আজ থেকে ১৭০০ বছর আগে কেমন ছিলো মানুষের জীবন? অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমরা রাজা-রানি বা সম্ভ্রান্ত শ্রেণির কাহিনী শুনে থাকি আর সেসব জমকালো উৎসবমুখর জীবনের গল্প শুনতেই বোধ হয় বেশি ভালোবাসি। কিন্তু মুদ্রার উল্টো পিঠের প্রাচীন বিশ্বে সাধারণ মানুষের জীবন কেমন ছিলো? কেমন ছিলো মধ্য এশিয়ার প্রাচীন সগডিয়ান সভ্যতার জীবন? জানার কোনো উপায় আছে কি?
১৯০৭ সালের কথা। চীনের এক গুহার পাশ দিয়ে যাচ্ছে এক রোমাঞ্চপ্রিয় খননকারী। হঠাৎই এক গুহায় একটি অতি পুরাতন বস্তা খুঁজে পায় সে। মনে করে নিশ্চয়ই হীরা-মানিক থাকতে পারে। কৌতূহল ঠেকাতে না পেরে সাবধানে খুললো সেটা। যা দেখলো তার জন্য অবশ্য প্রস্তুত ছিলো না। বস্তা ভরা কোনো দুর্বোধ্য ভাষায় লেখা বেশ কিছু কাগজ। হয়তো এটা কাজের কিছু বা গুপ্ত ধনের নকশাও লেখা থাকতে পারে। তাই সঙ্গে করে নিয়ে এলো সে। এবার কাগজগুলো উপযুক্ত জায়গায় পৌঁছালো। প্রত্নতাত্ত্বিকগণ গবেষণা করে দেখলেন, আসলেই “যে-সে কাগজ” নয় এগুলো। আজ থেকে প্রায় ১৭০০ বছর আগের ৩১৩ খ্রিষ্টাব্দে সগডিয়ান ভাষায় লেখা সেগুলো। বেশির ভাগই সাধারণ মানুষের কাহিনী- কষ্ট আর দুঃখ গাথা। চলুন শুনে আসি সেসময়কার বেদনাময় কাব্য।
“প্রিয় উন্নত চরিত্রের অধিকারী, মহান স্বামী, নানাই-ধাত,
আপনার উপর আশীর্বাদ বর্ষিত হোক এবং আমার নতজানু অভিবাদন নেবেন, ঠিক যেমন মর্যাদা ঈশ্বরদের দেওয়া হয়। যে ব্যক্তি আপনাকে সবার সাথে সুস্থ, সবল, জরামুক্ত দেখবে তার জন্য দিনটি অবশ্যই সৌভাগ্য বয়ে আনবে। চিঠির উত্তরে আপনার সুস্থতার খবর পেলে নিজেকে অমর মনে করবো, জনাব।”
স্বামী হিসেবে ঈশ্বরের সাথে তুলনা করে প্রশংসা বাড়াবাড়ি মনে হতে পারে। তবে প্রশংসা করা ছিলো সগডিয়ানদের সংস্কৃতির অংশ। আসলে এত প্রশংসা করার পরও দীর্ঘ ৩ বছর ধরে স্বামীর কাছ থেকে কোনো উত্তর পায়নি মিউনে। মিউনে চীনের গানসু প্রদেশের একজন বিবাহিত নারী। তার স্বামী অন্য প্রদেশে গিয়ে ৩ বছর কেটে গেলেও ফিরে আসছেন না। এদিকে মিউনে তার একমাত্র ছোট্ট মেয়ে শায়ন কে নিয়ে খাদ্য বস্ত্রের অভাবে বড়ই বিপাকে পড়েছে। সম্পদশালী প্রতিবেশী জমিদারের কাছে সাহায্য চাইলেও কিছুই পায় না সে। খাদ্য ,বস্ত্র এবং অর্থের চরম সংকটে মানবেতর পরিস্থিতির শিকার হয় তারা। মিউনে তার প্রথম চিঠিতে মাকে লিখেছে যে মাকে দেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে আছে সে। এই অবস্থার কথা জানিয়ে লিখেছে কারো কাছে ঋণ চেয়েও সে কোনো ঋণ পায়নি। সেসময়কার চীনা সমাজে নারীদের অধিকার ও মর্যাদা ছিলো খুবই কম।
মিউনে মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। তার বাপের বাড়ি সগডিয়া- যা পারস্য সাম্রাজ্যের মধ্যে ছিলো। এখন সে চীনের গানসু প্রদেশের ডানহুয়াং শহরে থাকে। সগডিয়ান নানাই-ধাত নামে একজন ব্যবসায়ী মিউনেকে বিয়ে করে সংসার পেতেছিলো সুবিখ্যাত সিল্ক রোডের চীনা অংশের পাশেই। তার সম্পদশালী হওয়ার জন্য অনেক সুযোগ ছিলো যেহেতু সগডিয়ানরা ব্যবসা রমরমা করতে পটু।
নানাই-ধাত চিঠির কোনো উত্তর দিচ্ছে না। এদিকে খাদ্য-বস্ত্র-অর্থ-নিরাপত্তা-মর্যাদাহীন, ঋণের দায়ে জর্জরিত মিউনে সিদ্ধান্ত নিলো মায়ের বাড়ি সগডিয়ায় ফিরে যাওয়ার। কিন্তু আইন অনুযায়ী মিউনে স্বামীর অনুমতি ছাড়া শহরের বাইরে যেতে পারবে না। তবে স্বামীর অনুমতি না পেলেও নিকটাত্মীয় কারোর অনুমতিতে শহরের বাইরে যেতে পারবে। তার একমাত্র নিকটাত্মীয় ছিলো আরটিভান। সে-ও তাকে অনুমতি দিতে নারাজ হলো। অন্য সবাই মিউনে কে একই কথা বলতে লাগল- “অপেক্ষা করো। হয়তো নানাই-ধাত ফিরে আসতে পারে। তখন আবার তোমার সৌভাগ্য ফিরে আসবে।”
দিন যায়, বছর যায়। কিন্ত সে আর আসে না। অন্য দরিদ্র নারীদের মতো মিউনেরও দাস হিসেবে বিক্রি হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বাড়তে থাকে। নিজের মেয়ের, বউয়ের ও সংসারের প্রতি উদাসীনতা ও বৈরাগ্য না থাকলে নানাই-ধাত অবশ্যই ডানহুয়াং-এ ফিরে আসতো। কিন্তু এত চিঠি পাঠানো, এত প্রশংসার পরও কোনো উত্তর না পেয়ে মিউনে এবার আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে। পরের চিঠিতে লেখে, “….আমি এর চেয়ে কোনো কুকুর বা শুকরের বউ হলে ভালো হতো!” মিউনের স্বামীর পরিবার তাকে স্বামীর কাছে যেতে মানা করে। নানাই-ধাত বহুদিন তাকে লেখেনি। সম্ভবত নিজ স্ত্রীকে পরিত্যাগ করেছে সে। বছর তিনেক আগে সর্বশেষ চিঠিতে সে মিউনেকে বলেছিলো, চীনাদের কীভাবে মান্য করে চলবে। মিউনের সবচেয়ে বড় ভয় ছিলো নানাই-ধাত না আসলে মেয়েসহ সে চীনাদের ক্রীতদাসে পরিণত হবে। কেননা, তার মতো স্বামীহারা অনেকেই যৌনদাসীতে পরিণত হয়েছে। তখন গরিব মহিলাদের এভাবেই সম্পদশালীদের কাছে বিক্রি করা হতো। তখনকার উদ্ধার করা একটি প্রাচীন দাস চুক্তিপত্রে (চীনের জিনজিয়ান প্রদেশ, ট্যাং বংশের শাসনামল) সগডিয়ান ভাষায় লেখা আছে যে ১৫ বছর বয়সী একজন দাসকে ৬ গাঁট খাঁটি সিল্ক ও পাঁচটি চীনা মুদ্রা দিয়ে কিনে নেওয়া হচ্ছে। যাদেরকে বেঁধে নির্যাতন থেকে শুরু করে সবকিছু করা বৈধ ছিলো। শেষ পর্যন্ত মিউনের আশঙ্কাই যেন সত্যি হলো। মিউনের মেয়ে শায়ন মায়ের লেখা চিঠির সাথেই বাবাকে আরেকটি চিঠিতে লিখেছে যে: “আমরা চীনাদের দাসে পরিণত হয়েছি। আমি ও আমার মা।”
এদিকে ফার্নখুন্ড নামে পারিবারিক এক বন্ধু চীনাদের কাছ থেকে মুদ্রা ধার করে মিউনে আর শায়ন এর নামে ঝুলিয়ে দেয়, এতে তারা অতিরিক্ত ঋণের দায়েও আটকে যায়। পরিবারের কর্তা লাপাত্তা হয়ে যাওয়ায় আয়, উপার্জন, সম্পত্তি- সব হারিয়ে, ৪র্থ শতকে গানসুতে বসবাসরত একজন অসহায় মহিলার এসব ব্যাপারে অভিযোগ করাও নিষেধ ছিল।
কেউ জানে না তাদের ভাগ্যে কী হয়েছিলো। এই দুটো চিঠিই ছিলো মিউনের ব্যাপারে শেষ সূত্র। তবে একটা ব্যাপার তো নিশ্চিত যে, মিউনের চিঠিগুলো কখনোই কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছায়নি। একজন চীনা দারোগা সেটা আটকিয়ে লক করে ডানহুয়াং শহরের সম্মুখ প্রাচীরে লুকিয়ে রাখে। যা হাজার হাজার বছর পরে ১৯০৭ সালে অরেল স্টেইন নামক একজন প্রত্নতাত্ত্বিক খুঁজে পান। মিউনের মা কখনোই মেয়ের সাহায্যের আকুতি শুনতে পাননি, না পেয়েছে তার স্বামী মেয়ের লেখা চিঠিটি। সেই দুঃসময়ে তাদের ভাগ্যে যেকোনো কিছুই ঘটে থাকতে পারে।
কিন্তু তারপরও আশা থাকে। মিউনে তার এক চিঠিতে মাকে লিখেছিলো তারা স্থানীয় একজন পাদ্রীর দেয়া কিছু সাহায্যের উপর নির্ভর করে বেঁচে আছে। পাদ্রী মিউনেকে বলেছে, “তুমি যদি মায়ের কাছে যেতে চাও, তাহলে তোমাকে একটি উট ও একজন সহচর পাঠাবো এবং পথে আমি তোমার খরচের দায়িত্ব নিবো।” হয়তো সেই দয়ালু পবিত্র মানুষটির দেয়া সহায়তায় মিউনে ও তার মেয়ে নিজেদের শতছিন্ন, নোংরা কাপড় বদলাতে পেরেছিলো, ক্ষুধা মেটাতে খাবার পেয়েছিলো, হয়তো সে ডানহুয়াং থেকে বের হয়ে মায়ের কাছে যেতে পেরেছিলো। হয়তো তার শেষ জীবন সুন্দর হয়েছিলো কিংবা হয়তো হয়নি!
যাই ঘটে থাকুক না কেন, মিউনে তার না বলা করুণ জীবনকাহিনী আমাদের কাছে পর্যন্ত পৌঁছাতে পেরেছে। তার অজান্তেই এই বঞ্চনার ইতিহাস জানাতে পেরেছে হাজার হাজার বছর পরেও; যদিও সে এটা আশা করেনি তবুও এই একবিংশ শতাব্দীতে বসে আমরা চতুর্থ শতকের সগডিয়ান নারী মিউনের কথা শুনছি। এভাবেই চীনা আধিপত্যের মুখে আরও কত শত সাধারণ মানুষ তাদের সঙ্গীকে হারিয়েছে, তার হিসাব অজানা। হয়তো আরও অনেক বছর অপেক্ষা করতে হবে সেসব তথ্য প্রমাণ আবিষ্কার হওয়ার জন্য। মিউনের দৈহিক মৃত্যু হয়েছে আর সবার মতোই। কিন্তু তার জীবনের গল্পগুলো বেঁচে আছে। তার চিঠিগুলো হয়তো গন্তব্যে যায়নি কিন্তু আমাদের কাছে তা অমর হয়ে থাকবে।