বেশ কিছুদিন ধরেই সম্রাট জাহাঙ্গীরের শরীরটা একদম ভালো যাচ্ছে না। লাহোর তার প্রিয় জায়গাগুলোর মধ্যে একটি। কিন্তু এখানেও মন টিকছে না কিছুতেই। প্রচন্ড গরমে অতিষ্ঠ সম্রাট ও তার পরিবার। ঠিক করলেন, জীবনে কিছুটা বৈচিত্র্য এবং স্বস্তি লাভের জন্য কাশ্মীর যাবেন। ভগ্ন স্বাস্থ্যের উন্নতি দরকার। জলবায়ু পরিবর্তনের মাধ্যমে হয়তো কিছুটা সুফল পেতে পারেন। কিন্তু না, কাশ্মীর গিয়েও তেমন একটা লাভ হলো না। ক্রমাগত অবনতি ঘটতে লাগলো সম্রাটের স্বাস্থ্যের। সিদ্ধান্ত নিলেন, আবারো ফিরে যাবেন লাহোরে।
কাশ্মীর থেকে লাহোরে ফেরত আসার পথে ঘটলো এক অপ্রত্যাশিত ও বেদনাদায়ক ঘটনা। মনকে প্রফুল্ল করবার জন্য সম্রাট ঠিক করলেন শিকার করবেন। তিনি বন্দুক তাক করলেন একটি হরিণের দিকে। ট্রিগারও ঠিকমতোই চাপলেন। মাটিতে পড়ে গেলো হরিণটি। হরিণটিকে তুলে আনতে ছুটে গেলেন জাহাঙ্গীরের একজন কর্মচারী। কিন্তু হঠাৎ পা পিছলে পাহাড় থেকে পড়ে মারা গেলেন সেই হতভাগ্য লোকটি। জাহাঙ্গীরের শরীর ও মনের উপর ভীষণ নেতিবাচক প্রভাব ফেললো ঘটনাটি। ভগ্ন মন ও ভগ্ন স্বাস্থ্য নিয়ে ১৬২৭ সালের ২৮ অক্টোবর মাত্র ৫৮ বছর বয়সে ২২ বছর রাজত্ব করবার পর পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে গেলেন সম্রাট।
সম্রাট জাহাঙ্গীরের এই সম্পূর্ণ দুঃসময়ে সারাক্ষণ পাশে ছিলেন একজন নারী, তার স্ত্রী নূরজাহান। ঐ সময়ের এক আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন সম্রাজ্ঞী নূরজাহান। ইতমাতুদ্দৌলার মেয়ে তিনি। মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে তার প্রথম বিয়ে হয় শের আফগানের সঙ্গে। বিশ বছর বয়সেই স্বামীর মৃত্যুতে বিধবা হয়ে যান মেহের-উন-নিসা নাম নিয়ে বড় হওয়া নূরজাহান। ১৬১১ সালে তার বিয়ে হয় মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের সাথে। সেই থেকে তিনি পরিচিত হন নূরমহল বা নূরজাহান নামে।
২০-তম স্ত্রী হয়েও সম্মান এবং যোগ্যতার সাথে স্বামীর পাশে থেকে তিনি সাহায্য করে গিয়েছেন সবসময়। তার স্নেহ ও আদর-যত্নে পরিতৃপ্ত সম্রাট তার প্রতি গভীর আস্থা রাখতেন। রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, প্রশাসনিক দক্ষতা এবং সমস্যা উপলব্ধি করবার যোগ্যতা তাকে সম্রাটের সঠিক পরামর্শদাত্রীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে সাহায্য করেছে। আর এ কারণে সম্রাটের উপর যথেষ্ট প্রভাবও তিনি খাটাতে পেরেছিলেন। জাহাঙ্গীর নিজেও ছিলেন তার উপর নির্ভরশীল। ‘জাহাঙ্গীরনামা’-তে বহু বার তিনি নূরজাহানকে সম্মানিত করেছেন। সেই সাথে ভালোবাসা ও স্ত্রীর প্রতি অনুরাগ সম্রাজ্যে তার প্রভাব বিস্তার করাকে সহজ করে দেয়।
কাশ্মীরে সম্রাট জাহাঙ্গীরের দুঃখজনক মৃত্যুর পর নূরজাহানের সম্মতিতেই সিদ্ধান্ত হলো, সম্রাটকে তার পূর্ব-ইচ্ছানুযায়ী লাহোরে সমাধিস্থ করা হবে। সম্রাটের কাছে লাহোর তো ছিলো স্বর্গের মতো সুন্দর। বহু বার তিনি লাহোরে থেকে রাজ্য পরিচালনা করেছেন। মুঘল শাসন আমলে লাহোর একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক কেন্দ্র ছিলো। ১৫৮৫ সালে সম্রাট আকবরের রাজত্বের সময় লাহোর ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। বাবা-ছেলে দুজন মিলেই লাহোরের শ্রীবৃদ্ধি ঘটিয়েছিলেন। জাহাঙ্গীরের প্রিয় সন্তান খুররামও তো জন্মেছিলেন এই লাহোরেই। সুতরাং তাকে সমাধিস্থ করবার জন্য লাহোরই সবচেয়ে উপযুক্ত জায়গা। তবে তিনি যেখানে মৃত্যুবরণ করেছেন, সেই স্থানটি থেকে লাহোর এর দূরত্ব অনেক বেশি। পৌঁছাতে বেশ কয়েক দিন সময় লাগবে। আর এতো দিন দাফন না করে মৃতদেহ রেখে দিলে শরীরে পচন ধরতে পারে। তাই বিচক্ষণ ও স্থিরবুদ্ধিসম্পন্ন সম্রাজ্ঞী নূরজাহান নিজের আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করলেন এবং স্বামীর মরদেহ সংরক্ষণের জন্য তার শরীর থেকে অন্ত্রগুলোকে বের করে ফেলার আদেশ দেন। এরপর সেগুলোকে চিঙ্গুস সারাই এর কাছে মুঘলদের বাঘসার কেল্লায় একটি কবর খুঁড়ে দাফন করা হলো। বলা হয়ে থাকে, এটিই সম্রাট জাহাঙ্গীরের প্রথম সমাধি। মুঘল শাসকেরা কাশ্মীর যাবার পথে এই দুর্গেই বিশ্রাম নিতেন। এলাকাটি জম্মু এবং কাশ্মীরের রাজৌরি জেলা থেকে প্রায় ৩৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত।
রজাহান এই সময়ে ভেতরে ভেতরে নিশ্চয়ই ভীষণ অস্থির ছিলেন। কিন্তু যথেষ্ট বুদ্ধিমতী নারী ছিলেন তিনি। শত অস্থিরতার মাঝেও নিজেকে স্থির রেখেছিলেন। প্রতিটি পদক্ষেপ ফেলেছিলেন ভেবে-চিন্তে। তিনি আশঙ্কিত ছিলেন, জাহাঙ্গীরের মৃত্যুর খবর এখনি পৌঁছে গেলে সাম্রাজ্য এবং প্রাসাদ উভয় জায়গাতেই অস্থিরতা শুরু হবে। ক্ষমতার লড়াই সামলাবার একটি মাত্র পথ খোলা ছিলো তার সামনে। সেটি হচ্ছে, লাহোরে পৌঁছাবার পরই জাহাঙ্গীরের মৃত্যুর খবর সকলের কাছে প্রকাশ করা। কিন্তু বাঁধ সাঁধলো তার নিজের ভাই আসাফ খান। তিনি বুঝেছিলেন পালাবদলের সময় খুব বিচক্ষণতার পরিচয় দিতে হবে তাকে। আসাফ খান অবশ্যই তার নিজের মেয়ে-জামাই খুররামকে ভবিষ্যতের সম্রাট হিসেবে দেখতে চাইবেন। আর নূরজাহানও চাইবেন, তার প্রথম স্বামীর ঘরে জন্মানো মেয়ে লাভলী বেগমের স্বামী শাহরিয়ার (জাহাঙ্গীরের আরেক ছেলে) সিংহাসনে বসুক।
তবে শেষ পর্যন্ত এগিয়ে গেলেন আসাফ খান। লাহোরে পৌঁছানো পর্যন্ত নূরজাহানকে প্রায় সম্পূর্ণভাবে নজরবন্দি করে রাখেন তিনি। আর দাক্ষিণাত্য থেকে ডেকে পাঠান খুররামকে। এই সময়ের জন্য সাময়িকভাবে জাহাঙ্গীরের বড় নাতি দাওয়ার বক্স (জাহাঙ্গীরের বড় ছেলে খসরুর বড় সন্তান)-কে দ্রুত সম্রাট বলে ঘোষণা করেন তিনি।
নূরজাহানও কিন্তু বসে থাকেন নি। পাহারাধীন অবস্থাতেও লোকজন সংগ্রহ করে জাহাঙ্গীরের ছোট ছেলে ও নিজের মেয়ে-জামাই শাহরিয়ারকে তার কাছে আসতে আদেশ দিলেন। তখন লাহোরে গিয়ে শাহরিয়ার নিজেকে সম্রাট বলে ঘোষণা দেন।
নূরজাহানের যখন লাহোরে পৌঁছাতে আর এক দিন সময় বাকি, এর মধ্যে আসাফ খান ও দাওয়ার বক্স লাহোরে পৌঁছে শাহরিয়ারকে পরাজিত করে কারাবন্দি ও অন্ধ করে দেন এবং ১৬১৭ সালে খুররামকে দিল্লির সম্রাট বলে ঘোষণা করেন। সম্রাট হবার পর খুররাম ‘শাহজাহান’ নামে পরিচিত হন এবং নূরজাহানকে গৃহবন্দি করেন।
এবার দেখা গেলো, নূরজাহানের অন্য এক রূপ, একজন পরিবর্তিত শক্তিশালী নারীর ভূমিকায় তিনি অবতীর্ণ হলেন। সম্রাট হিসেবে শাহজাহানের অভিষেকের পর রাজনৈতিক দৃশ্যপট থেকে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে সরিয়ে নেন নূরজাহান। শাহজাহান তার জন্য বাৎসরিক দুই লক্ষ টাকা ভাতা নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন।
নূরজাহানের যে প্রজ্ঞা, বুদ্ধি ও শক্তি ছিলো; তিনি চাইলেই জাহাঙ্গীরের মৃত্যুর পরও রাজনৈতিক বিষয়গুলোতে হস্তক্ষেপ করতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেন নি। বরং তিনি পুরোপুরিভাবে রাজনৈতিক জীবন ছেড়ে একান্ত নির্জনে চলে গিয়েছিলেন। পরবর্তী জীবনে তার একমাত্র আগ্রহ ছিলো স্বামীর জন্য কিছু একটা করা। তিনি শুধু সাদা পোশাক পরতেন। কোনো আনন্দ-অনুষ্ঠানেও তেমন একটা যোগ দিতেন না। রাজনৈতিক কার্যকলাপ থেকে সম্পূর্ণ অবসর গ্রহণ করে জীবন কাটাতে শুরু করলেন একান্ত নিজের মতোন করে।
জাহাঙ্গীরের মৃত্যুর পর নিজস্ব তহবিল থেকেই তিনি স্বামীর সমাধি তৈরী শুরু করেন। বৈধব্যকালে তার অনেকটা সময় কেটেছে সেই সমাধি নির্মাণ ও তার তত্ত্বাবধান করে। সমাধি নির্মাণের সময় সমাধির নকশা, অংলকরণ, ডিজাইন তৈরীর পুরোপুরি স্বাধীনতা তার হাতে ছিলো কি না বা তিনি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছিলেন কি না সেটা জানা যায় নি কোথাও। তবে তার স্থাপত্যকৌশলের রুচিবোধ আমরা অনেক আগেই দেখতে পেয়েছিলাম ইতমাতুদ্দৌলার সমাধি তৈরীর সময়। এটিও ছিলো এক অনন্য সৃষ্টি।
জাহাঙ্গীরের এই সমাধি লাহোরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্মৃতিস্তম্ভ। তাজমহলের পর মুঘলদের স্থাপত্যগুলোর মধ্যে এটি সবচেয়ে দৃষ্টিনন্দন ও আকারে বিশাল। এই সমাধির স্বকীয়তা হচ্ছে এর ছাদ। বেশিরভাগ মুঘল স্থাপনাগুলোর মধ্যে গম্বুজ থাকা অত্যাবশ্যকীয়, কিন্তু এই সমাধির ছাদ ছিলো সমতল। এটি জাহাঙ্গীরের ব্যক্তিগত পছন্দের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে করা হয়েছে। স্থাপত্যনির্মাণে জাহাঙ্গীরের গম্বুজ পছন্দ ছিলো না। আগ্রায় বাবার জন্য জাহাঙ্গীর যে সমাধি তৈরী করেছিলেন, সেখানে গম্বুজের ব্যবহার তিনি করেন নি। সূক্ষ্ম কারুকাজ, লাল বেলে পাথরের ওপর দৃষ্টিনন্দন মার্বেলের ব্যবহার এক মুহূর্তেই অন্য এক জগতে নিয়ে যায়।
রাজনৈতিক বিষয়ে সম্রাজ্ঞী নূরজাহানের হস্তক্ষেপ বা সক্রিয় অংশগ্রহণকে নিছক কোনো রাজনৈতিক উচ্চাভিলাস বলা যাবে না। তবে একজন মা চাইতেই পারেন তার সন্তান ভবিষ্যতে সম্রাজ্ঞী হোক। এ জন্য তিনি প্রয়োজনে খুররামকে সম্রাটের সিংহাসন থেকে দূরে সরিয়ে রাখবার চেষ্টাও করতেই পারেন। এটাই রাজনীতির খেলা। এ কারণেই খুররামের সাথে তার স্বার্থের সংঘাত সৃষ্টি হয়েছিলো। এক ছাদের নিচে দুটি উচ্চাকাঙ্ক্ষী মানুষের বসবাস থাকলে কোনো এক জনের পরাজয় ঘটবে, এটাই তো স্বাভাবিক। তবে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ তাদের কলমে নূরজাহানকে যেভাবে কটাক্ষ করার চেষ্টা করেছেন, সেটি সঠিক নয়। কারণ ভুলে গেলে চলবে না যে, তার সমসাময়িক লেখকেরা তাকে নেতিবাচকভাবে চিত্রায়িত করার কোনো চেষ্টাই করেন নি। এই ধরনের কাজ করেছিলেন টমাস রো এর মতো কিছু বিদেশী এবং মুসলিম-বিদ্বেষী লেখক। লোকমুখে শোনা প্রচলিত গল্পের ওপর ভিত্তি করে রচিত কিছু অনির্ভরযোগ্য তথ্য নিয়ে অতিরিক্ত মাতামাতি করা কিংবা এতে মনোযোগ দেয়া একেবারেই উচিৎ নয়। তার সৃষ্টি, তার অবদানগুলোকে আজ আমাদের বড় করে দেখবার সময় হয়েছে।
নূরজাহান ছিলেন মুঘল সাম্রাজ্যের ইতিহাসে সবচেয়ে প্রভাবশালী নারী। তিনি নিজের নামে যে কোনো আদেশ কিংবা নিষেধাজ্ঞা জারি করার ক্ষমতা রাখতেন। এমনকি তার নিজস্ব টাকশালও ছিলো। নিজের নামে মুদ্রাও ছাপিয়েছিলেন নূরজাহান। সংস্কৃতি, শিল্পচর্চা ও স্থাপত্যকলায় তার অবদান তো ছিলোই; এ ছাড়াও তিনি স্কুল, হাসপাতাল ও ক্যারাভানসরাইও নির্মাণ করেছিলেন। তিনি একই সাথে ছিলেন একজন সাহিত্যিক ও কবি। নূরজাহান দানশীল সম্রাজ্ঞী হিসেবেও সুপরিচিত ছিলেন।
এতো যোগ্যতাসম্পন্ন একজন নারীকে অনেকেই তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেছেন, তার অধিকার ও ক্ষমতাকে প্রশ্নের সম্মুখীন করেছেন। শাহজাহানকে মহিমান্বিত করবার প্রবণতার কারণে বিভিন্নভাবে নূরজাহানকে ছোট করে দেখানো হয়েছে। আসলে তো নূরজাহানের স্থাপত্যকলার নমুনা থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই শাহজাহান তাজমহলের মতো অনন্য সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। মূলত নারীর ক্ষমতায়নকে দাবিয়ে রাখবার জঘন্য মানসিকতা থেকেই এসব অযাচিত প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে।
কোনো এক অজানা কারণে প্রতিটি যুগেই প্রচলিত সিস্টেমের বাইরে গিয়ে নারীর কিছু করতে পারার যোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে। তবে আজ এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণের সময় এসেছে। নূরজাহানের মতো অনন্য বৈশিষ্ট্যের নারীদেরকে আরো একবার আবিষ্কারের মাধ্যমে প্রত্যেক নারীর নবমুক্তির পথকে প্রশস্ত করা সম্ভবপর হয়ে উঠবে।
রেফারেন্সঃ
- Live History India
- “Taj Mahal Trilogy#1: The Twentieth Wife” –Indu Sundaresan