১৬২৩ সালের নভেম্বর মাস। মোঘল সম্রাট শাহজাহান আমাদের ঢাকার নাজিম উদ্দিন রোডের কেন্দ্রিয় কারাগার থেকে যে রাজ্য পরিচালনা করেছিল; সে গল্পটা আমরা কজন জানি। তখন তিনি কেবলমাত্র যুবরাজ খুররম এবং দাক্ষিণাত্যের বোরহানপুরের ভাইসরয় ছিলেন। শাহজাহান তার বাবা জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বাংলাদেশে আসেন। শাহজাদা খুররম জাহাঙ্গীরের অতি আদরের সন্তান কিন্তু, রাজসিংহাসন আর প্রাসাদ রাজনীতি বড় বিচিত্র! তার বিদ্রোহ পিতার কাছে ছিল অপ্রত্যাশিত ও গভীর বেদনার। নূরজাহানের চক্রান্তে সিংহাসনের উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত হবেন, এমন আশঙ্কায় তিনি এই বিদ্রোহ করেন। বিশাল সৈন্যবাহিনি নিয়ে দ্রুত মাদ্রাজ উপকূল হয়ে উড়িষ্যা পৌঁছান এবং উড়িষ্যা দখল করেন। বাংলা বিজয় অভিযানে আসার পথে তিনি বর্ধমান, মেদিনীপুর ও রাজমহল জয় করেন। রাজমহল ছিল আকবরনগর নামে পরিচিত।
আকবরনগরে রাজা ভীমকে দায়িত্বে রেখে এবং সম্রাজ্ঞী মমতাজ মহলকে প্রাসাদে রেখে; তিনি নয় দিনে ঢাকায় উপস্থিত হন। সুবাদার ইব্রাহীম খানের ভাতিজা আহমেদ বেগ ঢাকা প্রবেশ তোড়ন খুলে দেন। তারপর যুবরাজ খুররমকে নগদ প্রায় ৪০ লাখ রুপি সহ বহু মসলিন বস্ত্র, শাহি অস্ত্রাগারের গোলাবারুদ ও যুদ্ধ-উপকরণ, ৫০০ হাতি, ৪০০ ঘোড়া, এবং গোলন্দাজ বাহিনীর প্রায় পুরো সরঞ্জাম উপহার দেন। যুবরাজ খুশি হয়ে তার বিশ্বস্ত সেনাদের মাঝে এসব উপহার ও ধনরত্ন মুক্তহস্তে বিলি করে দিয়েছিলেন। মির্জা নাথানের ‘বাহারীস্থান-ই-গায়বী’ বই থেকে আমরা জানতে পারি যে, শাহাজাদা যখন ঢাকা বিজয় অভিযান করেন। সেইসময় বাংলার সুবাদার ছিলেন ইবরাহীম খান ফতেহ জঙ্গ। ইবরাহীম খান ছিলেন সম্রাজ্ঞী নূরজাহানের ভাই। আসলে, তিনি সম্রাট জাহাঙ্গীরের ও যুবরাজ খুররমের মধ্যে সংঘর্ষে দিধাদ্বন্দে পড়ে যান। শেষ পর্যন্ত তিনি দিল্লীর সম্রাট জাহাঙ্গীরের পক্ষ নিয়েছিলেন।
মির্জা নাথান লিখেছেন, ‘আরাকানরাজ অত্যন্ত অনুগতভাবে আবেদন জানান, তাঁকে একজন অনুগত সামন্ত হিসেবে বিবেচনা করতে।’ মুসা খানের পুত্র মাসুম খান বশ্যতা স্বীকার করেছিল এবং পর্তুগিজরা যুদ্ধ নৌকা দিয়ে সাহায্য করেছিল। যুবরাজ খুররম ঢাকা দুর্গের ভেতর ইবরাহীম খানের মনোরম প্রাসাদে সাত দিন অবস্থান করেন। সেখানে তিনি রুকিয়া সুলতানা বেগমের অতিথি হয়েছিলেন। রুকিয়া বেগম ছিলেন সুবাদার ইবরাহীম খানের স্ত্রী। এই প্রাসাদটি আসলে বর্তমান ঢাকা কেন্দ্রিয় কারাগারের ভেতরে যে পুরাতন ধবংসপ্রাপ্ত ভবনটি ছিল সেটি। এই বাদশাহী দুর্গটি ইবরাহীম খান নির্মাণ করেন। কারো কারো মতে, এটি প্রাচীন দুর্গ। সাত দিন তিনি ঢাকায় অবস্থানকালে নিয়মিতভাবে প্রতিদিন ঝড়োকা দর্শন করতেন, গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সাথে দেখা করতেন, রাজ্য পরিচালনার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করতেন। আসলে সম্পদ ও সময় উভয়ের বিনিময়ে তিনি তাদের আনুকূল্য পাওয়ার চেষ্টা করেন। তিনি বাংলার রাজকর্মচারীদের অনেক রদবদল করেন ও কিছু ক্ষেত্রে স্থানান্তর করেন।
দরাব খানকে বাংলার নতুন সুবেদার নিয়োগ করেন। তারপর তিনি ঢাকা ত্যাগ করেন। সিপাহসালার ও অন্য কর্মচারীদের স্থলপথে পাঠিয়ে, তিনি নদীপথে ফিরতে গিয়ে প্রথমে নারায়ণগঞ্জের কদম রসূল জিয়ারত করেন। তারপর শাহজাদা খিজিরপুরে অবস্থান করেন। সেখান থেকে কলকোপা, যাত্রাপুর, ও বালিয়া যান। এরপর পাটনা অভিমুখে যাত্রা করেন; সেখানে মমতাজ মহলকে সাথে নিয়ে উড়িষ্যা ও বাংলার অধিপতি শাহজাদা খুররম দাক্ষিণাত্যে ফিরে যান। সাধারন জনগন সকলেই মনে করেন, শাহজাহান মানেই তাজমহল-দিল্লী-আগ্রা-ময়ূর সিংহাসন; কিন্তু শাহজাহানের সাথে যে বাংলা, ঢাকা, নাজিম উদ্দিন রোডের সাথে অনেক স্মৃতি জড়িয়ে রয়েছে, তাই এখানে তুলে ধরা হলো।
তথ্যসূত্রঃ গিলিম্পেসেস অব ওল্ড ঢাকা, সৈয়দ মুহাম্মদ তৈফুর,
ও, মির্জা নাথানের ‘বাহারীস্থান-ই-গায়বী’ বই।