বাউণ্ন্ডুলেপনা ছিল তাঁর রক্তে। নইলে রাজপরিবারের উত্তরাধিকারী হয়ে কেউ সব ছেড়েছুড়ে এমন ভবঘুরে জীবন কাটায়? উত্তরবঙ্গের চাঁচোল। সেখানকার রাজা ঈশ্বরগুপ্তের দুই স্ত্রী। সিদ্ধেশ্বরী আর ভূতেশ্বরী। রাজা দুই স্ত্রীকেই অপুত্রক রেখে মারা গেলেন। তখন সিদ্ধেশ্বরী দেশের থেকে নিজের বোন বিন্ধ্যেশ্বরীর ছেলে শিবপ্রসাদকে নিয়ে এসে তাকে দত্তক নিলেন। এই শিবপ্রসাদ চক্রবর্তীই হলেন শিবরামের বাবা। শিবপ্রসাদ রাজসম্পত্তির উত্তরাধিকারী তো হলেন কিন্তু তার এসবে কোনও কালে মন নেই। সংসারে থেকেও সন্ন্যাসী। জাগতিক সব কিছুতেই নির্লিপ্তি। আর মা? যাঁর প্রতি শিবরামের ছিল আজীবনের গভীর ভালবাসা, তিনিও সারাক্ষণ আধ্যাত্মিক জগতেই থাকতেন। শিবরাম ছোটবেলা থেকেই দেখতেন বাড়িতে তার বাবা এবং মা, এই দু’জনের কেউই যেন লৌকিক জগতে থেকেও নেই। ফলে শিবরামেরও তাই হল। সংসারের প্রতি মায়া জন্মাল না। একেবারে অল্প বয়স থেকেই বাড়ি ছেড়ে বারবার পালাত কিশোর শিবরাম। কখনও পাহাড়, কখনও সমুদ্র, যখন যেখানে খুশি। পকেটে এক পয়সাও নেই। ট্রেনে চেপে বসে, যা হোক তা হোক করে, যেখানে খুশি যত দিন খুশি কাটিয়ে আবার সে ফিরে আসত বাড়ি। শিবরামের বাবা ছোটবেলায় শিবরামের বিভিন্ন রকমের বই পড়ার নেশা দেখে খুশি হয়ে বলেছিলেন, গ্রন্থি ভবতি পণ্ডিতঃ –যারা গ্রন্থ নিয়ে পড়ে থাকে তারাই পণ্ডিত হয়। এই শুনে শিবরামের মা বলেন, ঠিকই ই বলেছিলেন তোর বাবা। যারা বই মুখে করে পড়ে থাকে সব সময়, তাদের সবকিছুই পণ্ড হয়ে যায়, সেইজন্যেই তারা পণ্ডিত।
স্কুল পাশ করার পরীক্ষাটা অবশ্য দিতেই হয়েছিল সি আর দাশের নির্দেশে। কিন্তু ম্যাট্রিক পাশ দিয়েই আবার পুরোদমে স্বদেশী আন্দোলনে। তখন হাজারে হাজারে ছেলে জেলে যাচ্ছে ‘বন্দেমাতরম’ বলে। শিবরামেরও খুব শখ জেলে যাওয়ার। কিন্তু অমন ল্যাকপেকে চেহারা দেখে পুলিশ কিছুতেই আর ধরে না। একদিন ধরল। বলা যায় নিজেই একরকম ধরা দিলেন। জেলে গিয়েও অবাক শিবরাম। গ্রামে তার কিশোরী প্রেমিকা রিনি, যে কলকাতায় চলে এসেছিল সেও রয়েছে ওই জেলে। জেলের মধ্যেই আবার প্রেমিকার সঙ্গে পুনর্মিলন। কিন্তু বেশি দিনের সুখ তো শিবরামের কপালে নেই। কয়েক দিন পরেই অন্য জেলে বদলি হয়ে গেল শিবরাম। আবার বিচ্ছেদ। ‘কল্লোল যুগ’ বইয়ে বন্ধুবর অচিন্ত্য সেনগুপ্ত শিবরাম সম্পর্কে শুধু ভালো ভালো কথা লেখেননি, প্রকাশক ডি এম লাইব্রেরিকে বলে রেখেছিলেন ওঁর কমপ্লিমেন্টারি কপি থেকে শিবরামকে একটা দিতে। ডি এম লাইব্রেরির কর্ণধার শিবরামকে চিনতেন। শিবরাম সেই বই চাইতে গেলে বললেন, ‘কী করবেন বই নিয়ে, ফুটপাথে বেচে দেবেন তো? নাম খারাপ হবে আমাদের। তার চেয়ে দামটাই না হয় দিয়ে দিই। এই নিন পাঁচ টাকা।’ শিবরাম ফুটপাথের উলটোদিকে চাচার হোটেলে গিয়ে ভালোমন্দ খেলেন।
সে বার টাকার খুব টানাটানি চলছে। খবর কানে গেল দেশবন্ধুর। শিবরাম চিরকালই তাঁর বড় প্রিয়, বারবার বলতেন, শিবরাম আলাদা জাতের। অনেক প্রতিভা। দেশবন্ধু চিঠি লিখলেন সুভাষ বোসকে।— ‘শিবরামকে আত্মশক্তি কাগজে নিয়ে নাও। ভালো লেখে ও।’ গুরুদেবের আদেশে শিবরামকে চাকরিতে নিলেন নেতাজি। কিন্তু মানুষটি যে শিবরাম ! নিয়মকানুনের ধারে কাছে নেই। কোনও দিন অফিস যান তো কোনও দিন পাত্তাই নেই। কখন আসেন আর কখন বেরিয়ে যান তা’ও কেউ জানে না। সুভাষ বোসের কানে গেল সেকথা। এমন আচরণ নিয়মনিষ্ঠ নেতাজির কোনও মতেই পছন্দ নয়। শিবরামকে ওয়ার্নিং দিলেন যথাসময়ে সময়ে রোজ দপ্তরে আসার জন্য। কিন্তু শিবরাম কোনও দিনই বা কার কথা শুনে চলেছেন? ফলে যা হওয়ার তাই হল। একদিন হাতে একটি খাম পেলেন। তার মধ্যে একশো টাকার একটি নোট আর সুভাষচন্দ্রের একটি একলাইনের চিরকুট। তাতে লেখা।— ‘আপনাকে আর দরকার নেই।’ চাকরি নেই। এবার দিন চলবে কী করে? ভয়ে তো কুঁকড়ে যাওয়ার কথা! কিন্তু তিনি যে শিবরাম ! হাতে বরখাস্ত হওয়ার চিঠি পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন!
কাগজের চাকরি যেমন গেছে তেমনই একবার আস্ত একটা খবরের কাগজেরই মালিক হয়ে গিয়েছিলেন শিবরাম। কিন্তু তার জন্যই আবার জেলে যেতে হল তাকে। যুগান্তর সেবার দেউলিয়া। বন্ধই হয়ে যাবে এমন অবস্থা। মাত্র ৫০০ টাকা দিয়ে শিবরাম কিনে ফেললেন যুগান্তর-এর স্বত্ত্ব, সম্পাদক হলেন। তখন অনেক কাগজেরই ইংরেজ সরকারের কোপে পড়ে ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। যুগান্তর-এ ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে লেখা ছেপে শিবরামও পড়লেন বিপদে।
নারাণবাবুর বাড়ি গেছি একদিন, গৌরাঙ্গদের বাড়ি যাবার পথে গোলপার্কের কাছেই তাঁর আস্তানাটা, নানা ধরণের আলোচনা হচ্ছিল আমাদের। কথায় কথায় শরীর গতিকের কথা উঠল। আমার হাই ব্লাডপ্রেশার, ওঁর তো তা রয়েছেই, তার ওপরে আবার ডায়াবেটিস। ‘আমার ওই ব্লাডপ্রেশারই ভাল মশাই, ডায়াবেটিস আমার চাই না।’ ‘চান না?’ ‘না। ব্লাডপ্রেশারে নুন না খেলেই চুকে যায়, সল্ট-ফ্রি খাবার হলেই হল, কিন্তু ডায়াবেটিসে সুইট-ফ্রি থাকতে হয়। সে ভারী মুস্কিল। মিষ্টি না খেয়ে আমি থাকতে পারি না।’ ‘তা বটে।’ সঙ্গে সঙ্গে ওঁর বাড়ির ভেতর থেকে ফরমায়েসী গরম গরম রসগোল্লা এসে পড়ল। তার সদব্যবহারে লেগে বললুম, ‘ডায়াবেটিস হলে এসব আর মুখে তুলতে পারব কি? শুধু সেই একটিমাত্র মিষ্টি ছাড়া আর কিছুই তো মুখে তোলা যাবে না। এবং সেই মিষ্টিই বা পাব কোথায় এখন? এই বয়েসে কে দেবে আমায় আর!’ আমার কথায় তিনি মৃদু হাসলেন। ব্লাডপ্রেশার নিয়ে খাসাই আছি বলতে কি! দুটি মাত্র ভয় তো, করোনারি থ্রম্বোসিস আর সেরিব্রাল হ্যামারেজ-এর। করোনারি আটকাতে চর্বিজাতীয় কিছু না খেলেই হল। চর্বিতচর্বণ বাদ দিয়েছি একদম। আর সেরিব্রাল হ্যামারেজের হাত থেকে রেহাই পেতে ওষুধ খাই। যা সব চমৎকার ওষুধ বেরিয়েছে না আজকাল ! ‘কী করেন?’ ‘ডাক্তার যা বলেছেন। কাজকর্ম সব বন্ধ করে দিই, আডেলফিন উইথ ইসিড্রেক্স এক বঁটি খেয়েই না লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ি বিছানায়। সলিড কিছু খাই না আর তারপর। খালি হরলিক্স। এই বটি আর বিশ্রাম। দেখতে না দেখতে আরাম।’ ‘কি করে টের পান আসন্ন হ্যামারেজ?’ ‘মাথা ক্রিক ক্রিক করলেই বুঝতে পারি যে, গড়বড় হয়েছে হেড আপিসে। নইলে অকারণে তাঁর এই সহসা ক্রিংকার কেন? যতক্ষণ না সেই ক্রিক রোডের মোড় থেকে ফিরেছে, স্বস্তি নেই আমার। ওষুধ খাবার আর বিশ্রাম নেবার খানিক বাদেই মাথা সহজ হয়ে আসে আবার। তারপরে হরলিক্স খেয়ে টানা ঘুম লাগাই। সেদিন আর কোনও কাজ নেই।’ ‘আরে মশাই আমারো যে মাথা ক্রিক ক্রিক করে মাঝে মাঝেই।’ তিনি জানান। ‘কী করেন আপনি?’ ‘কিছুই না, কী করব! কাজকর্ম যা করার করে যাই তেমনি।’ ‘লেখেন-টেখেন তখনো?’ ‘নিশ্চয়ই!’ ‘কোনও ওষুধ খান না?’ ‘কেন খেতে যাব অকারণে? তাছাড়া, না লিখে কি থাকা যায়? দায় আছে না মাথায়? ডিউটি ফার্স্ট।’ ‘তা জানি। কিন্তু ওষুধ ফোরমোস্ট! সব কর্তব্য ফেলে রেখে ওষুধ খেতে হয় সবার আগে।’ নারায়ণবাবু যেমন লেখা পাগল দেখা গেলো, আমার ভয় হল, কোনদিন না এই লেখার জন্যেই তিনি শহিদ হয়ে যান। ‘ওষুধ বেশি খেতে নেই। যখন তখন তো কখনোই নয়। ওষুধের একটা প্রতিক্রিয়া আছে–সেই বিষক্রিয়ায় আবার ভুগতে হয়।’ ‘জানি, কিন্তু এই ভোগবতী বসুন্ধরায় ভোগ এড়াবার উপায় নেই, হয় ওষুধে ভুগুন, নয় অসুখে ভুগুন – ভুগতেই হবে আপনাকে। ওষুধে ভোগাটাই ভালো নাকি? আর ব্যারামে ভুগলে আপনারও কষ্ট, আপনাকে নিয়ে আশেপাশের আর সবারও ভোগান্তি। বাধ্য হয়ে আমায় আবার ডাক্তার বদলাতেও হয় যে।’ ‘ডাক্তার বদলাতে হয়?’ ‘হবে না? বেঘোরে মারা পড়লে কী করা যায়? বিশ বছর আমি হাই প্রেশারে ভুগছি– এর ভেতর আমার তিন-তিনটে ডাক্তার একই রোগে স্বর্গীয় হয়েছেন। চতুর্থ ডাক্তার, আমার বন্ধুতুল্যই, ডাঃ কে পি রায়কে ধরেছি এখন, জেনেছি তাঁরও এই প্রেশার, তাই করজোড়ে তাঁকে নিবেদন করেছি–‘দোহাই, আমি মারা যাবার আগে যেন মহাপ্রয়াণ করবেন না দয়া করে। তাহলে আমায় দেখবার কে থাকবে? যে ঔষধ আমার জন্যে ব্যবস্থা করেছেন, আপিনিও না হয় তাই খাবেন দরকার পড়লে, অন্যথা না হয়। তিনি প্রথম জীবনে কবি হয়ে থাকলেও পরবর্তীতে গল্প, উপন্যাস, নাটক সবই লিখেছেন। আর প্রায় সবই ছিল রসাত্মক। বাংলা সাহিত্যে শিবরামের মতো রসবোধসম্পন্ন আর কোন সাহিত্যিক আছে কি না, তা নিয়েই প্রচুর তর্ক চলতে পারে।