সময় তখন ১৩ শতক। পৃথিবীব্যাপী দাপিয়ে বেড়াচ্ছে সময়ের ত্রাস মোঙ্গল সেনাবাহিনী। পৃথিবীকে দখল করার প্রতিজ্ঞায় হত্যাযজ্ঞ আর নৃশংসতার কদর্য রূপ দেখিয়ে তারা পদানত করছে সাম্রাজ্যের পর সাম্রাজ্য। তাদের দৃষ্টি যায় এবার পারস্যে। উর্বর এই সভ্যতাকে বাগে আনতে কার না ইচ্ছা ছিল। স্বাভাবিকভাবেই মোঙ্গলরা নিজেদের অস্ত্র শাণ দেয়া শুরু করে, তারা আক্রমণ করবে সভ্যতার পীঠস্থান পারস্যে। বিপুল সেনাবাহিনী নিয়ে মোঙ্গলরা পা রাখল পারস্যের ইস্পাহান প্রদেশে। আরান বা বিদগোল বিভাগের কাশান শহরের একটু উত্তরে এসে মোঙ্গল বাহিনী হঠাৎ করে ভড়কে যায়। বিরান এক শহর নীরব হয়ে ঠায় পড়ে আছে, মানুষজনের দেখা নেই। চিনচিন শব্দ কানে যেন পাথরের মত বিঁধছে, বাতাসের শব্দও কানে আসছে। কিন্তু কোথায় এই শহরের মানুষ?
পাঠক, এই মানুষগুলোর হদিস জানতে হলে আমাদের চলে যেতে হবে আরো ১ হাজার বছর আগে সাসানীয় আমলে।
কোথায় ছিল পারসিয়ানরা?
শহর প্রতিরক্ষার জন্য ভূ-গর্ভস্থ সুড়ঙ্গের উপস্থিতি এই আধুনিক যুগেও দেখা মিলে। সম্ভাব্য রুশ আক্রমণ থেকে নিরাপত্তার জন্য ফিনল্যান্ড সুপরিকল্পিত অনেক টানেল নির্মাণ করেছে দেশজুড়ে। ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র সংগঠন হামাস ইসরায়েল আক্রমণ থেকে সুরক্ষার জন্য গাজা জুড়ে নির্মাণ করেছে অসংখ্য টানেল। এইসব টানেল কখনো খুব গোপনে নির্মাণ করা হয়। যার সাধারণ উদ্দেশ্যই থাকে প্রতিরক্ষা। তবে প্রাচীন ও মধ্যযুগে শুধুমাত্র টানেল না, নিজ রাষ্ট্রকে সুরক্ষার জন্য পুরোদস্তুর ভূ-গর্ভস্থ শহর নির্মাণ করার উদাহরণও আছে ইতিহাসে। তুরস্ক, স্পেন, মধ্যপ্রাচ্যে এমন অনেক প্রাচীন ভূগর্ভস্থ শহর রয়েছে। আমাদের গল্পের সেই পারসিয়ানরা এমনই এক ভূ-গর্ভস্থ শহরে নিজেদের লুকিয়ে রেখেছিল। শহরটির নাম নুশাবাদ।
যেভাবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল নুশাবাদ
নুশাবাদ এর বাংলা অর্থ করলে দাঁড়ায় শীতল সুস্বাদু পানির শহর। শহরটির নামকরণ হওয়ার পেছনে রয়েছে পানির ভূমিকা। এই ভূ-গর্ভস্থ শহরটি নির্মাণ করা হয়েছিল পারস্যের সাসানীয় রাজবংশের আমলে। পারস্যে ইসলাম আসার আগে এটিই ছিল সর্বশেষ নন-মুসলিম পারস্য সাম্রাজ্য যাকে নব্য-পারস্য সাম্রাজ্যও বলা হতো। সাম্রাজ্যটি ২২৪ সাল থেকে ৬৫১ সাল পর্যন্ত টিকে ছিল। একবার এক সাসানীয় সম্রাট এ পথ দিয়ে যাওয়ার সময় পানি পান করতে চান। স্থানীয় এক কূয়া থেকে তাকে পানি পান করতে দেয়া হয়। তিনি দেখলেন এই কূয়ার পানি অত্যন্ত স্বচ্ছ ও ঠান্ডা। সম্রাট অতঃপর এই কূয়ার চারপাশে একটি শহর বানানোর নির্দেশ দেন। তিনি শহরটির নাম রাখেন আনুশাবাদ যা পরবর্তীতে বিবর্তিত হয়ে পরিণত হয় নুশাবাদে। নুশাবাদের আরেক নাম ছিল অয়ুই। শহরটির অবস্থান ছিল মধ্য ইরানের মরুভূমি অঞ্চলে। ফলে এখানকার আবহাওয়া ছিল অত্যন্ত রুক্ষ ও উষ্ণ। দিন হলে তাপমাত্রা থাকত প্রচণ্ড অসহ্যকর এবং রাত হলে অত্যন্ত শীতল। তাই নুশাবাদ ভূ-গর্ভস্থ শহর প্রতিষ্ঠার কারণ হিসেবে এই মতও প্রচলিত যে দিনের বেলার অসহনীয় গরম থেকে বাঁচার জন্য এই শহরের মানুষ নুশাবাদে আশ্রয় নিতো। তবে নুশাবাদ গড়ে তুলা হয়েছিল মূলত প্রতিরক্ষার স্বার্থে। অঞ্চলটি ছিল সামরিক দিক থেকে খুব ঝুঁকিপূর্ণ। প্রায়ই এই অঞ্চলে এসে বহিরাগত দস্যুরা হানা দিয়ে লুটতরাজ করে যেতো। ফলে এইসব আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য গড়ে তুলা হয়েছিল মাটির নিচের এই নগর। সম্ভাব্য সামরিক আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য এই শহরটি ঢাল হয়ে ভূমিকা রেখেছিল পরবর্তী এক হাজার বছর। সাসানীয় সম্রাট আনুশিরভানের রাজত্বকালে নুশাবাদ রাজধানীরও মর্যাদা পেয়েছিল।
এক স্থাপত্যিক বিস্ময়
প্রায় ১৫ হাজার বছর আগের এই বিস্ময়কর শহর যেন অভিমানে অন্তরালে চলে গিয়েছিল। মানুষ জানতো না সেই প্রাচীন গল্পের কিছুই। যতক্ষণ না পর্যন্ত দৈবভাবে আবিষ্কার হয় প্রাচীন এই শহর। এক গৃহস্থ একটি কূয়া খনন করতে গেলে হঠাৎ করে খোঁজ মেলে নুশাবাদের। ২০০৬ সালের আগে তাই অন্ধকারেই রয়ে গিয়েছিল সাসানীয় এই বিস্ময়। পরবর্তীতে খননকার্যের মাধ্যমে উদঘাটিত হয় এই শহর নিয়ে নানা চমকপ্রদ তথ্য।
নুশাবাদ একটি তিন স্তর বিশিষ্ট শহর ছিল। স্থানে স্থানে এর গভীরতা ছিল ৪ থেকে ১৮ মিটার পর্যন্ত। শহরটি আনুভূমিক ও উলম্ব আকারে তৈরি করা হয়েছিল। নুশাবাদের প্রবেশপথ হিসেবে প্রায় সব নাগরিকের বাড়িতেই আলাদা গোপন পথ ছিল। এছাড়া শহরের গুরুত্বপূর্ণ স্থান যেমন দুর্গতেও এসব গোপন পথ তৈরি করা হয়েছিল। আক্রমণ বা কোন ঝুঁকি দেখা দিলে শহরের বাসিন্দারা গোপন পথ দিয়ে ভূ-গর্ভস্থ সেই শহরে ঢুকে পড়তো। প্রবেশপথ এমনভাবে তৈরি করা হয়েছিল যাতে একইসময় একাধিক ব্যক্তি প্রবেশ করতে না পারে। ফলে কোন সামরিক বাহিনী একসাথে প্রবেশ করতে পারতো না এই গোপন শহরে। মূল প্রবেশপথ ছাড়া বাকি প্রবেশপথের উচ্চতা ছিল ১৭০-১৮০ সেন্টিমিটার। নুশাবাদে প্রতি পরিবারের জন্য পৃথক কক্ষ ছিল, ছিল শৌচাগারও। বাতাস চলাচলের জন্য ছিল ভেন্টিলেশন ব্যবস্থা, ছিল হাঁস রাখার খোপ। এছাড়া ছিল ব্যক্তিগত জিনিসপত্র রাখার জন্য আলাদা স্টোরেজ স্পেস। ১ মিটার অন্তর দূরত্বে শোভা পেত বাতি।
উলম্ব আকারের টানেল শহরের স্তরগুলোর মধ্যে যাওয়া আসার পথ হিসেবে ব্যবহার করা হতো এবং ইউ আকৃতির টানেল ব্যবহার করা হতো ভেন্টিলেশনের জন্য। সুড়ঙ্গগুলোর সংযোগ করা হয়েছিল নাগরিকদের বাড়ির সাথে। এছাড়া শহরের দুর্গ, মসজিদ, গোসলখানার সাথেও এই সুড়ঙ্গগুলোর সংযোগ ছিল। শত্রুপক্ষকে এমবুশ করার জন্য আলাদাভাবে কক্ষগুলো ডিজাইন করা হয়েছিল। গর্ত তৈরি করে পাথর দিয়ে ঢেকে দেয়া হতো যাতে শত্রুপক্ষ ভুল করে ফাঁদে পড়ে। শহরটির মোট আয়তন ছিল ৪ কিলোমিটার। যা এখনো পর্যন্ত আবিষ্কার হওয়া ভূ-গর্ভস্থ শহরের মধ্যে সর্বোচ্চ আয়তন বিশিষ্ট। এই বিরল সব বৈশিষ্ট্য নুশাবাদকে স্থাপত্যিক এক মাস্টারপিসের সম্মাননা দিয়েছে। গোলকধাঁধার এই শহরটিতে এখনো খননকাজ অব্যাহত আছে। মাটির পাত্র ও পাথুরে ধ্বংসাবশেষ থেকে প্রাপ্ত গবেষণায় এটা প্রমাণিত হয়েছে যে নুশাবাদ ইলখানি, সাফাভী ও কাজার রাজবংশের সময় পর্যন্ত ব্যবহার হয়ে আসছিল। যা ধীরে ধীরে মাটির সাথে মিশে একাকার হয়ে যায়। ইরানের জাতীয় ঐতিহ্যের তালিকায় যুক্ত করা হয়েছে নুশাবাদকে। ঐতিহ্য ও প্রত্নতত্ত্বপ্রেমী কেউ শহরটি দেখতে চাইলে যেতে হবে কাশান শহরের ৫ কিলোমিটার উত্তরে।
সাসানীয় আমল পার হয়েছে হাজার বছর আগে, তারও পরে ইলখানী, সাফাভীদ আর কাজার রাজবংশ এই নগরকে আগলে রেখেছিল। পরবর্তী মানুষ ধরে রাখতে পারেনি তাদের সেই ঐতিহ্যকে। অতঃপর ভুতুড়ে শহরে পরিণত হয় নুশাবাদ। কে জানে হয়তো প্রাচীন সেই কক্ষগুলো থেকে মানুষের আর্তনাদ আর হুলস্থুলের শব্দ আজও কান পাতলে শুনা যাবে!