
মানুষের জ্ঞানানুশীলনের ইতিহাসে গ্রীক দার্শনিক সক্রেটিসের নামটি প্রথমেই উচ্চারিত হয়ে থাকে। তিনি খ্রিষ্টপূর্ব ৪৭০ অব্দে এথেন্সে একটি মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা ছিলেন ভাস্কর মা ধাত্রী। তার শিক্ষাদীক্ষা সম্পর্কে কোন সঠিক ধারণা কেউ দিতে পারেনি। তবে তাঁর অগাধ জ্ঞান তাঁর নিজের চেষ্টা ও অধ্যবসায়ের ফসল। তিনি পৈত্রিক পেশায় ভাস্কর্যে যুক্ত হয়েছেন কিন্তু টিকতে পারেন নি। ভাস্কর্য ছেড়ে সেনা দলে যোগ দিয়েছিলেন কিন্তু সেখানেও ব্যর্থ। অবশেষে দর্শনে আত্মনিয়োগ করেন। দার্শনিক হিসেবে তাঁর এত সুনাম কিন্তু তিনি দেখতে খুবই কুৎসিত ছিলেন। টাক মাথা, পিটপিটে চোখ,চ্যাপ্টা বোঁচা নাক, স্ফীত উদর এবং অস্বাভাবিক গতি ভঙ্গির লোক ছিলেন এই দার্শনিক সক্রেটিস। তাঁর রসবোধ ছিলো প্রচুর। নিজের নাক দিয়ে কৌতুক করে বলতেন, নাকের ফুটো বড় হওয়ার কারণে ঘ্রাণ নেওয়া বিশেষ সুবিধা হয়েছে, আর নাকটি চ্যাপ্টা ও বোঁচা হওয়ার দরুণকোথাও দৃষ্টিশক্তি বাধা পায় না।

ইন্দ্রিয়গত আমোদের কবল থেকে আলসিবিয়াডিসকে ছাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছেন সক্রেটিস। ১৭৯১ খ্রিস্টাব্দে জ্যাঁ-ব্যাপ্টিস্ট রেনোঁ কর্তৃক অঙ্কিত চিত্র।
সংসার জীবিকা সম্পর্কে তিনি খুবই উদাসীন ছিলেন। সারা জীবনই দারিদ্র্যের কশাঘাতে জর্জরিত হয়েছেন। খাদ্যে অরুচি ছিলো কিন্তু পানীয়তে মোটেই অরুচি ছিলো না। স্ত্রী-জানথিপি তাঁকে খুবই তাচ্ছিল্য ও অবজ্ঞা করতেন এবং নিষ্কর্মা স্বামী বলে বাক্যবাণে জর্জরিত করতেন। সক্রেটিসের মৃত্যুর পর স্বামীর মৃত্যু সম্পর্কে তার বোধদয় হয়েছিলো। সক্রেটিস তাঁর দর্শন সম্পর্কে কোনো গ্রন্থ রচনা করেননি। তাঁর মুখ্য বক্তব্য ছিলো ‘নিজেকে জান’। তিনি বলতেন আমি জ্ঞানী নই, কিন্তু জ্ঞানানুরাগী। একটি জিনিসই আমি জানি, তাহলো আমি কিছুই জানিনা। তিনি সেদিনের সমাজের প্রচলিত সুসংস্কার ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে ছিলেন বজ্রকন্ঠ। ফলে সমাজের রক্ষণশীলদের শত্রু হয়ে উঠলেন। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করলো যে, তিনি যুবকদের দুর্নীতি শিক্ষা,জাতীয়,দেবতাদের প্রতি অবিশ্বাস সৃষ্টি, নতুন দেব-দেবীর পরিকল্পনা এবং আইন ও ধর্মদ্রোহী। বিচার হলো বিচারকের সংখ্যাগরিষ্ঠদের মতে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেওয়া হলো। তাকে নিজ হাতে হেমলক লতার বিষপান করে মৃত্যুবরণ করতে হবে। তবে তাঁকে ক্ষমা করা যেতে পারে এমন একটি শর্তও দেওয়া হলো। শর্তটি হলো- প্রচলিত রক্ষণশীল ধর্মের প্রতি অনুগত্য এবং প্রকাশ্যে দেবদেবীর প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন। সক্রেটিস কোন মতে শর্ত পালনে রাজী ছিলেন না। বন্ধু-বান্ধবও আত্মীয়-পরিজনের অনুরোধ সত্বেও ক্ষমা চাইলেন না। সক্রেটিসের বন্ধু-বান্ধবেরা তাকে পালিয়ে অন্য রাষ্ট্রে চলে যেতে পরামর্শ দিলো কিন্তু তিনি বন্ধু-বান্ধবদের বললেন, আমি বিষপান করে মৃত্যুবরণ করবো যেন আমার আদর্শের অগ্নিতে এদের বিবেককে সর্বদা পিরিত করে। আর পোকামাকড়েরা আমার অস্থি মাংস যেন প্রাণ ভরে ভোজন করে তৃপ্তি পায়।

দ্য ডেথ অফ সক্রেটিস, ১৭৮৭ খ্রিস্টাব্দে জ্যাক লুই ডেভিড কর্তৃক অঙ্কিত চিত্র
All you need in this life is ignorance and
Confidence; then success in sure.
– Mark Twain.
লেখকঃ ডেনিস দিলীপ দত্ত