প্রাচীন পৃথিবীতে রেশম বাণিজ্যকে কেন্দ্র করে এশিয়ার সাথে পশ্চিমা ইউরোপীয় অঞ্চলের অর্থনৈতিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। আরো স্পষ্ট করে বলতে গেলে চীনের সাথে ইউরোপীয়দের যোগাযোগ তৈরি হয়েছিল। রেশম প্রাচীনকালে থেকে এক মূল্যবান উপাদান হিসেবে পরিগনিত হত। বিলাসি কাপড় তৈরি ছাড়াও রেশম ব্যবহার হতো আরো অনেক কাজে। প্রাচীন চীন ছিল রেশমের আধার। রেশম উৎপাদন শুরুই হয়েছিল চীনে। কিংবদন্তি আছে, চৈনিক পুরাণের হলুদ সাম্রাজ্যের রাজার স্ত্রী শি লিং শি এই রেশম উৎপাদনের উদ্ভাবন করেন। তিনি পরিচিত ছিলেন রেশমগুটির মাতা’ হিসেবেও। কিন্তু রেশন উৎপাদনে ঠিক কবে শুরু হয়েছিল তার সুনির্দিষ্ট ইতিহাস যায় না। তবে ধারণা করা হয় ৫ হাজার খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে চীনে রেশম উৎপাদন শুরু হয়।
চীনে রেশম কারা ব্যবহার করতে পারবে তা নির্দিষ্ট করা ছিল। শুধুমাত্র রাজা ও তার পরিবারের সদস্যদের জন্য রেশমের পোশাক ব্যবহার নির্দিষ্ট করা ছিল। সময় গড়ানোর সাথে সাথে রাজকীয় কর্মকর্তাদের জন্যও রেশমের কাপড় পরার বৈধতা দেয় হয়। তা সত্ত্ব্বেও রেশম উৎপাদন ও পরিধান করা সাধারণ প্রজাদের জন্য নিষিদ্ধ ছিল। কেউ রেশম উৎপাদন কিংবা পরিধান করলে কঠোর শাস্তির মুখোমুখি হতে হতো। রেশম চাষ চীনের জাতীয় স্বার্থে সংবেদনশীল হিসেবে গণ্য করা হতো এবং এর চাষ পদ্ধতি যাতে অন্য কোন দেশ বা অঞ্চলে পাচার না হয় তার জন্য কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। কেউ এই পদ্ধতি পাচার করলে তার জন্য মৃত্যুদণ্ডের বিধানও রাখা হয়। এই রেশম ব্যবসাকে কেন্দ্র করেই চীনের অর্থনীতি একটি শক্ত ভিতের উপর দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। রেশম চাষ পদ্ধতি ছিল জটিল। আর এই উৎপাদন পদ্ধতি না জানার কারণে ইউরোপ মূল্যবান এই বাণিজ্যিক সুবিধাটি নিতে পারছিল না।
ফলে ভিনদেশী সাম্রাজ্যগুলো রেশম চাষ পদ্ধতি জানার জন্য মুখিয়ে ছিল। কোরিয়ায় চীনা অভিবাসীদের হাত ধরে রেশম চাষ শুরু হয় ২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। জাপান রেশম চাষ বিদ্যা শেখে ৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। দুটো দেশই নিজস্ব গোপন মিশনের মাধ্যমে এর উৎপাদন পদ্ধতির সাথে পরিচয় হয়। প্রথম শতাব্দীর দিকে রোমান সাম্রাজ্যে রেশম ব্যবসা ভালই চলছিল। কিন্তু পারস্যের সাসানীয় সাম্রাজ্য বিকশিত হতে শুরু করলে এবং পরবর্তীতে রোমান-পারসিয়ান যুদ্ধের ফলে রেশমের দাম বেড়ে যায়৷ কেননা প্রায়ই পারসিয়ানরা সিল্ক রুটের বাণিজ্যিক পথগুলো বন্ধ করে দিত। ফলে পূর্ব রোমান সাম্রাজ্য তথা বাইজান্টাইন সম্রাট প্রথম জাস্টিনিয়ন পারস্যের সোগদানিয়া (বর্তমান উজবেকিস্তান, কাজাখস্থান, কিরগিজস্তান, তাজিকিস্তান) অঞ্চলে একটি বিকল্প রুট তৈরির পরিকল্পনা করেন। কেননা এই অঞ্চলই ছিল তৎকালীন রেশম বাণিজ্যের এপিসেন্টার। কিন্তু সম্রাটের এই পরিকল্পনা ব্যর্থ হলে তিনি বিকল্প উপায় খুঁজতে থাকেন।
আর এরই ফলশ্রুতিতে রেশম উৎপাদন পদ্ধতি শেখার জন্য সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর ঘটনাটি ঘটে বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যে, ষষ্ঠ শতাব্দীর মধ্যভাগে। এসময় দুই নেস্টেরিয়ান খ্রিস্টান ভিক্ষু চীনে ভ্রমণ করেন এবং রেশম চাষ পদ্ধতির অভিজ্ঞতা লাভ করেন। দেশে ফিরে এসে এই দুই ভিক্ষু কনস্টান্টিনোপলে বাইজান্টাইন সম্রাট জাস্টিনিয়নের কাছে এ বিষয়ে বিশদ ব্যাখ্যা দেন। ততোদিন পর্যন্ত বাইজান্টাইন সাম্রাজ্য তথা ইউরোপে রেশম চাষে মনোপলি গড়ে উঠেনি। কারণ চীনের উৎপাদিত রেশম বিভিন্ন হাত হয়ে এত দূর এসে প্রচুর দাম বেড়ে যেত৷ ফলে ইউরোপে রেশমের দাম ছিল আকাশচুম্বী। কখনো স্বর্ণ থেকেও রেশম মূল্যবান হয়ে পড়ত। ফলে লোভনীয় এ ব্যবসায় নিজেদের দখল নিতে সম্রাট প্রথম জাস্টিনিয়ান এক অভিনব আইডিয়া নিয়ে আসেন। তিনি ৫৫২ সালে ঐ দুই ভিক্ষুকে আবার চীনে পাঠান এবং তাদের এই দায়িত্ব দেন যে, যে করেই হোক রেশমগুটির শূককীট বা ডিম চুরি করে নিয়ে আসতে হবে। দুই ভিক্ষু এবার মধ্য এশিয়ার বাণিজ্যিক সূত্র ধরে রেশমের শূককীট নিয়ে আসার জন্য নিজেদের অভিযান শুরু করে। কৃষ্ণ সাগরের পাশের উত্তরাঞ্চলীয় একটি রুট ধরে ট্রান্স ককেশাস ও কাস্পিয়ান সাগর জুড়ে দুই ভিক্ষু ভ্রমণ করে। যেহেতু পরিপক্ক রেশমগুটি খুব নমনীয় ছিল এবং পরিমিত তাপমাত্রায় রাখতে হতো সেজন্য সোগদোনিয়ায় তাদের পরিচিত লোক দ্বারা তারা শূককীট নিয়ে আসতে সমর্থ হয়। বাঁশের তৈরি একটি আঁকশিতে করে তারা শূককীট নিয়ে আসে। পুরো প্রক্রিয়া শেষ করতে তাদের দুই বছর সময় লাগে। তারপর বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যে চীন থেকে শেখা উৎপাদন পদ্ধতি ব্যবহার করে রেশম চাষ শুরু করা হয়৷ আর এভাবেই ইউরোপে এক নিজস্ব মনোপলি তৈরি করতে সমর্থ হোন বাইজান্টাইন সম্রাট জাস্টিনিয়ন। চতুর্দশ শতাব্দীতে রেশম বাণিজ্য ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। নতুন মনোপলি গড়ে উঠার ফলে পারসিয়ান ও চীনের রেশম মনোপলির পতন ঘটে। পরবর্তী ৬৫০ বছর ধরে বাইজান্টাইন সাম্রাজ্য এই রেশম বাণিজ্যের উপর ভর করে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধির শিখরে আরোহন করে।
চীনের ঐতিহাসিক মনোপলি ভেঙে দিলেও আধুনিক পৃথিবীতে এখনো রেশম উৎপাদনে সবার উপরে চীন। আন্তর্জাতিক সেরিকালচার কমিশনের ২০১৮ সালের এক রিপোর্টে দেখা যায়, ২০১৮ সালে চীন ২ লক্ষ ২০ হাজার মেট্রিক টন রেশম উৎপাদন করে ২০১৯ সালেও রেশম উৎপাদনে চীন শীর্ষ অবস্থানে ছিল। সেই প্রাচীন পৃথিবীতে রেশমকে গড়ে উঠা সিল্ক রুট আর নেই। তবে রেশমের আবেদনও কিন্তু ফুরিয়ে যায়নি। এখনো রেশমের কদর রয়েছে বিশ্বজুড়ে।
রেফারেন্সঃ