এপ্রিল, ১৯১৯
অমৃতসর, পাঞ্জাব, ব্রিটিশ ভারত

রাওলাট আইনের বিরুদ্ধে ভারতীয় জনতার বিক্ষোভ শিখ সম্প্রদায়ের নববর্ষের মোড়কে শান্তিপূর্ণভাবে এগিয়ে চলছে। হাজার হাজার ভারতীয় বিশেষ করে শিখ সম্প্রদায়ের মানুষজনের এই মিছিল নিয়ে শহরের সরু উদ্যান জালিয়ানওয়ালাবাগে অবস্থান নেয়। জড়ো হওয়া জনতার কন্ঠে তখন ঝরছে মুক্তির শ্লোগান। ভারতে ব্রিটিশদের নীতির সমালোচনার পাশাপাশি তারা শ্লোগান দিচ্ছিলেন স্থানীয় দুই নেতা সত্য পাল এবং সাইফুদ্দিন কিশ্লের মুক্তির দাবিতে। পাঞ্জাবি নববর্ষ পালন করতে আসা এই মানুষজনের ওপর খানিক পরেই চালানো হয় কুখ্যাত গণহত্যা, জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড। এই গণহত্যায় নেতৃত্ব দেন ব্রিগেডিয়ার  রেজিনাল্ড ডায়ার।

ক্ষোভ বেড়েছিল আগ থেকেই

ভারতের স্বাধীনতা এবং ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে প্রবল আন্দোলনে এক নতুন মোড় দিয়েছিল অমৃতসরের এই হত্যাকাণ্ড। ব্রিটিশ সরকারের সাথে বিশ্বাসের দেয়াল এই হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে অঘোষিতভাবে ধ্বংস করা হয়। এই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হওয়ার পেছনের ইতিহাস বড় সংগত এবং ক্রমানুসারে অবশ্যম্ভাবী এক বিপ্লবের উদাহরণ হিসেবেই ছিল। ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহের পর ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ ভারতে নিজেদের শাসন সম্পর্কে আরো সচেতন হয়৷ ধীরে ধীরে নিজেদের শাসন অক্ষুণ্ণ রাখতে তারা ভারতের জনগণের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলে। ১৮৮৫ সালে সর্বভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠার পর সরাসরি ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের সাথে ভারতের জনগণের যোগাযোগ স্থাপিত হয়। বিশ শতকের প্রথমভাগে ব্রিটিশ সরকার দমনমূলক আচরণ শুরু করে। এসময় ভারতের রাজনীতিতে মহাত্মা গান্ধীর উত্থান হয়। ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে ভারতের জনগণ এবং রাজনীতিকদের সমর্থন লাভের আশায় ব্রিটিশ সরকার উপনিবেশগুলোর স্বায়ত্তশাসনের প্রতিশ্রুতি দেয়। তাদের এই প্রতিশ্রুতিতে গান্ধী রাজি হোন এবং ভারতীয় যুবকরা ব্রিটিশদের পক্ষে বিশ্বযুদ্ধে যোগ দেয়। বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে ভারতের স্বায়ত্তশাসন সুদূরপরাহত হয় এবং যুদ্ধ করা যুবকরা বেকার হয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরতে থাকে৷ এই ঘটনার পর ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের সাথে সম্পর্ক শীতল হতে শুরু করে। এরপরই ব্রিটিশরা দমনমূলক আচরণ শুরু করতে থাকে। কুখ্যাত রাওলাট আইন পাশ করে সংবাদপত্রের টুঁটি চেপে ধরা হয়। বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে বিদ্রোহীদের বিনা বিচারে অন্তরীণ করা হয়, দমবন্ধ এক পরিবেশে মহাত্মা গান্ধীকেও গ্রেফতার করা হয়। যদিও আন্দোলনের প্রবল স্রোতে গান্ধীকেও মুক্তি দিতে বাধ্য হয় সরকার। এরপরও বিক্ষোভ চলমান থাকে। সরকারি দপ্তর বিক্ষোভকারীদের আক্রমণের শিকার হয়। ইউরোপীয় সাদা চামড়ার লোক দেখলেই বিদ্রোহীরা তাদের আক্রমণ করে বসে। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন পুরো দেশে দানা বাঁধতে শুরু করে।

জালিয়ানওয়ালাবাগ বাগানের প্রবেশমুখ যেখানে হত্যাকান্ড শুরু হয়

জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড

বিক্ষিপ্তভাবে জায়গায় জায়গায় ব্রিটিশ আইনবিরোধী আন্দোলন চলতে থাকে। ১৯১৯ সালের ১৩ ই এপ্রিল ছিল শিখ সম্প্রদায়ের ধর্মীয় উৎসব। পাঞ্জাবী নববর্ষ পালন করতে সেদিন অমৃতসর শহরে প্রায় ২০ হাজার ভারতীয় রাস্তায় মিছিল বের করে। এই যাত্রায় বেশিরভাগই ছিল শিখ সম্প্রদায়ের মানুষ। যদিও এই মিছিলটি নববর্ষের একটি অনুষ্ঠান ছিল কিন্তু শহরের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ঘটনাচক্র এবং ব্রিটিশদের দমন আইন এই মিছিলকেও একটি রাজনৈতিক রূপ প্রদান করেছিল। স্থানীয় দুই নেতা সত্য পাল এবং সাইফুদ্দিন কিশ্লের নির্বাসন দণ্ডের প্রতিবাদও জানাতে থাকে তারা। মিছিলটি এক পর্যায়ে শহরের বদ্ধ উদ্যান জালিয়ানওয়ালাবাগে প্রবেশ করে। তখনকার অবস্থাটা এমন ছিল যে, কোন জমায়েত দেখলেই ব্রিটিশ সরকার ভয়ে তটস্থ থাকত। তাদের মনে এই শংকা ছিল যে আবার হয়তো কোন বড়সড় বিক্ষোভ দেখা দিতে পারে৷ ব্রিটিশ কর্মকর্তাদের মনে ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের মত আরেকটি বিদ্রোহের ভয় ঢুকে যায়। তারা বুঝতে পেরেছিল ভারত তাদের হাত থেকে ফসকে যাচ্ছে। অনেক ব্রিটিশ কর্মকর্তারা বালিশের নিচে বন্দুক রেখে ঘুমাতেন। অবস্থা এতোই বেপরোয়া হয়ে উঠেছিল।  ফলে প্রশাসন আগের চেয়ে আক্রমণাত্মক হয়ে উঠে। জালিয়ানওয়ালাবাগের এই মিছিলটির উপর নজর রাখছিলেন ব্রিগেডিয়ার রেজিনাল্ড ডায়ার। তিনি এর আগে অমৃতসরে যেকোন ধরণের সমাবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। এই ঘোষণার ব্যাপারে কেউ জানত না।
ডায়ার ৫০ জনের মত সৈন্য নিয়ে জালিয়ানওয়ালাবাগে উপস্থিত হোন এবং সেখানে দেখতে পান কেউ একজন উঁচু বেদিতে দাঁড়িয়ে ভাষণ দিচ্ছে। তৎক্ষনাৎ এই বদ্ধ উদ্যানে জমায়েত থাকা জনতার ওপর ডায়ার তার সৈন্যদের গুলি করার নির্দেশ দেন।  সেদিনের এই অভিযান সম্পর্কে ডায়ার বলেন,

১৯১৯ সালের জালিয়ানওয়ালাবাগ। হত্যাকাণ্ডের ঘটনার এক মাস পরে তোলা

“সরু একটি গলির ভেতর দিয়ে আমি উদ্যানে ঢুকলাম। রাস্তা সরু হওয়ায় আমাকে আমার সাঁজোয়া গাড়ি রেখে আসতে হয়েছিল। পার্কে ঢুকে দেখলাম হাজার পাঁচেক মানুষ। একজন মানুষ একটি উঁচু বেদিতে দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে নেড়ে ভাষণ দিচ্ছে। আমি সাথে সাথে বুঝলাম মানুষের তুলনায় আমার সাথে সৈন্যদের সংখ্যা অনেক কম। আমি গুলির নির্দেশ দিলাম। দু’শ থেকে তিনশ লোক মারা যায়। এক হাজার ছশ পঞ্চাশ রাউন্ড গুলি চালানো হয়। সন্ধ্যে ছয়টার দিকে আমি সেনা সদর দপ্তরে ফিরে যাই।”

বদ্ধ উদ্যানে গুলির তোপে দিগ্বিদিক ছুটে চলতে থাকা নিরীহ জনতা। কেউ লাফিয়ে পড়ে কুয়োতে। জীবনরক্ষা হয়নি কারো। কেউ কেউ দেয়াল টপকাতে চাইলেও পারেনি। মারা পড়ে প্রায় হাজারখানেক ভারতীয়। হত্যাকাণ্ড শেষ হলে ব্রিটিশ সরকার শহরে কারফিউ জারি করে। ফলে অনেকেই নিজের প্রিয়জনের মৃতদেহও নিতে পারেননি। জালিয়ানওয়ালাবাগে সেদিন নিহতের প্রকৃত সংখ্যা নিয়ে অনেক মত আছে। অনেকে মনে করেন সংখ্যাটা ছিল ২০ হাজার। ঐ হত্যাকাণ্ড নিয়ে পরে ব্রিটিশ সরকার একটি তদন্ত করে। রিপোর্টে নিহতের সংখ্যা বলা হয় ৩৭৯। কিন্তু ভারতের করা তদন্তে এই সংখ্যা প্রায় এক হাজার।

শহীদ কুয়া, এই কূপ থেকে ১২০ টি মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে

হত্যাকাণ্ডের প্রতিক্রিয়া

কুখ্যাত এই হত্যাকাণ্ডের সংবাদ বিদ্যুতগতিতে পুরো দেশে ছড়িয়ে পড়ে। দিকে দিকে প্রতিবাদ আর নিন্দার ঝড় বয়ে যায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ত্যাগ করেন ব্রিটিশদের দেয়া নাইট উপাধি। মহাত্মা গান্ধী এতোকাল ধরে ব্রিটিশদের সাথে আপোষ মীমাংসার নীতিতে চললেও এই ঘটনার পর হয়ে যান পুরোদস্তুর ব্রিটিশ বিরোধী। তিনি সরাসরি ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু করেন। স্বাধীনতা আন্দোলনে  নতুন গতির সঞ্চার হয়। তবে গণহত্যার মূল হোতা ডায়ার এই কাজে আত্মপক্ষ সমর্থন করেন। তিনি দম্ভভরে বলেছিলেন, উচিত কাজটাই করেছেন তিনি। ব্রিটেনে জালিয়ানওয়ালাবাগ গণহত্যার এই মাস্টারমাইন্ড ব্যাপক সহানুভূতি পান। ব্রিটেনের জনগণ মনে করতো ডায়ার পরিস্থিতির শিকার। ১৯২০ সালে ডায়ারকে পদত্যাগ করানো হলেও ইংল্যান্ডে গিয়ে তিনি পান Saviour of punjab খেতাব। ২০ হাজার পাউন্ড তহবিল তুলে তাকে দামি পাথর খচিত তরবারি উপহার দেয়া হয়।  তবে শুনা যায় তিনি শেষজীবনে তার এই কাজের জন্য অনুতপ্ত হয়েছিলেন। ১৯২৭ সালে তার মৃত্যু হয়। জালিয়ানওয়ালাবাগ এর এই হত্যাকাণ্ড ভারতীয় জাতীয়তাবাদ আন্দোলনে প্রাণ সঞ্চার করেছিল যা পরবর্তীতে স্বাধীনতার মাধ্যমে পরিসমাপ্ত হয়। এই গণহত্যা বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পক্ষ থেকে ব্রিটিশদের পক্ষ থেকে দুঃখ প্রকাশের কথা উঠে। ১৯১৯ সালে ভারত সফর করা লন্ডনের মেয়র সাদিক খান বলেছিলেন ব্রিটেনের উচিত এই হত্যাকাণ্ডের জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে ক্ষমা চাওয়া। যা আজও আলোর মুখ দেখেনি।

তথ্যসূত্র

Explainer | What happened in the 1919 Jallianwala Bagh massacre of Sikhs in British-ruled India?