গোপাল ভাঁড়ের গল্প কে না জানে ! তার হাস্যরসের গল্প পড়ে বা শুনে কেউ হাসেনি, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া ভার। কে ছিলো এই গোপাল ভাঁড় ? প্রায় প্রতিটি হাস্যরসাত্মক গল্পে গোপাল ভাঁড় ও মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের নাম জড়িয়ে আছে।

বাংলা অঞ্চলের প্রবল প্রতাপশালী চরিত্র নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের (১৭১০-৮৩) রাজত্বকাল ছিলো ৫৫ বছরের। ১৭২৮ সালে ১৮ বছর বয়সে তিনি সিংহাসনে বসেন। শিল্প-সাহিত্যের প্রতি তাঁর অনুরাগ ছিলো। তাঁর সভাসদ ছিলেন মধ্যযুগের কবি ভারতচন্দ্র, রামপ্রসাদ সেন, জগন্নাথ তর্ক পঞ্চানন, হরিরাম তর্কসিদ্ধান্ত। পন্ডিতরা বলেন, কৃষ্ণচন্দ্রের সভার অনেক রত্নের এক রত্ন ছিলেন গোপাল ভাঁড়। অজিতকুমার ঘোষ লিখেছেন, ‘গোপাল রসিক-চূড়ামণি মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের রাজসভার ভাঁড় ছিলেন’।

“ কৃষ্ণচন্দ্র গোপালকে একবার বললেন, ‘আমি সত্য-মিথ্যার মধ্যে দূরত্ব অনুমান করতে পারছি না। এ ব্যাপারে তুমি আমাকে একটু সাহায্য করলে ভালো হয়।’ গোপাল বললেন, ‘এ আর এমন কী কঠিন সমস্যা, মহারাজ! চোখ আর কানের মধ্যে যতটা দূরত্ব, সত্য ও মিথ্যার মধ্যেও ততটা।’ গোপালের কথার মাজেজা বুঝলেন না কৃষ্ণচন্দ্র। বললেন, ‘বুঝিয়ে বলো। আমি তোমার কথার অর্থ বুঝতে পারলাম না।’ এবার গোপাল বললেন, ‘মহারাজ, যা শুনবেন, তা যদি চাক্ষুষ প্রমাণ করতে পারেন, তবে তা-ই হলো সত্যি। আর কানে শুনলেন, চোখে দেখলেন না, এটা কখনো সত্যি নয়। সে জন্যই সত্য-মিথ্যার সঙ্গে চোখ-কানের সম্পর্ক খুবই গভীর এবং চোখ-কানের মধ্যে দূরত্ব যতটা, সত্য-মিথ্যারও দূরত্ব ততটা।”

গোপাল ভাঁড় চরিত্রটি ঐতিহাসিক, গবেষক ও ভাষাবিদদের কাছে বহুকাল ধরে বিতর্কের বিষয়।। গোপালের গল্পগুলি সমাজে জনপ্রিয় ও প্রচলিত হলেও গোপাল ভাঁড় বাস্তবে ছিলেন কিনা সে নিয়ে মতভেদ আছে। অনেকেই মনে করেন গোপাল ভাঁড় নামে নির্দিষ্ট কেউ ছিলেন না।

সুকুমার সেন, পরিমল গোস্বামী, অতুল সুর কি অজিতকৃষ্ণ বসু পণ্ডিতেরা গোপাল ভাঁড়ের বিভিন্ন প্রসঙ্গে যখন দ্বিধান্বিত তখন ১৯২৬-এ (১৩৩৩ বঙ্গাব্দ) ১৯২৬-এ (১৩৩৩ বঙ্গাব্দ) লেখক শ্রীনগেন্দ্রনাথ দাসের লেখা ‘নবদ্বীপ কাহিনী বা মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র ও গোপাল ভাঁড়’ নামের একটি বই প্রকাশিত হলো। তিনি স্বয়ং নিজেকে গোপাল ভাঁড়ের বংশধর বলে দাবি করেন। নগেন্দ্রনাথের মতে, গোপালের প্রকৃত নাম গোপাল চন্দ্র নাই। তিনি ছিলেন রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের রাজ অন্তঃপুরের ভান্ডারের তত্ত্বাবধায়ক। তাই গোপাল চন্দ্র নাই থেকে তাঁর পদবি হয়ে গেল ভান্ডারি। ভান্ডারি থেকে আরও পরে ভাঁড়। তাঁর বাবার নাম দুলাল চন্দ্র নাই। প্রপিতা আনন্দরাম নাই। জাতিতে তাঁরা নাপিত।

গোপালের বাবা দুলাল চন্দ্র নবাব আলিবর্দী খাঁর বৈদ্য ছিলেন। তখন নাপিতরা শুধু ক্ষৌরকর্মই করত না, তাদের অস্ত্রোপচারেও জ্ঞান ছিলো। নগেন্দ্রনাথ দাস নবদ্বীপ কাহিনীতে তথ্য দিয়েছেন, “ গোপালরা ছিলেন দুই ভাই। বড় ভাই কল্যাণ আর ছোট ভাই গোপাল। তাঁর জন্ম আঠারো শতকের মাঝামাঝি, মুর্শিদাবাদে”। নগেন্দ্রনাথ আরও লিখেছেন, ‘মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায় গোপালের গুণে মুগ্ধ হইয়া তাঁহাকে গোয়াড়ী কৃষ্ণনগরে লইয়া যান। গোপাল অতি সুপুরুষ ও বাল্যকাল হইতে সুচতুর ও হাস্যোদ্দীপক বাক্যাবলী প্রয়োগে বিশেষ পটু ছিলেন। মহারাজ বিক্রমাদিত্যের ন্যায় মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের একটি পঞ্চরত্নের সভা ছিল। মহারাজ কৃষ্ণ গোপালের প্রত্যুৎপন্নমতি ও বাকপটুতা দেখিয়া তাঁহাকে স্বীয় সভায় অন্যতম সদস্য পদে নিযুক্ত করেন।…গোপালের একটি পুত্র ও রাধারাণী নামে একটি কন্যা ছিল। রাধারাণীর দুই পুত্র রমেশ ও উমেশ। বহুদিন হলো সে বংশ লোপ পাইয়াছে”।

অথচ গোপাল ভাঁড়ের নাম বলতেই আমাদের চোখের সামনে ভাসে বিশাল ভুঁড়িওয়ালা মোটা এবং টাক মাথার একটা মানুষ।

১৯২৬ সালে কলকাতা শহরের সুকিয়া স্ট্রিট থেকেই বেরিয়েছিল এমন এক বই বা দলিল, যাতে গোপালচন্দ্র ও তাঁর বংশপরিচয় নিয়ে তথ্য দেওয়া আছে। এই বইয়ের লেখক নগেন্দ্রনাথ দাস বইতে দাবি করেছেন তিনি গোপাল ভাঁড়ের বংশের উত্তরপুরুষ। গোপাল ছিলেন তাঁর ঠাকুর্দার ঠাকুর্দার কাকা। ১৯৫২ সালে হোমশিখা পত্রিকা গোপাল ভাঁড়ের ওপর বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করে। সেখানে ‘গোপাল ভাঁড়ের নামে প্রচলিত গল্পসংগ্রহ’ নামের প্রবন্ধে অধ্যাপক মদনমোহন গোস্বামী একই কথা লেখেন, ‘শোনা যায়, মহারাজের (রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের) সভায় আরেকটি রত্ন ছিলেন—তিনি স্বনামখ্যাত রসসাগর গোপাল ভাঁড়।’

কিন্তু কিছু পণ্ডিত সন্দেহ করে বলেন…. কৃষ্ণচন্দ্র তাঁর সভাসদ কবি ভারতচন্দ্র ও সংগীতজ্ঞ রামপ্রসাদ দুজনকেই জমি দান করেছিলেন। গোপাল যদি কৃষ্ণচন্দ্রের প্রিয়পাত্র ও ওই আমলের লোক হবেন, তবে নদীয়া বা কৃষ্ণনগরে তাঁর কোনো জমিজমা নাই কেন? এমনকি কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির মহাফেজখানায় গোপালের বিষয়ে কোনো দালিলিক প্রমাণও নাই, তাঁর কোনো ছবিও নেই। তবে শুধুমাত্র কৃষ্ণনগর রাজবাড়িতে গোপালের ছবি বলে একটি অয়েল পেইন্টিং ঝোলানো রয়েছে, যেখানে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রও রয়েছেন। সেটি নিয়েও ঐতিহাসিক মহলে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।

গোপাল ভাঁড় আর মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রকে আরেকটা গল্প শুনি——- মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের কাছ থেকে গোপাল মাঝে মাঝে নানান অভাব-অনটনের কথা বলে প্রচুর টাকা বখশিস পেত। মহারাজ সেজন্য দু-হাত ভরে পুরষ্কার দিতেন। কিন্তু নতুন বড় বাড়ি করার সময় গোপালের আর্থিক টান পড়ল।

মজুরদের বকেয়া পাওনা মিটানোর জন্য আরো কিছুটাকা না আনলে চলবে না। কিন্তু মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের কাছে অভাব অনটনের কথা বলে আবার হাত পাততে গোপালের খুব লজ্জা হচ্ছিল। তাই গোপাল মহারাজ কুষ্ণচন্দ্রের কাছ থেকে টাকা আনবার এক অভিনব উপায় বের করল। বাপের পরামর্শমতো গোপালের ছেলে রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের কাছে গিয়ে কাঁদো কাঁদো হয়ে বললে, মহারাজ, গতকাল রাত্রে আমার বাবার কৃষ্ণপ্রাপ্তি ঘটেছে।

গোপালের ছেলের কথা শুনে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র ভীষণ দুঃখ পেলেন। রাজা ভাবলেন, কৃষ্ণপ্রাপ্তি , মানে মৃত্যু। গোপালের আকস্মিক মৃত্যুর কথা শুনে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র শোকাতুর হলেন। তিনি খাজাঞ্জিকে ডেকে গোপালের ছেলেকে দু-হাজার টাকা দিতে বললেন। পরে শ্রাদ্ধাদি কাজের জন্য আরও পাঁচ হাজার টাকা দিবেন বলে গোপালের ছেলেকে প্রতিশ্রুতি দিলেন। গোপালের ছেলে রাজার দেওয়া দুহাজার টাকা নিয়ে বাড়ি ফিরে গেল এবং বাবাকে সব কথা বললো। গোপাল মনে মনে হেসে নিলো। যাক এখনকার মত কাজটা মিটে গেল বটে তবে পরে কি হবে সেটাই ভাবনা।

পরে যখন মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র জানতে পারলেন যে, গোপাল মারা যায়নি, দিব্যি বহাল তবিয়াতে বাড়ি তৈরির কাজ তদারক করছে। একথা শুনে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র ভীষণ চটে গেলেন। তক্ষুনি কয়েকজন পেয়াদা পাঠালেন গোপালকে বেঁধে আনার জন্য। যে অবস্থায় থাকে সেই অবস্থায় যেন নিয়ে আসে। যথাসময়ে গোপাল গায়ে একটা চাদর দিয়ে ছেলে সহ পেয়াদাদের সঙ্গে রাজসভায় এলো, যেন কিছুই হয়নি।

মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র গোপালকে বললেন, তুমি আর তোমার ছেলে দুজনেই ঠক ও জোচ্চোর। এত স্পর্ধা তোমাদের যে আমার সঙ্গেও প্রতারণ করতে সাহস পাও। তোমাকে আজও শুলে চড়ানো হবে। রাজসভায় ভাঁড় বলে কোন খাতির করা হবে না। তোমাকে বহুবার ক্ষমা করেছি, এবার কোনমতে ক্ষমা করা চলবে না। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের কথা শুনে রাজসভার অন্য সকলেই ভাবল, গোপালের আর নিস্তার নেই। রাজসভায় সবাই যখন গোপালের ভবিষ্যতের নিয়ে শঙ্কিত গোপাল তখন আগের মতই নির্বিকার যেন কিছুই হয়নি কিন্তু মুখে কিছুই বলছে না। গোপালের নির্বিকার ভাব দেখে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র প্রচন্ড রেগে গিয়ে বললেন, আমার সঙ্গে চালাকি? দাঁড়াও দেখাচ্ছি মজা। তখন গোপাল চাদরের নিচে থেকে একটি পাথরের কৃষ্ণমূর্তি বের করে রাজাকে বললে, হুজুর আমার ছেলে আপনাকে মোটেই প্রতারণা করেনি। সে কোন মিথ্যা কথাও বলেনি। সত্যি সত্যিই কাল রাতে পাথরের এই কৃষ্ণমূর্তিটি পেয়েছি। কৃষ্ণপ্রাপ্তির জন্য যদি শূলে চড়াতে চান-চড়ান। আমি যেখানে বাড়ি তুলছি মাটির নিচেই এই নটবর শ্যামল কিশোরকে পাওয়া গেছে। দেখুন কি সুন্দর মুর্তি।

গোপালের মূর্ত্তির কথা শুনে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র হতভম্ব হয়ে গেলেন। গোপালের মুখে তার কৃষ্ণপ্রাপ্তি প্রসঙ্গ শুনে রাজসভার অন্য সকলেই হো হো করে হেসে উঠল। মহারাজও না হেসে পারলেন না। ভাবলেন, হ্যাঁ- এ কৃষ্ণপ্রাপ্তিই বটে! আমারই বোঝার ভুল। সঙ্গে সঙ্গে প্রতিশ্রুতি মত আরও পাঁচ হাজার টাকা ও গোপালকে হয়রানি করার জন্য আর কিছু পুরষ্কার তৎক্ষণাৎ দিতে আদেশ দিলেন।

গোপালের অস্তিত্ব নিয়ে যাঁদের সন্দেহ ছিলো তাঁরা যুক্তি খুঁজে পেয়েছেন ভারতচন্দ্রের লেখা থেকে। মধ্যযুগের বিশিষ্ট এই কবি অন্নদামঙ্গল কাব্যে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র ও তাঁর সভাসদদের অনেকের সম্পর্কে লিখলেও গোপাল ভাঁড় বিষয়ে কিছুই লিখেন নি। তাঁদের মতে গোপাল যদি তাঁর সমসাময়িক এবং একই সভার সদস্য হতেন, তবে ভারতচন্দ্রের লেখায় তাঁকে পাওয়া যেত।

২০১৪ সালে ‘গোপাল ভাঁড়ের সন্ধানে’ নামে সুজিত রায় প্রায় ৩০০ পৃষ্ঠার একটি বই লিখেছেন। নগেন্দ্রনাথ দাসের বর্তমান বংশধরদের বক্তব্য ওই বই থেকে উদ্ধৃত। বিভিন্নজনের বিচিত্র লেখাপত্রের সঙ্গে ইতিহাসকে মিলিয়ে তিনি গোটা বইয়ে খুঁজেছেন হাস্যরসিক গোপাল ভাঁড়ের বাস্তব অস্তিত্ব। নানা রকম প্রশ্ন ও যুক্তি খণ্ডন করে গোপালকে নির্দিষ্ট ব্যক্তি হিসেবে উপস্থিত করার দিকেই তাঁর বেশি ঝোঁক।

সবশেষে হাস্যরসিক গোপাল ভাঁড়ের আর একটা চালাকির গল্প •••••

ছোটবেলায় গোপাল মামাবাড়ি থেকে নিজের বাড়িতে ফিরছিলো। পথের ধারে মিষ্টির দোকান দেখে তার খিদেও পেয়ে গেলো। কিন্তু হাতে কোনো টাকাপয়সা নেই। কী করা যায়? গোপাল দেখলেন, দোকানে বসে আছে ময়রার ছেলে। আর তার বাবা দুপুরের খাবার খাচ্ছে পেছনের ঘরে বসে। দোকানে ঢুকে থালায় সাজানো মিষ্টিগুলি টপাটপ করে খেতে শুরু করলো। ময়রার ছেলে তো অবাক। ‘কে রে তুই? বলা নেই, কওয়া নেই, দিব্যি মিষ্টি খেয়ে চলেছিস? কী নাম তোর?’ বলল সে। একের পর এক মিষ্টি পেটে চালান দিতে দিতেই গোপালের জবাব, ‘আমার নাম মাছি। আমি তো রোজই মিষ্টি খাই। তুই কি নতুন দেখলি আমাকে?’ ছেলেটি এরপর তার বাবাকে ডেকে বলল, ‘বাবা, মাছি মিষ্টি খাচ্ছে।’ বাবা বলল, ‘খাগগে। ও আর কত মিষ্টি খাবে। রোজই তো খাচ্ছে। তুই কোনো দিন ওকে আটকাতে পারবি না।’ শেষমেশ ছেলে আর কী করে! চুপ হয়ে গেল। গোপাল ততক্ষণে দোকানের সন্দেশগুলো শেষ করে পেটে হাত বোলাতে বোলাতে বাড়ির পথ ধরলো।

গোপাল ভাঁড়ের জনপ্রিয়তাকে পুঁজি করে এর মধ্যেই তৈরি হয়েছে সিনেমা, টেলিভিশন ধারাবাহিক ও অ্যানিমেশন ছবি।

#তথ্যসূত্র #উইকিপিডিয়া #ইন্টারনেট

Images Collected From Google