মদিনায় একটি ইসলামি সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে নবী মোহাম্মদ নতুন এই ধর্মকে আরবের বাইরে নিয়ে গিয়েছিলেন। দীর্ঘ সংগ্রামী জীবন শেষ করে ইসলাম ধর্ম ও ইসলামি সাম্রাজ্যকে একটি শক্ত ভিতের উপর প্রতিষ্ঠা করে গিয়েছিলেন তিনি। তার মৃত্যুর পর রাষ্ট্র শাসনে পবিত্র খিলাফতের উত্থান ঘটে। আবু বকর, ওমর, উসমান ও আলী ছিলেন এই খিলাফতের চার খলিফা যাদের শাসন ইতিহাসে পরিচিত রাশিদুন খিলাফত নামে। নানা ঝড় ঝঞ্জাট পেরিয়ে খলিফা ওমরের আমলে ইসলাম ও ইসলামি সাম্রাজ্য আবার শক্তিশালী হয়। তবে তৃতীয় খলিফা উসমানের খিলাফতের শেষদিকে এসে মুসলমানদের ভেতরে সম্পর্কে চিড় ধরে। বিদ্রোহ পাল্টা বিদ্রোহ আর অবিশ্বাসে ভরা এই সময়টুকু উসমান হত্যার মাধ্যমে শেষ হয়। পরবর্তী খলিফা আলী খিলাফতের রাজদণ্ড হাতে নিলে সিরিয়ায় গভর্নর মুয়াবিয়া তার আত্মীয় উসমানের হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবি করেন। মুয়াবিয়ার পক্ষ নেন নবী মোহাম্মদের স্ত্রী আয়েশা ও। কিন্তু আলী সাম্রাজ্যের অস্থিতিশীলতার কারণ দেখিয়ে এই বিচারকার্য সহসাই শুরু করতে চাননি৷ ফলে মুয়াবিয়ার সাথে তার সম্পর্কে চিড় ধরে। মঞ্চ তৈরি হয় ইসলামের প্রথম গৃহযুদ্ধের। ৬৫৬ সাল থেকে শুরু হওয়া এই উত্তেজনা শেষ হয় ৬৬১ সালে আলীর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে। এই সময়ে আবার উদ্ভব হয় শিয়া ও খারিজীদের মতো ধর্মীয় ও রাজনৈতিক সম্প্রদায়। টালমাটাল এই সময়টুকু ইসলামের ইতিহাসে পরিচিত প্রথম ফিতনা নামে। মুসলমান মুসলমান গৃহযুদ্ধের কলংকিত সেই সময়টুকু ভ্রমণ করা যাক।
প্রেক্ষাপট
রাশিদুন খিলাফতের প্রথমদিকে পার্শ্ববর্তী বাইজান্টাইন ও সাসানীয় সাম্রাজ্য, সিরিয়া, লেভান্ত, ইরাক, খোরাসান, মিশর ও ভূমধ্যসাগরীয় কয়েকটি দ্বীপ পর্যন্ত ইসলামের বিস্তার ঘটেছিল। এই বিস্তার হঠাৎ করে থমকে যায় খিলাফতের তৃতীয় খলিফা উসমানের শাসনের শেষদিকে। প্রথমদিকে তিনি একজন জনপ্রিয় খলিফা ছিলেন। কিন্তু বেশকিছু কারণে জনতা তার ওপর রুষ্ট হওয়া শুরু করে। তার বিরুদ্ধে স্বজনপ্রীতি অভিযোগ আনা হয়। ধর্ম অবমাননার মতো গুরুতর অভিযোগও তার বিরুদ্ধে আনা হয়। পরিস্থিতি আরো ঘোলাটে হয়ে পড়ে যখন মিশর বিজয়ী বীর ও সেখানকার গভর্নর আমর ইবনুল আসকে দুর্নীতির অভিযোগে তার পদ থেকে পদচ্যুত করা হয়। আমর হযরত আয়েশার কাছে সাহায্য চান। আয়েশা আমরকে নিজ পদে আবার পুনর্বহালের জন্য উসমানকে অনুরোধ করেন। কিন্তু উসমান সেই অনুরোধ প্রত্যাখান করেন। আমর এবার উসমানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহীদের উস্কে দেয়া শুরু করেন। স্বজনপ্রীতি, হযরত মোহাম্মদ (স.) এর আংটি হারানো, হজ্ব অনুষ্ঠানে দুই রাকাত বদলে চার রাকাত নামাজ আদায়ের প্রথা চালু, আবু জর গিফারীকে নির্বাসন ইত্যাদি বিবিধ অভিযোগ নিয়ে মিশরের বিদ্রোহী দল উসমানের বাড়ি ঘেরাও করে। উসমানের চাচাত ভাই সিরিয়ার গভর্নর মুয়াবিয়া উসমানকে নিরাপদে সিরিয়া নিয়ে আসার প্রস্তাব দিলে উসমান তা প্রত্যাখান করেন। এক পর্যায়ে ক্রোধোন্মত্ত বিদ্রোহীরা কোরআন পাঠরত খলিফাকে হত্যা করে। সূচনা হয় ভাতৃঘাতী যুদ্ধ, প্রথম ফিতনা।
আলীর খলিফা হওয়া
খলিফা উসমানের মৃত্যুতে মদিনায় ভয়ের পরিবেশ তৈরি হয়। এদিকে সিরিয়ার গভর্নর মুয়াবিয়া (মুয়াবিয়া ও উসমান উভয়েই ছিলেন উমাইয়া বংশীয় লোক; কুরাইশ বংশের দুইটি প্রভাবশালীর শাখার একটি হলো উমাইয়া, আরেকটি হাশেমী। আলী ছিলেন হাশেমী শাখার) তার চাচাতো ভাই উসমানের মৃত্যুতে ছিলেন বিপর্যস্ত। এমন সময়ে রাশিদুন খিলাফতের চতুর্থ খলিফা হিসেবে অভিষেক হয় হযরত আলীর। ক্ষমতায় এসে সাম্রাজ্যের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতাকে স্বাভাবিক করার উদ্যোগ নেন তিনি। মদিনা তখন হয়ে উঠেছিল বিদ্রোহীদের আস্তানা হিসেবে। হযরত আলী খিলাফতকে দুর্নীতিমুক্ত করতে উসমানের বসানো বেশকিছু দুর্নীতিবাজ প্রশাসককে পদত্যাগ করতে বাধ্য করেন। ফলে সাম্রাজ্যে তার শত্রু বৃদ্ধি পায়। আলীর ব্যস্ততার এই সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইলেন না মুয়াবিয়া। তিনি আলীর কাছে উসমান হত্যার বিচার দাবি করেন। অবস্থা আরো জটিল হয় যখন প্রসিদ্ধ দুই সাহাবী তালহা ও জুবায়ের যথাক্রমে কুফা ও বসরার গভর্নর পদের দাবি করেন। আলী তাদের এই দাবি নাকচ করে দিলে তারাও আলীর বিরুদ্ধে সরব হয়ে উঠেন। এদিকে হযরত আয়েশাও উসমান হত্যাকাণ্ডের বিচার চান আলীর কাছে। মনে করা হয় আলীর সাথে আয়েশার পূর্ব বিদ্বেষের জেরে তিনিও তালহা ও জুবায়েরের সাথে হাত মিলান। [বনি মুস্তালিকের যুদ্ধ শেষে ফেরার পথে আয়েশা একটু পেছনে পড়ে গেলে অনেকে তার নামে কুৎসা রটায়। এ ব্যাপারে নবী মোহাম্মদ আলীর কাছে পরামর্শ চাইলে আলী আয়েশার দাসীকে জিজ্ঞেস করার পরামর্শ দেন। পরবর্তীতে এই দাবি ভ্রান্ত প্রমাণিত হয়৷ কিন্তু আলীর উপর আয়েশার আক্রোশ থেকে যায়]
মুয়াবিয়া এদিকে দামেস্ক মসজিদে নিহত খলিফা উসমানের রক্তাক্ত জামা ও তার স্ত্রী নায়লার কাটা আংগুল দেখিয়ে সাধারণ জনগণকে উত্তেজিত করে তুলেন। ফলে একটা ভারী পরিবেশের তৈরি হয় পুরো খিলাফত জুড়ে। বিদ্রোহীরা আলীর বিরুদ্ধে জড়ো হতে থাকে। মঞ্চায়ন হতে থাকে সশস্ত্র গৃহযুদ্ধের।
উটের যুদ্ধ
তালহা ও জুবায়ের আলীর প্রতি আনুগত্য ত্যাগ করে মদিনা ত্যাগ করেন। তাদের সাথে যোগ দেন আয়েশাও। মক্কা, মদিনা ও ইরাক থেকে তারা প্রায় ৩ হাজার সৈন্য সংগ্রহ করেন ও ৬৫৬ সালের অক্টোবরের দিকে বসরা শহর নিজেদের দখলে নেন। ইতোমধ্যে আলী মুয়াবিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন কিন্তু বসরা দখলের সংবাদ পেয়ে তিনি ২০ হাজার সেনার একটি বাহিনী নিয়ে বসরা অভিমুখে রওনা দেন। নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ এড়াতে সামরিক বাহিনী ব্যবহার না করে সমঝোতার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের প্রস্তাব দেন খলিফা আলী। এ প্রস্তাবে আয়েশা, তালহা ও জুবায়ের রাজি হলেও ইবনে সাবা নামের এক লোকের অনুসারীরা ভীত হয়ে পড়ে। এই ইবনে সাবা উসমান হত্যার সাথে জড়িত ছিল। ইবনে সাবার সৈন্যরা রাতের অন্ধকারে আয়েশার বাহিনীর ওপর অতর্কিত আক্রমণ করলে যুদ্ধ আর আটকানো যায়নি। হযরত আয়েশা উটের পিঠে চড়ে এই যুদ্ধ পরিচালনা করেন। তালহা ও জুবায়েরের মৃত্যু ঘটে। শেষপর্যন্ত আয়েশাকে নিরাপদে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে বন্দি করে মদিনায় পাঠিয়ে দেয়া হয়৷ বিরোধী সৈন্য আলীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। বাকি জীবন আয়েশা মদিনায় শান্তিপূর্ণ জীবন কাটান। এই যুদ্ধ প্রথমবারের মতো ভ্রাতৃঘাতী সশস্ত্র যুদ্ধের পত্তন ঘটায়। প্রায় ১২ হাজার মুসলমান এই যুদ্ধে নিহত হয়।
সিফফিনের যুদ্ধ
খলিফ আলীর কঠোর দুর্নীতিবিরোধী মনোভাব উমাইয়া বংশীয়দের দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কেননা উসমানের সময় এই উমাইয়া বংশীয় লোকেরা ধনেমানে প্রভাবশালী হয়ে উঠেছিল। মুয়াবিয়াও এর ব্যতিক্রম ছিলেন না। ফলে আলীর সাথে তার বিরোধ বাঁধে। আলী তাকে সিরিয়ার গভর্নর পদ হতে পদত্যাগ করতে বললে তিনি তা প্রত্যাখান করেন। ফলে আরেকটি যুদ্ধ সংঘটিত না হওয়ার কোন কারণ আর অবশিষ্ট রইল না। ৫০ হাজার সৈন্যের বিশাল বাহিনী নিয়ে আলী দামেস্কের উদ্দেশ্যে রওনা হন। মুয়াবিয়া বিপরীতে ৬০ হাজার সৈন্যের শক্তিশালী বাহিনী নিয়ে ইউফ্রেতিস নদীর তীরে সিফফিন নামক জায়গায় আলীর বাহিনীর মুখোমুখি দাঁড়ান। ৬৫৭ সালের ২৬ জুলাই উভয়পক্ষ যুদ্ধে নামে। মুয়াবিয়ার বাহিনী আলীর কাছে নাস্তানাবুদ হতে থাকে। পরাজয় ঠেকানো সম্ভব না এই বাস্তবতা অনুধাবন করতে পেরে মুয়াবিয়ার সেনাপতি আমর ইবনুল আস কৌশলের আশ্রয় নেন। বর্শার মাথায় কোরআনের আয়াত গেঁথে সন্ধির আহ্বান জানানো হয়। আলী এই ছলচাতুরী বুঝতে পেরে যুদ্ধ চালু রাখার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। কিন্তু তার সাথে থাকা কোরআনে হাফেজরা যুদ্ধ বন্ধ করতে পীড়াপীড়ি আরোপ করলে আলী সন্ধি প্রস্তাবে সম্মত হন।
দুমাতুল জন্দলের সালিশ
অতঃপর উভয়পক্ষ সিরিয়া ও ইরাকের মধ্যখানে থাকা দুমাতুল জন্দল নামক স্থানে জড়ো হয়। হযরত আলীর পক্ষে মুসা আল আশারী ও মুয়াবিয়ার পক্ষে আমর ইবনুল আসকে নিয়োগ দেয়া হয়। এই দুই বিচারকের কাঁধে দেয়া হয় সালিশের ভার। ৬৫৯ সালের জানুয়ারিতে দুপক্ষের প্রায় ৮০০ প্রতিনিধি অংশ নেয়। আমর আবু মুসাকে বুঝাতে সক্ষম হন যে খিলাফতের স্বার্থে আলী ও মুয়াবিয়া দুজনকেই পদচ্যুত করতে হবে। মুসা এই প্রস্তাবে রাজি হয়ে আনুষ্ঠানিক সালিশের দিনে আলীর খিলাফত প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন কিন্তু আমর ইবনুল আস আলীর খিলাফতের দাবি প্রত্যাহারের ঘোষণা দিলেও মুয়াবিয়াকে খলিফা হিসেবে ঘোষণা করেন। ফলে বিবাদ জিইয়ে থেকে যায়। মুয়াবিয়াকে খলিফা হিসেবে ঘোষণা দিয়ে আলীর সমকক্ষ করা হয়। এই সালিশের প্রতিক্রিয়া হিসেবে দুইটি পৃথক দলের উদ্ভব হয়। একটি হলো শিয়া; যারা মনে করতো আলীই খিলাফতের একমাত্র বৈধ উত্তরাধিকার। আরেকটি হলো খারিজী; যারা বিশ্বাস করতো খলিফা নির্বাচনের অধিকার মানুষের নেই, এটি আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত। আব্দুল্লাহ বিন ওয়াহাবের নেতৃত্বে ১২ হাজার খারিজী পরবর্তীতে সাম্রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় অস্থিতিশীলতা শুরু করে। ৬৫৯ সালে নাহরাওয়ানের যুদ্ধে হযরত আলী খারিজীদের পরাজিত করেন। দুমাতুল জন্দলের সালিশ ও পরবর্তী অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে আলী অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়েন। ফলে বাধ্য হয়ে তিনি মুয়াবিয়ার সাথে একটি সন্ধি স্বাক্ষর করেন। সন্ধি অনুসারে সিরিয়া ও মিশর মুয়াবিয়ার অধীনে এবং আরব উপদ্বীপ ও পূর্বাঞ্চল আলীর অধীনে শাসিত হতে থাকে।
আলীর গুপ্তহত্যা ও প্রথম ফিতনার সমাপ্তি
নাহরাওয়ানের যুদ্ধে পরাজিত হয়ে প্রতিশোধ নেয়ার জন্য খারিজীদের একটি দল আলী, মুয়াবিয়া ও আমর ইবনুল আসকে হত্যা করার পরিকল্পনা করে। ৬৬১ সালের ২৯ জানুয়ারি ফজরের নামাজের সময় আমর ইবনে মুজমাল নামের এক খারিজী বিষাক্ত তরবারি দিয়ে আলীকে আঘাত করলে খলিফার মৃত্যু হয়। মুয়াবিয়া আহত হলেও বেঁচে যান। আমরও ভাগ্যক্রমে এই আক্রমণ থেকে রেহাই পান। আলীর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে মুয়াবিয়ার জন্য সুযোগের দরজা খুলে দেয়। খিলাফতে আসীন হয়ে তিনি বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্রের সূচনা করেন। সমাপ্তি ঘটে প্রথম ফিতনার। মুয়াবিয়াকে দিয়েই শুরু হয় উমাইয়া শাসন যা পরবর্তী প্রায় ৯০ বছর বলবৎ ছিল।