ভারতবর্ষের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও প্রাচীন স্থানগুলোর প্রকৃতি অনুসন্ধান এবং অধ্যয়নের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন একজন ব্রিটিশ প্রত্নতত্ত্ববিদ। তার নাম জন হুবার্ট মার্শাল। মাত্র ২৫ বছর বয়সে জন মার্শাল ভারতবর্ষের ‘আরকিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া’ বা এএসআই এর ডিরেক্টর জেনারেল পদে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছিলেন।
১৯০২ সাল। তখন ভারতবর্ষের ভাইসরয় ছিলেন লর্ড কার্জন। লর্ড কার্জনকে মোটামুটিভাবে আমরা সবাই-ই চিনি। বঙ্গভঙ্গের জন্য তিনি ছিলেন বেশ কুখ্যাত। তবে ভারতবর্ষের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের রক্ষণাবেক্ষণে তার সৎ প্রচেষ্টার কোনো কমতি ছিলো না, বরং সে সময় মূল্যবান প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন ও পুরাতত্ত্বগুলোর বেহাল দশা দেখে তিনি আতঙ্কিত হয়েছিলেন। এসব নিদর্শন সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা তিনিই প্রথম উপলব্ধি করেছিলেন।
১৮৭৬ সালে লন্ডনে জন মার্শালের জন্ম। ইতিপূর্বে তিনি গ্রীস, ক্রীট ও তুরস্কের খননে অংশ নিয়েছিলেন এবং অত্যন্ত অল্প বয়সেই বেশ নিবেদিত প্রত্নতাত্ত্বিক হিসেবে বিখ্যাত হয়েছিলেন। ১৯০২ সালে ভারতবর্ষে আসার ঠিক আগে তিনি ১৮৯৯ সাল থেকে ১৯০১ সালের মধ্যে ক্রীট দ্বীপের নসোস ও অন্যান্য শহরগুলোর খননে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। গ্রীক সংস্কৃতির প্রতি মার্শালের প্রবল আগ্রহ ছিলো তিনি যখন ইংল্যান্ডের ডালউইচ কলেজে অধ্যয়নরত ছিলেন, তখনই তিনি একজন অন্যতম গ্রীক বিশেষজ্ঞে পরিণত হয়েছিলেন। পরবর্তীতে গ্রীক শ্লোকের অনুবাদের কৃতিত্বস্বরূপ তিনি ক্যামব্রিজের কিংস কলেজে পোর্সন পুরস্কার লাভ করেছিলেন।
ভারতবর্ষের প্রাচীন ইতিহাস ও ঐতিহ্য সংরক্ষণের ব্যাপারে লর্ড কার্জন যতোটা তৎপর ছিলেন, ঠিক ততোটাই তৎপরতার সাথে কাজ করেছেন জন মার্শালও। অসাধারণ প্রতিভাসম্পন্ন জন মার্শাল ভারতবর্ষে একটি সুস্পষ্ট উদ্দেশ্য নিয়েই এসেছিলেন। আর তা হলো এর প্রাচীন নিদর্শনগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ এবং উপযুক্ত মূল্যায়ন।
ভারতবর্ষ তখন পাঁচটি প্রত্নতাত্ত্বিক অঞ্চলে বিভক্ত, যার প্রতিটিতে স্থানীয় সরকার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত একজন সার্ভেয়ার নিযুক্ত ছিলেন। এএসআই এর ডিরেক্টর জেনারেল বা মহাপরিচালক পদটি সাময়িকভাবে নিষ্ক্রিয় ছিলো। ১৯০০ সালের ২০ ডিসেম্বর লর্ড কার্জন এই পদটি পুনরায় সক্রিয় করার জন্য লন্ডনে ভারতবর্ষের সেক্রেটারি অফ স্টেটের কাছে একটি রিপোর্ট পেশ করেন। প্রস্তাবটি ১৯০১ সালের ২৯ নভেম্বর গৃহীত হয় এবং ব্রিটিশ মিউজিয়ামের সুপারিশ অনুসারে, মাত্র ২৫ বছর বয়সী জন মার্শালকে এই পদের জন্য নির্বাচিত করা হয়।
মহাপরিচালকের দায়িত্ব পাবার পরপরই জন মার্শাল ভারতীয় প্রত্নতত্ত্বকে পুনরুজ্জীবিত করবার প্রক্রিয়াটি শুরু করে দেন। ১৯০৪ সালে তারই প্রচেষ্টায় সরকার ‘ভারতীয় স্মৃতিস্তম্ভ সংরক্ষণ আইন’ পাস করে। ১৯০৬ সালের মধ্যে এএসআই সরকারের একটি স্থায়ী ও গুরুত্বপূর্ণ সংস্থার রূপ লাভ করে।
মার্শাল ১৯০২ থেকে ১৯২৮ সাল পর্যন্ত এএসআই এর প্রধান ছিলেন এবং এই ২৬ বছরে তিনি রাজগৃহ, সাহেত-মাহেত, ভিটা, তক্ষশীলা, মহেঞ্জোদারো, সারনাথ, সোহর ডাম্ব, চরসাদা এবং মান্দোরসহ ভারতবর্ষের বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য স্থান খনন করেছেন। তিনি ১৯১১-১২ সালে সাঁচি এবং তার সংলগ্ন বৌদ্ধ সাইটগুলোর কৌশলগত অধ্যায়ন ও সংরক্ষণের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি সাঁচির উপর ১৯১৮ সালে একটি বিস্তৃত রচনা প্রকাশ করেন, যার শিরোনাম ছিলো ‘এ গাইড টু সাঁচি’। ‘ফাদার অফ গান্ধারান আর্ট স্টাডিজ’ নামে পরিচিত একজন ফরাসি বৌদ্ধ পন্ডিত আলফ্রেড ফাউচারের সাথে ‘দ্য মনুমেন্টস অ্যাট সাঁচি’ শিরোনামে একটি তিন খণ্ডের ম্যাগনাম রচনাও প্রকাশ করেন তিনি। এ ছাড়াও তিনি বাগ গুহাগুলির উপর একটি বিস্তৃত রচনা প্রকাশ করেছিলেন, যা ভারতের প্রাচীনতম আঁকা বৌদ্ধ শিলা-কাটা গুহাগুলোর মধ্যে অন্যতম। বইটির নাম ‘বাগ কেভস ইন দ্য গোয়ালিয়র স্টেইট’।
গ্রীক খননে মার্শালের অভিজ্ঞতা ও অদম্য আগ্রহ তাকে উপমহাদেশের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রত্নতাত্ত্বিক খনন ‘তক্ষশীলা খনন’ এর প্রতি উদ্বুদ্ধ করেছিলো। ১৯১৩ সালে শুরু হওয়া এই খনন কাজটি প্রায় ২২ বছর স্থায়ী হয়েছিলো। ভারতীয় উপমহাদেশের আর কোথাও কোনো একটি স্থানে এতো বড় এলাকা খনন করা হয় নি। শহর পরিকল্পনা, নির্মাণ পদ্ধতি, কাঁচামাল, স্থানিক বন্টন, এবং মন্দির ও বাড়ির মধ্যে সম্পর্কের অন্তর্দৃষ্টি ছিলো তক্ষশীলা খনন কাজের রিপোর্টের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
এএসআই এর প্রতিষ্ঠাতা স্যার আলেকজান্ডার কানিংহামের আবিষ্কৃত একটি সীলমোহর প্রকাশিত হলে প্রথম বার আলোচনায় আসে হরপ্পা সভ্যতা। ১৯১২ সালে প্রত্নতত্ত্ববিদ জে ফ্লীট হরপ্পার এই সীলগুলোর একটি সংখ্যা প্রকাশ করলে তা মার্শালের নজর কাড়ে। ২০ শতকের হরপ্পা সভ্যতার আবিষ্কার ছিলো মার্শালের কর্মজীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্জন। ৫০০০ বছরের পুরনো ব্রোঞ্জ যুগের এই সভ্যতার কথা শুনে পুরো বিশ্ব অবাক বনে গিয়েছিলো।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় এএসআই এর কার্যক্রম মারাত্মকভাবে বাধাপ্রাপ্ত হলেও ১৯২৫-২৬ সালে আবারো সক্রিয় হয়ে ওঠে সংস্থাটি। মার্শাল ১৯২৮ সালে মহাপরিচালক পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন। কারণ তিনি বলেছিলেন যে, তার খননের ফলে উদ্ভূত তথ্যাবলি বিশ্লেষণ করা ও আবিষ্কারগুলো প্রকাশ করা অত্যন্ত জরুরি। মহেঞ্জোদারো, হরপ্পা, তক্ষশীলা, মুলতান, মান্ডু, দিল্লি, সাঁচি ও আগ্রার খনন প্রতিবেদন প্রস্তুত করার জন্য এএসআই এবং ভারত সরকার তাকে বিশেষ কর্মকর্তা হিসেবে পুনরায় নিয়োগ করেছিলো, যা পরবর্তীকালে মুদ্রণে প্রকাশিত হয়েছে। মহেঞ্জোদারো প্রতিবেদনটি তিনি ১৯৩১ সালে তিনটি বিশাল খণ্ডে প্রকাশ করেছিলেন, যার শিরোনাম ছিলো ‘মহেঞ্জোদারো অ্যান্ড দ্য ইন্ডাস সিভিলাইজেশন’।
জন হুবার্ট মার্শালকে ১৯৩০ সালে নোবেল পুরস্কার দেয়া হয় এবং অবশেষে ১৯৩৪ সালে তিনি ভারতবর্ষ ত্যাগ করেন। তার প্রস্থানের সাথে সাথে ভারতীয় প্রত্নতত্ত্বের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যুগের অবসান ঘটে। দুঃখজনকভাবে মার্শাল চলে যাওয়ার পরপরই এএসআই এর তীব্র পতন ঘটে।
মার্শাল অধিকাংশ প্রাচীন ভারতীয় স্থানের উদ্ভাবন, পরিচায়ন ও সংরক্ষণে ভূমিকা রেখেছেন। তিনি গৌতম বুদ্ধের জন্মভূমি লুম্বিনি ও বোধগয়া সম্পর্কিত উদ্ভাবন এবং প্রস্তুতির সাথেও বিশেষভাবে জড়িত ছিলেন। তার উদ্যোগে অধিকাংশ ভারতীয় প্রাচীন প্রাসাদ, বৌদ্ধ মন্দির, স্তূপ এবং অন্যান্য বহু ঐতিহাসিক স্থানের উদ্ভাবন এবং অনুসন্ধান সম্ভব হয়েছিলো। তিনি এএসআইকে দাঁড় করিয়েছিলেন, তাকে একটি মেরুদন্ড দিয়েছিলেন।
ভারতবর্ষের ইতিহাসকে তুলে ধরা অসম্ভব প্রতিভাধর এই বিদেশী ব্যক্তি ১৯৫৮ সালে মৃত্যুবরণ করেন।
রেফারেন্স: