মুঘল সালতানাতের গৌরবময় ইতিহাসের অন্যতম দীপ্তিমান একটি নাম হল সম্রাট আওরঙ্গজেব। সম্রাট শাহজাহানের চার পুত্রের মধ্যে আওরঙ্গজেব ছিলেন সবচেয়ে চতুর, সমরকুশল ও কূটনৈতিক জ্ঞানসম্পন্ন। মুঘল সম্রাট হিসেবে আওরঙ্গজেবের শাসনামল বিভিন্ন যুদ্ধের মাধ্যমে সাম্রাজ্যের সীমানা বহুদূর বিস্তার করেন। এজন্য সম্রাট আওরঙ্গজেবকে মুঘল সালতানাতের ইতিহাসে শেষ সফল সম্রাটও বলা হয়। তবে আজ আমরা সম্রাট আওরঙ্গজেবের শাষনামল সম্পর্কে আলোচনা করবো না। আজ আমরা জানবো কিভাবে সম্রাট আওরঙ্গজেব উত্তরাধিকার যুদ্ধে নিজেকে তূলনামুলক যোগ্যতর হিসেবে উপস্থাপন করেন এবং সম্রাট পদবীটি অর্জন করেন। চলুন তবে জেনে আসা যাক এমন এক ইতিহাস , যেখানে উত্থান হয় এমন এক সম্রাটের যিনি নিজেকে শুধু বংশসূত্রে নয় , কর্মসুত্রেও সম্রাট হিসেবে প্রমান করেছেন।
সম্রাট শাহজাহান যখন দাক্ষিণাত্যের শাসক ছিলেন, সে সময় আহমদাবাদ ও মালব সীমান্তের ধুদে নামক স্থানে ভূমিষ্ঠ হয় তার তৃতীয় পুত্র আওরঙ্গজেব। দিনটি ছিল ১৬১৮ সালের ৩ নভেম্বর। নবজাতকের নাম রাখা হয় আবু মুজাফফর মুহিউদ্দিন মুহাম্মদ আওরঙ্গজেব। আলমগীর নামেও পরিচিত ছিলেন তিনি। ‘আলমগীর’ নামের অর্থ ‘বিশ্ব বিজেতা’। সময়ের সাথে সাথে নিজের বিজেতা স্বভাবটিও ফুটে উঠতে থাকে তার মধ্যে।
মুঘল সাম্রাজ্যে এমন কোন পূর্বাধিকার ছিল না যে সম্রাটের মৃত্যু হলে তার জ্যেষ্ঠ্য পুত্র সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হবেন। সিংহাসনের হকদারদের মধ্যে যুদ্ধ, মৃত্যু এবং পিতাকে সিংহাসনচ্যূত করে ক্ষমতা দখল করা প্রভৃতি ঘটনার মধ্য দিয়ে মুঘল সাম্রাজ্যের ক্ষমতার পালা বদল ঘটত। এবং এটি মুঘলদের বংশ পরম্পরায় প্রবর্তিত হয়েছে, যেমনটা করেছিলেন সম্রাট শাহজাহান নিজেই এবং তার পূর্ববর্তি সম্রাটেরা। মূলত সামরিক শক্তির বলেই বিষয়টি নিষ্পত্তি হত। শাহজাহানের চার পুত্রই শাসক হিসাবে যোগ্য ছিলেন। কিন্তু মূলত ক্ষমতার দ্বন্দ্ব শুধুমাত্র দারাশিকো( বড় সন্তান) এবং আওরঙ্গজেবের মধ্যে সিমীত ছিল। কারণ ক্ষমতার আড়ালে থাকা অনেক রাজকর্মচারী এবং অন্যান্য প্রভাবশালীদের সমর্থন এই দুইজনের পেছনে বেশি ছিল। আদর্শগত দিক দিয়েও তাদের মধ্যে যথেষ্ট মতপার্থক্য ছিল। দারাশিকো ছিলেন সম্রাট আকবর এর মত ধর্মনিরপেক্ষ নীতিতে বিশ্বাসী। অপরদিকে আওরঙ্গজেব ছিলেন একজন কট্টর মুসলিম। কিন্তু এই দুই শাহাজাদার বিভক্তি শাহী প্রশাসনের হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদ তৈরী করতে না পারলেও, শাহী পরিবারের সদস্যরা দুই জনের সমর্থনে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, মুঘল শাহাজাদী জাহানারার কথা। তিনি ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে দারাশিকোর মতাদর্শে বিশ্বাসী হলেও তিনি আওরঙ্গজেবকেই সমর্থন করতেন। বলে রাখা ভালো, রাজ সিংহাসনের দাবিদার চার শাহজাদা দারা, সুজা, মুরাদ ও আওরঙ্গজেব সবাই ছিলেন সম্রাট শাহজাহানের প্রিয়তমা স্ত্রী মমতাজের গর্ভজাত সন্তান। এরা প্রত্যেকেই পরিশ্রমী ও কুশলী হিসেবে বড় হয়েছিলেন।
মূলত সংঘাতের সূচনা হয় ১৬৫৭ সালে “সম্রাট শাহজাহান মৃত্যুবরণ করেছেন”, এই গুজব রটনার মধ্য দিয়ে। কিন্তু আসলে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। এবং এসময় চার পুত্রের মধ্যে শুধু দারা এ সময় পিতার কাছে উপস্থিত ছিলেন। যেহেতু সম্রাট সর্বদা তার জ্যেষ্ঠ্য পুত্র দারাশিকোকে অধিক প্রাধান্য দিতেন। ফলে সবার বড় ও সম্রাটের প্রিয় পুত্র হিসেবে সিংহাসন তার হাতে চলে যেতে পারে এই আশঙ্কায় শঙ্কিত হয়ে ওঠেন বাকি ভাইয়েরা। এবং সেসময় তারা প্রত্যেকেই একে অপরের সাথে যুদ্ধ করার মতো যথেষ্ট সামর্থবান ছিলেন। চার ভাইদের মধ্যে সবার বড় দারা ছিলেন এলাহাবাদ ও লাহোরের শাসনকর্তা, দ্বিতীয় জন সুজা ছিলেন বাংলার শাসনকর্তা, আওরঙ্গজেব দাক্ষিণাত্যের এবং সবার ছোট মুরাদ গুজরাট ও মালওয়ার শাসনে নিযুক্ত ছিলেন।
গুজবের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে আওরঙ্গজেব সুজা ও মুরাদ দুই ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ করে স্থির করেন যে এই বিরোধের সময় তারা তিন ভাই একত্রে লড়াই করবেন। কিন্তু এর মধ্যেই সুজা ও মুরাদ দু’জনেই নিজ নিজ শাসন অঞ্চল থেকে নিজেদের মুঘল সম্রাট বলে ঘোষণা করেন এবং দু’জনেই বিশাল সৈন্যবহর নিয়ে আগ্রার দিকে অগ্রসর হতে থাকেন। কিন্তু স্থির বুদ্ধিসম্পন্য আওরঙ্গজেব পরিস্থিতি অবলকন করার উদ্দেশ্যে ধৈর্য ধারন করলেন। তিনি প্রকাশ্য কোনো ঘোষণা না দিয়ে প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে নর্মদা নদীর প্রতিটি ঘাটে পাহারা বসালেন এবং ছোট বোন রওশন আরা ও অন্যান্য দূত মারফত অন্দরমহলের সকল খবর রাখতে থাকলেন। প্রত্যেক ভাইয়ের প্রতি পদক্ষেপের খবর যাচাই করে নিজের পরবর্তী পদক্ষেপ ভাবতে থাকলেন আওরঙ্গজেব। এদিকে পুত্ররা স্বসৈন্যে রাজধানীর দিকে অগ্রসর হওয়ার খবর বৃদ্ধ শাহজাহানের নিকটও পৌঁছে গেল। তিনি সুজাকে প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে দারার পুত্র সুলায়মানকে সৈন্যবহর দিয়ে প্রেরণ করেন। সুলায়মানের সঙ্গী হন আম্বরের রাজা জয় সিং। এই মিলিত বাহিনীর সাথে বাহাদুরপুরের যুদ্ধে পরাজিত হন সুজা। জয় সিং তাকে বাংলার সীমানা পর্যন্ত তাড়িয়ে নিয়ে যান।
তখন আওরঙ্গজেব তার প্রথম পদক্ষেপ গ্রহণ করেন, তিনি তার সৈন্যবহর নিয়ে নর্মদা নদী পড়ি দিয়ে দিপালপুরে আসেন। সেখানে মুরাদ বাহিনীর সাথে তার সাক্ষাৎ হয়। এবং তখন তিনি এই যুদ্ধে তার প্রথম কুটনৈতিক চাল চালেন। আওরঙ্গজেব চুক্তি করেন মুরাদের সাথে। এবং সিদ্ধান্ত হয় দু’জন একজোট হয়ে দারা ও সুজার বিরুদ্ধে লড়বেন। জয়ী হলে উভয়ে সমানভাগে সাম্রাজ্য ভাগ করে নেবেন। এভাবে তিনি সাময়িকভাবে একজন প্রতিপক্ষ কমিয়ে নেন।
আওরঙ্গজেব ও মুরাদের যৌথ বাহিনী এগিয়ে চলে আগ্রার পথে। এ খবর দারার কাছে পৌছে যায় , তখন তিনিও যোধপুরের অধিপতি যশবন্ত সিং রাজপুত এবং কাশিম খানের নেতৃত্বে যৌথ বাহিনী পাঠান আওরঙ্গজেব ও মুরাদের যৌথ বাহিনী প্রতিহত করার জন্য। যখন দারার বাহিনী আক্রমন করতে আসলে আওরঙ্গজেব তাদেরকে সতর্ক করেন যে, তিনি তাদের অসুস্থ বাবাকে দেখতে যাচ্ছেন। কিন্তু দারার বাহিনী সেকথা আমলে না নিয়ে আক্রমন শুরু করে। ফলে বাধ্য হয়ে আড়ঙ্গজেব ও মুরাদ বাহিনীও আক্রমন করে। এই সংঘাত সংগঠিত হয় ১৬৫৮ সালে ধর্মাত নামক এক স্থানে। দারার বাহিনীর মধ্যে যথেষ্ট সমন্বয়হীনতা ছিল। ফলে আওরঙ্গজেবের দক্ষ রণকৌশল এবং সংখ্যাগরিষ্ঠতার সামনে পরাজিত হয় যশবন্ত সিং রাজপুত এবং কাশিম খানের বাহিনী। জানা যায়, সেসময় যুদ্ধ হতে পলাতক রাজপুত সেনাদের রাজ্য গ্রহণ করতো না, এমনকি তাদের স্ত্রীরাও ফিরিয়ে দিতো তাদেরকে। এই সুযোগ কাজে লাগায় আওরঙ্গজেব, তিনি অনেক রাজপুত সেনাদেরকে নিজের দলে টেনে নেন। যা বিপক্ষ বাহিনীকে আরো দুর্বল এবং আওরঙ্গজেব বাহিনীকে আরো বেশি দাপুটে করে তোলে।
আওরঙ্গজেব ও মুরাদ বাহিনী পুরো দাপটের সাথে এগিয়ে আসছিল। তখন দারা বুঝতে পারে যে, এখন আর সময় নেই। এখনই যদি তাদেরকে প্রতিহত না করা যায় তবে আর সিংহাসন রক্ষা করা যাবে না। তাই তিনি স্বয়ং বিশাল এক বাহিনী নিয়ে উপস্থিত হন সমুগড় নামক এক স্থানে (আগ্রা থেকে প্রায় আট মেইল পূর্বে) এবং অপেক্ষা করতে থাকেন। আওরঙ্গজেব ও মুরাদ বাহিনী সমুগড় পৌছালে ২৯ মে, ১৬৫৮ সালে এই যুদ্ধ্য সংঘটিত হয়। দারা সবকিছু নিয়ন্ত্রন করছিলেন হাতির পিঠে চেপে। দারার রাজপুত বাহিনীর আক্রমনের গতির কাছে প্রায় নাজেহাল হয়ে পড়ছিল আওরঙ্গজেব ও মুরাদ বাহিনী। আওরঙ্গজেব রাজপুতদের বীরত্বে অভিভূত হয়ে যান। শেষ পর্যন্ত তার হাতেই ক্ষান্ত হয় রাজপুত বাহিনী। এদিকে দারার বাহিনীর গোলাবারুদ শেষ হয়ে গেলে আওরঙ্গজেবের ইউরোপিয়ান গোলন্দাজ বাহিনী লাগাতার গোলা ছুড়ে দারা বাহিনীর অবস্থা বেসামাল করে দেয়। ফলে দারার দুই সেনাপতি রুস্তম এবং খলিলুল্লাহ খানের অবস্থা বেগতিক হয়ে পড়ে। রুস্তম খান ভূপতিত হন। তখন দারা তার ময়দানে নামার গুরুত্ব অনুভব করেন এবং ভুলবশত কোনো রকম এলান ছাড়াই হাতির পিঠ থেকে নেমে ঘোড়ায় সওয়ার হন। আর এখানেই তিনি সবথেকে বড় ভুল করেন। তার বাহিনী তাকে হাতির পিঠে না দেখতে পেয়ে ভেবে বসে তিনি হয়তো নিহত হয়েছেন। ফলে সবাই ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে এবং দারা বাহিনী পরাজিত হয়। দারা সহচর ও পরিবার পরিজন নিয়ে দিল্লী পালিয়ে যান।
দারাকে প্রতিহত করার পর দাপটের সাথে বিজয়ী আওরঙ্গজেব ও মুরাদ আগ্রায় প্রবেশ করেন। অভ্যর্থনার উদ্দেশ্যে সম্রাট শাহজাহান আওরঙ্গজেবকে দেখা করার আমন্ত্রণ করেন। কিন্তু আওরঙ্গজেব বুদ্ধিমান ছিলেন। তাই তিনি পিতার সাথে দেখা করা থেকে বিরত থাকলেন। তিনি বড় বোন জাহানারার সাহায্যে গোপন জায়গায় মিলিত হন। সম্রাট শাহজাহান আওরঙ্গজেবকে জানান, তার এই যুদ্ধে কোনো দায় নাই, বরং দারাই তাকে বাধ্য করেছিলো। এই ঘটনা শুনে আওরঙ্গজেব পিতার প্রতি অনুগত্য প্রদর্শন করেন। এবং সৌভাগ্যবশত ফেরার পথে তার বিশ্বস্ত অনুচরদের কাছ থেকে একটি চিঠি পান, যেখানে সম্রাট শাহজাহানের দারাকে গোপন সাহায্যের কথা উল্লেখ ছিল। বিধায় শেষ বয়সে দাপুটে সম্রাট শাহজাহানকে পুত্রের কাছে বন্দিত্ব বরণ করতে হয়। এবং সাথে কন্যা জাহানারাও তার সাথে স্বেচ্ছাবন্দীত্ব বরণ করেন। কিন্তু আওরঙ্গজেব কখনোই তার প্রতি দুর্ব্যবহার করেননি। ১৬৬৬ সালে শাহজাহান মারা যান। আগ্রার দায়িত্ব পুত্র মোহাম্মদের হাতে দিয়ে আওরঙ্গজেব দিল্লীর উদ্দেশ্যে রওনা দেন।
প্রথমিকভাবে আওরঙ্গজেব জয়ী হলেও সাম্রাজ্যের অর্ধেক ভাগিদার হিসেবে মুরাদ তখনও জীবিত। আওরঙ্গজেব যেমন এক্থা ভুলে যায়নি তেমনি মুরাদও তলে তলে আরও সৈন্য সংগ্রহ করতে থাকেন। তাই মুরাদকেও পথে থেকে সরানো দরকার আবশ্যক হয়ে পড়ে। তাই মথুরায় যাত্রা বিরতিকালে মুরাদকে নৈশভোজের জন্য শিবিরে আমন্ত্রণ জানায় আওরঙ্গজেব। মুরাদ তার এক সহচরের পরামর্শে নৈশোভোজে যোগ দেন। উল্লেখ্য, এই সহচরকে আগেই অর্থ দিয়ে বশীভূত করে নিয়েছিলেন আওরঙ্গজেব। ভোজে মুরাদকে প্রচুর মদ খাওয়ানো হয় এবং তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়লে একজন পরিচারিকা দিয়ে তাকে তাঁবুতে পাঠানো হয়। ক্লান্ত, মাতাল মুরাদ শীঘ্রই ঘুমিয়ে পড়লে তার কোষ থেকে তরবারি বের করে নেয় সেই পরিচারিকা। এবং খুব সহজেই বন্দী হয়ে যান মুরাদ। তাকে প্রথমে দিল্লীর দুর্গে বন্দী রাখা হয়, পরে গোয়ালিয়রের দুর্গে পাঠানো হয়। সেখানে কৌশলে গুজরাটের দিউয়ান আলী নকী নামক এক ব্যাক্তিকে হত্যার দায়ে কাজীর বিচারে তাকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়। ১৬৬১ সালের ৪ ডিসেম্বর মুরাদের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়।
মুরাদকে সরানোর পর আওরঙ্গজেব দিল্লির দিকে এগোতে শুরু করেন। কিন্তু ততদিনে দারা আওরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে লড়ার মতো সৈন্য জোগাড় করতে পারেনি তাই বাধ্য হয়ে দিল্লি ছেড়ে পালিয়ে যান। আওরঙ্গজেব তখন কোনো প্রতিপক্ষ ছাড়ায় নির্বিঘ্নে দিল্লি দখল করে নেন এবং ১৬৫৮ সালের ২১এ জুলাই নিজেকে সম্রাট হিসেবে ঘোষণা করেন। এখানেই তিনি থেমে যাননি। সফলভাবে রাজত্ব করার জন্য পূরোপুরি শত্রুমুক্ত হওয়া জরুরী। এজন্য তিনি লাহোর এবং এলাহাবাদের দিকে দুটি বাহিনী প্রেরণ করেন। একটি দারার পুত্র সুলায়মান এবং অন্যটি সুজাকে হত্যার দায়িত্ব পেয়েছিল।
দারা বিপদ বুঝে লাহোর ছেড়ে গুজরাটের দিকে পালালেন। আহমেদাবাদের শাসক তাকে সাদরে গ্রহণ করলেন। তার সহায়তায় দারা শেষ বারের মতো আওরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত যুদ্ধের প্রস্তুতি নেন। পূর্বের আজ্ঞাবহ মহারাজ যশবন্ত সিং এসময় তাকে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়ে আজমীরে আহবান জানান। কিন্তু যশবন্ত সিংও গোপনে বিজয়ী সম্রাট আওরঙ্গজেবের পক্ষে যোগ দিয়েছিলেন। আজমীরের নিকট দেওয়াইয়ের গিরিপথে আওরঙ্গজেবের সৈন্যের সাথে দারার তুমুল যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে পরাজিত হয়ে দারা পুনরায় আহমেদাবাদে ফিরে আসেন। কিন্তু এবার সেখানকার শাসনকর্তা তাকে শহরে ঢুকতে দেন না। বিজয়ের পতাকা কোনদিকে সমুচ্চ থাকবে, তা তিনিও বুঝে গিয়েছিলেন। নিরুপায় হয়ে দারা এবার আফগানিস্তানের পথে অগ্রসর হলেন। পথিমধ্যে দাদার নামক স্থানে মালিক জিওয়ান নামে এক বেলুচ সর্দারের কাছে তিনি আশ্রয় লাভ করেন। পূর্বে এই সর্দারকে একবার শাহজাহানের রোষানল থেকে রক্ষা করেছিলেন দারা। দারার স্ত্রী নাদিরা বেগমও তার সঙ্গী হয়ে এ পথে চলছিলেন। পথের ক্লান্তি, ধকল সহ্য করতে না পেরে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন ও দাদারেই মৃত্যুবরণ করেন। তার দেহ সমাধিস্থ করার জন্য লাহোর পাঠিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু কথায় আছে, দুর্ভাগ্য যখন কাওকে তাড়া করে তখন আর সহজে ছাড়ে না। বিশ্বস্ত মালিক জিওয়ান দারার সাথে বিস্বাসঘাতকতা করে বসেন। তাকে তুলে দেন আওরঙ্গজেবের সেনাদের হাতে। এবং দারা ও তার দ্বিতীয় পুত্র সিপহির শিকোহকে দিল্লীতে নিয়ে আসা হয়। দারাকে বিচারের সম্মুখীন করা হয়। দানিশমন্দ খান দারার প্রাণভিক্ষার আবেদন জানালেও শায়েস্তা খান ও আপন বোন রওশন আরা দারাকে নাস্তিক সাব্যস্ত করে তার মৃত্যুদন্ড প্রার্থনা করেন এবং আলেম-উলামাগণও মৃত্যুদন্ডের পক্ষে রায় দেন। তাই শেষ পর্যন্ত দুজনেরই মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়। অপরদিকে পাহাড়ওয়াল থেকে দারা পুত্র সুলায়মানকেও আটক করা হয় এবং গোয়ালিয়রের দুর্গে বন্দী রাখা হয়। পরবর্তীতে তাকেও বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয়। আওরঙ্গজেবের দীর্ঘ সম্রাট জীবনে সবথেকে বহুল আলোচিত দণ্ডাদেশ ছিল তার ভাই শাহজাদা দারাশিকো কে মৃত্যুদণ্ড প্রদান।
উত্তরাধিকার সংগ্রামে শাহজাদা সুজা ছিলেন আওরঙ্গজেবের সর্বশেষ প্রতিদ্বন্দ্বী। তিনি আগেই দারা পুত্র সুলায়মানের কাছে পরাজিত হন। পরে তাদের মধ্যে সন্ধি হয় এবং সুজাকে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার শাসনক্ষমতা দেয়া হয়। আওরঙ্গজেব দিল্লির ক্ষমতা পাওয়ার পর তিনিও আশ্বাস দিয়েছিলেন যে, তাকে তার পদে অধিষ্টিত রাখা হবে। কিন্তু সুজা তাকে বিশ্বাস করতে পারেনি। সুজা আওরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে এবং অনিবার্য ভাবে তার পরাজয় হয়। তিনি প্রথমে বাংলা এবং পরে আরাকানে পালিয়ে যান। পরে আরাকান রাজার সাথে সুজার সম্পর্কে তিক্ততার সৃষ্টি হয় এবং তাদের হাতেই নিহত হন।
এভাবেই ১৬৫৮ সালে বল,বুদ্ধি,সুযোগ ও কৌশলের সুচারু প্রয়োগ ও সময়ের সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে, নিজের বিচক্ষণতা ও দূরদর্শিতা কাজে লাগিয়ে মুঘল সালতানাতের অন্যতম সফল সম্রাট আওরঙ্গজেবের অভিষেক হয়। নিঃসন্দেহে সম্রাট আওরঙ্গজেবকে মুঘলদের মধ্য সবথেকে যোগ্য সম্রাট বললে কোনো অংশে ভূল হবে না। কারণ সবসময় প্রতিদ্বন্দ্বীতার মাধ্যমে মুঘলদের সম্রাট নির্ণয় হলেও আওরঙ্গজেবের সময়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা সবথেকে বেশি ছিল এবং প্রত্যেক প্রতিদ্বন্দ্বীই ছিলেন যথেষ্ট দক্ষ। এজন্য সম্রাট আওরঙ্গজেবের শাসন আমলে মুঘল সাম্রাজ্যের বৃহৎ উন্নতি সাধন হয়। এই সংগ্রাম নিঃসন্দেহে অনেক নিষ্ঠুরতা ও বর্বরতামূলক ঘটনার সাক্ষ্য বহন করে। কিন্তু বাস্তবতা এই যে, একজন সম্রাট হিসেবে অধিষ্টিত হওয়ার জন্যে আওরঙ্গজেবকে এতটুকু নিষ্ঠুর হতেই হত। এজন্যই হয়তো পণ্ডিত চানক্য বলেছিলেন,
“কোনো মানুষকেই পুরোপুরি ভাবে সরল হওয়া উচিৎ নয়, কারণ সরল সোজা গাছকে যেমন সবার আগে কাঁটা হয় তেমনি পুরোপুরি সরল মানুষ সবার আগে বিপদে পড়ে”।