজরা বাহাদুর শাহকে হত্যা করে। মৃত্যুর সময় বাহাদুর শাহের বয়স হয়েছিল ৩১ বছর। সম্রাট হুমায়ুন বোনকে বাঁচাতে না পারলেও বোনের সন্তান রাণা বিক্রমাদিত্যকে আবার সিংহাসনে বসান এবং নিজ রাজ্যে ফেরত যান।

তথ্যসূত্র:-
১। বাদশাহ নামদার – লেখক হুমায়ুন আহমেদ
২। উইকিপিডিয়া