১৮৯৮ খৃষ্টাব্দে সাদাস্পটন থেকে একটি ভাসমান প্রাসাদ প্রথম বারের মত তার যাত্রা শুরু করলো। তৈরি হবার পর জাঁকজমকপূর্ণ জাহাজটির বহু প্রতীক্ষিত ‘মেইডেন ভয়েজ’ ।এই জাহাজটির মত এত বিরাট ও এত আড়ম্বরপূর্ণ বিলাস বহুল সমুদ্রগামী কোন তরী আজ পর্যন্ত তৈরি হয়নি। এই জাহাজের অধিকাংস যাত্রীই ছিলেন অত্যন্ত বিত্তশালী ঘরের লোক। প্রচুর জাকজমক, বিলাস ব্যাসন ও আরাম আয়েশের মধ্যদিয়ে তারা আমেরিকা যাত্রা করেছেন। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় জাহাজটি কোনদিনই তার গন্তব্যে গিয়ে পৌঁছাতে পারেনি। পর্বত প্রমান একটি বরফের চাঁইতে ধাক্কা লেগে জাহাজের হালটি চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে যায়।–ধীরে ধীরে রাজকীয় সজ্জায় সজ্জিত জাহাজটি ডুবে যায় অগাধ লোহা পানির অতলে। সেই সঙ্গে হাজার হাজার মূল্যবান জীবনের ঘটে সলিলসমাধি। জাহাজটির অতলে তলিয়ে যাবার মুহূর্তটি কল্পনা নেত্রে আমরা যদি দেখতে চেষ্টা করি ,তবে অবশ্যই বুঝতে পারবো মৃত্যু পথযাত্রী অসহায় আরোহীদের মানসিক অবস্থা। নিরুপায় ও আতঙ্কগ্রস্থ যাত্রীদের করুণ ক্রন্দন ও হৃদয় বিদারক অন্তিম আহাজারী সহজেয় অনুমেয়।

মর্গান রবার্টসন নামে একজন উপন্যাসিক কল্পনায় ঠিক এ রকম একটি জাহাজের অস্তিত্ব ছিল। তার কাল্পনিক উপন্যাসের জাহাজটির তিনি নাম করণ করেন ‘টাইটান’। উপন্যাসটির নাম ছিল ‘ফিউটিলিটি’। উপন্যাস এবং ‘নিরর্থকথা’ নামটি সার্থক ভাবেই কিন্তু বাস্তবায়িত হয়ে ওঠে। এই উপন্যাস লেখার চৌদ্দ বছর পরে বাস্তবেও এমনি একটি জাহাজ তৈরি হয়। সে তার প্রথম সমুদ্র যাত্রা ও শুরু করে। এই নতুন জাহাজটিও সম্পদশালী যাত্রীতে বোঝাই হয়। একটি বিরাট বরফের চাঁই এর সঙ্গে এর ধাক্কা লাগে এবং জাহাজটি সলিলসমাধি লাভ করে। রবার্টসনের নভেলে যেমন পর্যাপ্ত পরিমাণ জীবন রক্ষাকারী বোটের (লাইফ বোটের) অভাব ছিল-যা কারণে অসংখ্য লোকের মৃত্যু ঘটে, আসল জাহাজেও তাই হয়। ১৯১২ সনের ১৪ই এপ্রিল এই দুর্ঘটনা ঘটে। জাহাজটির নাম ছিল আর.এম.এস.টাইটানিক।

জাহাজ ডুবির পুর্বাভাসঃ

রবার্টসন উপন্যাসের জাহাজ টাইটান ও বাস্তবের টাইটানিক জাহাজের নামেরই যে কেবল মিল ছিল তাই নয় মোটামুটি ভাবে জাহাজ দুটির আকৃতিও প্রায় সমান ছিল। উভয় জাহাজটি সমান গতি সম্পন্ন ছিল। পরিণত ক্ষমতাও প্রায় একই ছিল।যাত্রি সংখ্যা ও উভয় ক্ষেত্রে ছিল প্রায় ৩০০০-এর মত। নভেলের জাহাজটির মত বাস্তবের জাহাজটিও কোনদিন ডুববেনা বলেই সকলের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল। আর-আরও আশ্চর্য যে, উভয় জাহাজই উত্তর আটলান্টিকের একই স্থানে নিমজ্জিত হয়েছিল।

এই অদ্ভুত মিলগুলোর এখানেই শেষ নয়। টি.জি. ষ্টিড নামে একজন বিখ্যাত সাংবাদিক একটি গল্প প্রকাশ করেন। টাইটানিকের যে বিপর্যয় ঘটবে তার পূর্বাভাস আমরা তার সেই গল্পেও  পাই। ষ্টিড ছিলেন আধ্যাত্মাবাদী। যে ১৫১৩ জন লোক টাইটানিকের নিমজ্জত হওয়ার সঙ্গে সলিল সমাধি প্রাপ্ত হন, ষ্টিডও তাদের একজন ছিলেন।

রবার্টসনের ভীতিজনক ও রোমাঞ্চকর উপন্যাস কিংবা ষ্টীডের আধ্যাত্মবাদী গল্প পড়ে ১৯১২ খৃষ্টাব্দে টিইটানিকের ক্যাপ্টেন মোটেই সতর্কতা অবলম্বন করেননি। কিন্তু ঐ মর্মবিদারক বিয়োগান্ত ঘটনার স্মৃতি ২৩ বছর পড়ে ঐ পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে পতিত অন্য একটি জাহাজের রক্ষক হিসাবে কাজ করে।

উইলিয়াম রীভ্‌স্‌ নামে একজন নবীন নাবিক পর্যবেক্ষণের নিদিষ্ট স্থান থেকে পাহারায় রত। ভ্রমণকারী জাহাজটি ১৯৩৫ খৃষ্টাব্দে ইংল্যান্ড থেকে কানাডার পথে পাড়ি জমিয়েছে। এপ্রিল মাস। এই সময়েই বড় বড় বরফের চাঁই জাহাজের গতি পথে যাতায়াতের বিঘ্ন ঘটায়। টাইটানিকের গল্পের ও বাস্তবের ঘটনা রীভন-এর ভাল ভাবের জানা আছে। এ সব বরফের চাঁই-ই যে ঐ সব জাহাজের মৃত্যুবান হয়ে ওঠে এ সম্বন্ধে বেশ সচেতন ছিলেন। যুবক রীভ্‌স ছিলেন অত্যন্ত বাস্তবধর্মী ও করিতকর্মা। অদূরে বরফর চাঁই গুলো দেখে তিনি গভীর ভাবে চিন্তা করতে শুরু করলেন। মধ্য রাত্রে তার কাজের সময় শেষ হয়ে যায়। তিনি জানতেন মধ্য রাত্রেই টাইটানিক বরফের পাহাড়ে ধাক্কা লেগে নিমজ্জিত হয়ে যায়।এখনকার মত তখনও সমুদ্র অত্যন্ত শান্ত ছিল। একাকী নির্জনে জাহাজের গলুই এ দাঁড়িয়ে পর্যবেক্ষণের কর্তব্য সমাধা করতে করতে তার মনে এই চিন্তা ভাবনাগুলো কাজ করতে থাকলো। গভীর রাতের আঁধারে ক্লান্ত নিদ্রাহীন রক্তচক্ষু দূর নিঃসীম নীলিমার যে ভয়ঙ্কর বিপদ তা যেন তার চক্ষু এড়িয়ে যেতে চায়। মনে হয় নিথর সমুদ্র যেন শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে আছে। তার মনে কোথা থেকে যেন একরাশ আতঙ্ক এসে বাসা বাঁধলো । ভয়ে সে চেঁচিয়ে উঠতে চাইলো। আবার মনে হল তার এই আতঙ্ক যদি অকারণ হয় তবে তার সঙ্গী নাবিকেরা তাকে পরিহাস করবে। তাকে নিয়ে হাসাহাসি করবে-নাহ্‌, এ অসহ্য । আবার মনে হল সবাইকে সতর্ক না করাটা যদি বোকামী হয়। -যদি সত্যিই কোন বিপদ সামনে থেকে থাকে?

হঠাৎ মনে হল আজই তো সেই দিন-১৪ই এপ্রিল! ১৯১২ খৃষ্টাব্দের এই ১৪ই এপ্রিলইতো টাইটানিকের ওপর ঘোর বিপর্যয় নেমে এসেছিল। মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটেছিল অসংখ্য নিরীহ যাত্রীর।

আর স্থির থাকা তার পক্ষে সম্ভব হয়ে উঠলো না। তার ভেতর থেকে কে যেন তাকে দিয়ে বিপদ সঙ্কেত দিয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন। হালের দায়িত্বে নিয়োজিত কর্ণধার মাঝি বিপদের ঘণ্টা বাজিয়ে জাহাজটিকে বিপরীত দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে থামিয়ে দিল। আর আশ্চর্য!! মাত্র কয়েক গজ দূরে বিরাট এক বরফের চাঁই মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। রাতের আঁধারে ঠাহর করা শক্ত হলেও এ যাত্রা তারা খুব বাঁচা বেঁচে গেলেন । এই যাত্রীবাহী জাহাজটির আশেপাশে এমনই আরও অসংখ্য বরফের চাঁই ইতস্ততঃ ছড়িয়েছিল। চতুর্দিকে বরফ বেষ্টিত হয়ে ঐ স্থানে জাহাজটিকে প্রায় ৯ দিন অবস্থান করতে হয়েছে। বেতারে সংবাদ প্রেরণ করে নিউ ফাউন্ডল্যান্ড থেকে বরফ ভাঙ্গার যন্ত্র সহ জাহাজ এনে বরফের চাঁই কেটে তারা বারিয়ে আসতে পারেন। ৯ দিন যাত্রীরা বরফের শিলায় বেষ্টিত থাকতে বাধ্য হন।

টাইটানিকের মত চরমতম দুর্ভাগ্যকে বরন করতে করতে অল্পের জন্য যে জাহাজটিকে বেঁচে গেল, ভাগ্যের কি পরিহাস-সেই জাহাজটির নামও ত ছিল টাইটানিক ! আশ্চর্য নয় কি ?

Images Collected From Google