দিল্লি শহর। ‘লাল কুয়ান’ নামের এক ভবনে আবদুল মজিদ নামে একজন হাকিম সাহেব একটা দাওয়াখানা খুললেন। সময়টা গ্রীষ্মকাল। দিল্লিতে তখন প্রচন্ড গরম। এই গরমের কারণেই প্রচুর মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ছিলো। হাকিমের দাওয়াখানায় রোগীর সংখ্যা বেড়েই চলছিলো। দাওয়াখানায় অপেক্ষারত রোগীদের সেবা ও স্বস্তি দেওয়ার জন্য হাকিম সাহেব একটি শরবত তৈরী করলেন। এই শরবতই হলো রুহ-আফজা।

দিল্লিতে হামদর্দ রুহাফজার ভিত্তি স্থাপন কারি

হাকিম হাফিজ আব্দুল মজিদ রাজধানী দিল্লিতে হামদর্দ দাওয়াখানার ভিত্তি স্থাপন করেন।

হামদর্দ ল্যাবরেটরীজ বাংলাদেশের ওয়েবসাইট অনুসারে, ‘রুহ-আফজা’ নামটি শঙ্কর নাসিমের মসনবী ‘গুলজার-ই-নাসিম’ এর একটি চরিত্র থেকে নেয়া হয়েছিলো। এই বইটি ১২৫৪ সালে প্রকাশিত হয়েছিলো। লেখকের মতে, রুহ-আফজা ছিলেন স্বর্গের রাজকন্যা। ঠিক তেমনি পানীয় রুহ-আফজা পরিণত হয়েছিলো প্রাচ্যের গ্রীষ্মকালীন পানীয়ের রাজকন্যাতে।

রুহ-আফজার নাম হয় যে বই থেকে

শঙ্কর নাসিমের মসনবী ‘গুলজার-ই-নাসিম’ বইয়ের কাভার

এই শরবতটি তৈরী করা হয়েছিলো অনেকগুলো ভেষজ উদ্ভিদ, ফুল, ফল, শাক-সবজি ও গাছ-গাছড়ার রস ব্যবহার করে। রোগীরা আসার সাথে সাথে হাকিম আবদুল মজিদ তাদেরকে আপ্যায়ন করতেন এই শরবতের মাধ্যমে। এরপর তার ঐ দাওয়াখানা থেকে প্রথমে দিল্লি এবং পরে সমগ্র ভারতবর্ষে রুহ-আফজার নাম ছড়িয়ে পড়লো।

হাকিম সাহেবের দাওয়াখানা খুব ভালোই চলছিলো। কিন্তু হয়তো তার ভাগ্য প্রসন্ন ছিলো না। খুব অল্প বয়সে হঠাৎ করেই মৃত্যুবরণ করলেন তিনি। মৃত্যুর পরে তার স্ত্রী এই রুহ-আফজার সম্পূর্ণ দায়িত্ব পেলেন। তিনি একটি ট্রাস্টের মাধ্যমে এটিকে চালাতে শুরু করলেন। পরবর্তীতে তার সন্তানেরা বড় হবার পর তারাই এই শরবতের দায়িত্ব বুঝে নিলেন।

এরই মধ্যে ১৯৪৭ সালে যুদ্ধের দামামায় ভারতবর্ষ ভাগ হয়ে গেলো। দুই ভাইয়ের মধ্যে একজন চলে আসলেন পাকিস্তানে, আরেক ভাই রয়ে গেলেন দিল্লীতে। ছোট ভাই ইস্টার্ণ মেডিসিন বিষয়ে পড়াশোনা করেন এবং ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানে ‘হামদর্দ’ প্রতিষ্ঠা করেন। আস্তে আস্তে পাকিস্তানেও শরবতটি বেশ জনপ্রিয়তা পেলো। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হলে রুহ-আফজা নিয়ে বাংলাদেশে আলাদাভাবে ব্যবসা শুরু করে হামদর্দ। এভাবে এক এক করে বহু দেশে ছড়িয়ে পড়লো রুহ-আফজা।

রুহাফজার একটি বিজ্ঞাপন

১৯৬০-এর দশকের-র রুহাফজার একটি বিজ্ঞাপন

সেই ১৯২২ সালে তৈরী হওয়া শরবত রুহ-আফজা আজ ১০০ বছর পরও সবার কাছে জনপ্রিয় এক পানীয়। পুরনো দিল্লীতে গোলাপের সুবাস ছড়িয়ে মানুষের মনে সুগন্ধের মাদকতা জাগিয়ে গ্রীষ্মের দাবদাহ থেকে বাঁচাবার জন্য যে শরবতটি তৈরী হয়েছিলো, তা আজও বেঁচে আছে।

মাঝে মাঝে জানতে ইচ্ছে করে, হাকিম মজিদ কি পরপার থেকে তার এই সৃষ্টির সাফল্য দেখতে পাচ্ছেন? দিল্লীর ছোট্টো এক গলি থেকে তৈরী হওয়া রুহ-আফজা এক ফারসি নাম নিয়ে ১৯৪৭-এ দেশভাগের ঝঞ্ঝাট মোকাবেলা করে ১০০ বছরে পা দিয়েছে। বররত্মানে প্রায় ৩৭টি দেশে স্বর্গের রাজকন্যা রুহ-আফজা আজও রাজত্ব করছে। পবিত্র রমজান মাস আসলে যে শরবতের কথা সবচাইতে বেশি মনে পড়ে, তা হচ্ছে হামদর্দের এই রুহ-আফজা। প্রতিটি মানুষের সাথে এর একটি পারিবারিক বন্ধন তৈরী হয়েছে। ইফতারের সময় এই শরবত ইফতারের টেবিলে দেখে নি, এমন মানুষ কমই পাওয়া যাবে।

রেফারেন্সঃ