ছেলেবেলায় আমরা প্রায় সবাই-ই দাদী বা নানীর কাছে বিভিন্ন গল্প ও কাহিনী শুনে বড় হয়েছি। অধিকাংশ গল্পগুলোতেই দুটি প্রতিযোগী জীবের ব্যাপারে উল্লেখ থাকতো, যাদের মাঝে একজন বিজয়ী হতো, আর অপর জন প্রতিযোগিতায় হেরে যেতো। বাঘ-সিংহের লড়াই, ইঁদুর-বিড়ালের লড়াই, খরগোশ-কচ্ছপের প্রতিযোগিতা, সাপ-বেজির লড়াই ইত্যাদি অসংখ্য কেচ্ছা-কাহিনীর জন্ম এমনি এমনিই হয় নি। আসলে এই জীবগুলো ব্যবহৃত হতো বিভিন্ন আদিম জাতিগোষ্ঠীর প্রতীকী রূপ হিসেবে। এসব আদি গোষ্ঠীরা ছিলো যুদ্ধবাজ জাতি। একের সাথে অপরের লড়াইয়ে বিজয়ী গোষ্ঠীই নিজেদের জয়ের প্রচারণা চালাবার উদ্দেশ্যে নির্দিষ্ট প্রতীক সম্বলিত এসব কেচ্ছা-কাহিনীর জন্ম দিতো। আর নির্দিষ্ট গোত্রের জন্য নির্দিষ্ট প্রতীক নির্ধারিত হতো যার যার ধর্মবিশ্বাস ও ভক্তি অনুযায়ী। এই বিশেষ প্রতীকের মাধ্যমে ব্যক্তি কিংবা জাতিকে সংজ্ঞায়িত করার প্রক্রিয়ার নাম টোটেমবাদ। আর নির্ধারিত প্রতীকটিকে বলা হয় টোটেম।

টোটেম কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, বংশ, জাতি, গোত্র কিংবা উপজাতির জন্য ব্যবহৃত হতে পারে। টোটেম যে কোনো জীবের প্রতিকৃতি হতে পারে। প্রাণী এবং গাছ-ফুল-ফল; যে কোনো কিছুই হতে পারে কোনো কুলের চিহ্ন। যেমন, শিনকারি গোত্রভুক্ত মানুষেরা ছিলো সিডার গাছের উপাসক, ভারতের তামিলনাডুর টোডা গোত্রের লোকেরা ছাগলকে টোটেম মানতো, হিন্দু ধর্মের কুর্মি গোত্ররা কচ্ছপকে টোটেম মানে, শিবভক্তরা শিবের বাহন বৃষকে মানে, ব্রহ্মাভক্তরা ব্রহ্মার বাহন হাঁসকে মানে –এমনিভাবে সমগ্র বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন জাতির মানুষ নিজেদের বৈশিষ্ট্য ও বিশ্বাসকে প্রতীকী রূপ দেবার উদ্দেশ্যে টোটেম ব্যবহার করে থাকে।

টোটেম ও টোটেম পোলের ধারণা

কানাডার অন্টারিও ওটাওয়াতে একটি টোট্যাম © Wikipedia

উত্তর আমেরিকা ও কানাডার আদিবাসী জনগোষ্ঠী ‘ওজিবুয়ে’ বা ‘আনিশিনাবে’ বা ‘চিপেউয়া’-দের ব্যবহৃত অ্যালগনকুইয়ান ভাষার ‘অটোটোমান’ শব্দটি থেকে ‘টোটেম’ শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে, যার অর্থ ‘ভাই-বোন সম্পর্ক’। টোটেমের ধারণা প্রতিষ্ঠিত হবার পর থেকেই এই আদিবাসী সমাজগুলোতে ভাই ও বোনের বিয়ে কিংবা যৌন সম্পর্ক স্থাপনের বিষয়টি নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

টোটেমের ধারণার উৎপত্তিস্থল, অর্থাৎ উত্তর আমেরিকা ও কানাডায় কিছু স্তম্ভ বা পিলার দেখতে পাওয়া যায়, যেগুলোকে পরিবার, সংস্কৃতি কিংবা ধর্মবিশ্বাসের ভিত্তিতে বিভিন্ন প্রতীকের রূপে শৈল্পিকভাবে গড়ে তোলা হয়। অনন্য ও শৈল্পিক এই স্তম্ভগুলোকে বলা হয় টোটেম পোল।

১৮ শতকের মাঝামাঝি সময়ে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক টোটেম পোল নির্মিত হয়েছে বলে জানা যায়। প্রথম দিকে কাঠের ওপর পাথর দিয়ে প্রতীকী চেহারাগুলো খোদাই করে রং-তুলিতে এঁকে তৈরী করা হতো এই স্তম্ভগুলো। তবে পরবর্তীতে পাথরের পরিবর্তে ধাতব যন্ত্রপাতির ব্যবহার শুরু হয়। সাধারণত হলুদ ও লাল সিডার গাছের কাঠই টোটেম পোল তৈরীর জন্য ব্যবহৃত হতো।

টোটেম পোল তৈরী ভীষণ সময়সাপেক্ষ, শ্রমসাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল একটি কাজ। টোটেম শিল্পীরা সাধারণত টোটেম নির্মাণের জন্য নির্দিষ্ট পরিবারের সঙ্গে একটি দীর্ঘ সময় সহাবস্থান করে থাকেন। ধর্মবিশ্বাস অনুযায়ী, বিভিন্ন ধরনের প্রাণী, যেমন পেঁচা, নেকড়ে, দাঁড়কাক, ঈগল, তীক্ষ্ণ দাঁতযুক্ত বীবর, ভাল্লুক, ব্যাঙ, তিমি এবং বজ্রপাত ও আলোর ঝলকানি প্রদানকারী কাল্পনিক পাখি ‘থান্ডারবার্ড’ এর প্রতিকৃতি খোদাই করে টোটেম পোল বানানো হয়ে থাকে।

টোটেম পোলে ছয়টি নির্দিষ্ট রঙের ব্যবহার দেখা যায় -সাদা, কালো, লাল, হলুদ, বেগুনী ও নীলাভ সবুজ। কারণ এই ছয়টি রং-ই কোনো না কোনো প্রাকৃতিক উৎস থেকে সহজেই পাওয়া যেতো। সাদা রং কাদামাটি, চুনাপাথর বা জিপসাম; কালো রং ক্যাম্পফায়ার থেকে মেলা গ্রাফাইট চূর্ণ; লাল রং ‘রেড ওকার’ নামের লাল কাদামাটি; হলুদ রং মহিষের পিত্তথলি; বেগুনী রং ব্লুবেরী, হাকলবেরী ও বিশেষ কিছু বেগুনী ফুল এবং নীলাভ সবুজ রং কপার থেকে পাওয়া যেতো।

টোটেম ও টোটেম পোলের ধারণা

স্যাক্সম্যান টোটেম পার্ক, কেচিকান, আলাস্কা

সাধারণত ছয় ধরনের টোটেম পোল দেখা যায়, যেগুলো ভিন্ন ভিন্ন উদ্দেশ্যে ভিন্ন ভিন্ন প্রতীকের ব্যবহারে বানানো হয়ে থাকে। বাড়ি-ঘরগুলোর মধ্যে ছাদ পর্যন্ত উঁচু যে বীমগুলো থাকে সেগুলোতেই বিভিন্ন প্রাণী, মানুষ কিংবা কাল্পনিক জীবের প্রতিকৃতি এঁকে তৈরী করা হয় ‘হাউজ পোল’। আর বাড়ির বাইরে নির্দিষ্ট পরিবার বা বংশকে বিশেষায়িত ভাবমূর্তি প্রদানের জন্য যে অভিজাত ধরনের টোটেম পোল ব্যবহার করা হয়, তাকে বলা হয় ‘হেরাল্ডিক পোল’ বা ‘ফ্যামিলি পোল’। বেশিরভাগ হেরাল্ডিক পোলগুলোতেই নির্দিষ্ট পরিবার অথবা বংশের কাহিনীগুলো চিত্রায়িত করা হয়। এই পোলগুলো প্রায় ২০ থেকে ৪০ ফুট পর্যন্ত উঁচু হয়ে থাকে।

মৃত মানুষের স্মরণে তৈরীকৃত পোলগুলোকে বলা হয় ‘মেমোরিয়াল পোল’। রাজপরিবারের ক্ষেত্রে এই পোলগুলোতে সাধারণত মৃত রাজার উত্তরসূরির চেহারা অঙ্কিত থাকে। আর মৃত ব্যক্তিকে আগুনে পোড়ানোর পর যে ছাই পাওয়া যায়, তা সংরক্ষণের জন্য ব্যবহৃত দরজাযুক্ত ফাঁপা টোটেম পোলকে বলা হয় ‘মরচুয়ারি পোল’। এই পোলগুলোর উচ্চতা সবচেয়ে বেশি, প্রায় ৫০ থেকে ৭০ ফুট।

প্রায় ৪০ ফুট বা তার থেকেও উঁচু যে সব টোটেম পোল কোনো দেশ বা অঞ্চলের প্রবেশমুখে কোনো হ্রদ, নদী কিংবা সমুদ্রের ধারে স্থাপন করা হয়, সেগুলোকে বলা হয় ‘ওয়েলকাম পোল’। এই পোলগুলো অতিথিকে স্বাগত জানানোর জন্য অথবা অচেনা আগন্তুককে সাবধান করার জন্য প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। আর কোনো মানুষকে তার কৃতকর্মের লজ্জা প্রদানের জন্য তার বাড়ির সামনে যে পোল স্থাপন করা হয়, তাকে বলা হয় ‘শেইম পোল’। এই ধরনের পোল সাধারণত ঋণ পরিশোধ না করতে পারা ব্যক্তির বাড়ির সামনে স্থাপন করা হয় এবং ঋণ পরিশোধ করা-মাত্রই নির্দিষ্ট পোলটিকে জনসমক্ষে ভূপাতিত করা হয়।

টোটেম ও টোটেম পোলের ধারণা

ব্রকটন পয়েন্ট, স্ট্যানলি পার্ক, ভ্যাঙ্কুভার, ব্রিটিশ কলাম্বিয়া

উত্তর আমেরিকার সংস্কৃতির এক চমৎকার নিদর্শন হলো টোটেম এবং টোটেম পোল। বৈচিত্র্য ও বৈশিষ্ট্যে পূর্ণ এই অপূর্ব সুন্দর স্তম্ভগুলো উত্তর আমেরিকানদের রুচি, মননশীলতা ও শিল্পবোধেরই পরিচয় বহন করে। নিঃসন্দেহে টোটেমের ধারণাটি একটি অনন্যসাধারণ ছাপ সৃষ্টি করে বিশ্ববাসীর মনে।

রেফারেন্স: