মিশরীয় পিরামিড, একমাত্র স্থাপনা হিসেবে ৪৫০০ বছর ধরে আমাদের মাঝে বিস্ময় তৈরী করে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে। ‘দ্য গ্রেট পিরামিড অফ গিজা’ বলা হয় ফারাও খুফুর নির্মিত পিরামিডকে, যেটি প্রায় ১৪৭ মিটার উঁচু। গিজার এই স্থানে পরবর্তীতে আরও দুটি পিরামিড নির্মিত হয়েছিলো। গিজার গ্রেট পিরামিডের চেয়ে অপেক্ষাকৃত ছোট পিরামিডটি নির্মাণ করেছিলেন খুফুর ছেলে ফারাও খাফরে এবং সবচেয়ে ছোট পিরামিডটি নির্মাণ করেছিলেন খাফরের ছেলে মেনকউরে। এই তিনটি পিরামিডকে একত্রে বলা হয় ‘গিজার গ্রেট পিরামিড কমপ্লেক্স’। মিশরের বিভিন্ন জায়গায় অসংখ্য পিরামিড থাকলেও গিজার গ্রেট পিরামিড তিনটি আমাদেরকে সবচেয়ে বেশি বিস্ময়ের জায়গায় ধরে রাখে।
কোনো প্রকার ক্রেন কিংবা চাকার সাহায্য ছাড়া কিভাবে এতো ভারী পাথরে তৈরী এসব পিরামিড নির্মাণ করা হয়েছিলো, সেটিই মূলত বিস্ময় সৃষ্টি করে। ‘দ্য গ্রেট পিরামিড অফ গিজা’-র ওজন প্রায় ছয় মিলিয়ন টন, যা আজকের দিনের সবচেয়ে ভারী স্থাপনা ‘বুর্জ খলিফা’-র চেয়েও অনেক ভারী। ‘বুর্জ খলিফা’-র ওজন মাত্র পাঁচ লাখ টন।
এই পিরামিড সম্পর্কে অনেকে অনেক রকম তথ্য দিয়েছেন। অনেকে তো বলেছেন, পিরামিডগুলো ইলেকট্রিসিটি উৎপাদনের পাওয়ার হাউজ। অর্থাৎ এক সময় ধারণা করা হতো যে, মিশরীয়রা কোনোভাবে ইলেকট্রিসিটি তৈরী করেছিলো, যার পাওয়ার হাউজই ছিলো এই পিরামিডগুলো। অবশ্য সে সময় মিশরীয়দের বিদ্যুৎ ব্যবহারের কোনো প্রমাণ আজ পর্যন্ত মেলে নি। কেউ কেউ আবার ভিন্ন মত দিয়েছেন। যেমন, বেন কার্সন নামের একজন রাজনীতিবিদ তার ব্যক্তিগত মত থেকে বলেছিলেন, মিশরীয় পিরামিডগুলো ছিলো জোসেফের সবজি রাখার গুদামঘর। এই ধারণাটি বেশ হাস্যকর! সত্যিকার অর্থে, মিশরীয়দের জন্য মৃত্যুর পরের জীবন ছিলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে মিশরীয় ফারাওদেরকে মৃত্যুর পরের জীবন সম্পর্কিত ভাবনা গভীরভাবে আচ্ছন্ন করে রাখতো। তাই তারা মৃত্যুর পর নিজেদের থাকার জায়গা হিসেবেই এসব পিরামিড নির্মাণ করেছিলেন। অর্থাৎ পিরামিডগুলো ছিলো মূলত ফারাও কিংবা বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সমাধিস্থল। এই পিরামিড তথা নিজেদের জন্য তৈরী সমাধিতে তারা মৃত্যুর পরের জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় সব রকম জিনিসপত্র রাখতেন, যেনো পরজীবনে তাদের কোনো সমস্যা সৃষ্টি না হয়।
পিরামিড গুলো যেসব পাথর দিয়ে তৈরী, সেগুলো এতো সুন্দর করে কাটা হয়েছিলো, যা ছিলো ভীষণ অবাক করার মতো। কারণ সে সময় মিশরে এসব পাথর কাটার উপযোগী কোনো যন্ত্র আবিষ্কৃত হয় নি।
গ্রীক পন্ডিত হেরোডোটাসের একটি তত্ত্ব থেকে জানা যায় যে, পিরামিডগুলো অত্যাচারিত ক্রীতদাস দিয়ে জোরপূর্বক নির্মাণ করানো হয়েছিলো। কিন্তু পিরামিডের নির্মাণশৈলী লক্ষ্ করলেই বোঝা যায় যে, যাদেরকে দিয়ে এগুলো নির্মিত হয়েছিলো, তারা নিঃসন্দেহে ভীষণ দক্ষ শ্রমিক ছিলেন এবং অত্যাচার তো দূরে থাক, তাদেরকে সবসময় ভালো খাবার-দাবার এবং ভালো পরিবেশে রাখার ব্যবস্থা করা হতো, যেনো অতিরিক্ত পরিশ্রমের এই কাজটি তারা দ্রুত ও নিপুণভাবে সম্পন্ন করতে পারেন।
অনেক গবেষক, প্রত্নতত্ত্ববিদ ও বিজ্ঞানী কিছু ধারণায় একমত হয়েছেন। তাদের ধারণা অনুযায়ী, হয়তো মিশরীয়রা এক ধরনের স্লেজ তৈরী করেছিলেন, যেগুলো পানিতে ভাসমান এবং সেই স্লেজগুলোতে করেই বিভিন্ন স্থান থেকে সংগ্রহকৃত উন্নতমানের ভারী পাথর নীল নদ দিয়ে পিরামিড নির্মাণের নির্দিষ্ট জায়গাটিতে নিয়ে আসা হতো। এরপর মরুভূমিতে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ পানি ঢেলে ঘর্ষণ কমিয়ে সেই স্লেজগুলোকে দড়ি দিয়ে টেনে আনার কাজ করতেন শ্রমিকরা। মরুভূমিতে নির্দিষ্ট পরিমাণ পানি ঢেলে ঘর্ষণ কমানোর ধারণাটি মূলত মিলেছে একজন প্রাচীন মিশরীয় গভর্নর জেহেটুহোটেপের সমাধিতে পাওয়া খ্রিস্টপূর্ব ১৮৮০ সালের একটি পেইন্টিং থেকে। সেই পেইন্টিংটিতে দেখা যায়, একটি বিশাল বসে থাকা ভাস্কর্যকে প্রায় ১৭০ জন শ্রমিক স্লেজে করে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন এবং একজন শ্রমিক ভাস্কর্যটি টেনে নেবার জায়গাটির ঠিক সামনে পানি ঢালছেন। এই ছবিটি থেকেই মরুভূমিতে পানি ঢেলে ঘর্ষণ কমানোর বিষয়টি ধারণা করা হয়েছিলো এবং এটি প্রমাণিতও হয়েছে যে, মরুভূমিতে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ পানি ঢাললে সত্যি সত্যি ঘর্ষণ কমিয়ে ভারী বস্তুকে ঠেলে নেয়া সহজ হয়।
তারপরও এতো ভারী পাথরগুলোকে পিরামিডের প্রতিটি ধাপে কি করে তোলা সম্ভব হলো, তাও কিন্তু গভীর ভাবনার বিষয়। এই বিষয়টি নিয়েও দুই ধরনের তত্ত্ব রয়েছে। ড. জোসেফ ওয়েস্ট ২০১৪ সালে বলেছেন, সম্ভবত প্রাচীন মিশরীয় শ্রমিকরা কাঠের ঢাল তৈরী করে তাতে জায়গায় জায়গায় শক্ত লাকড়ির স্তম্ভ গেঁড়ে স্তম্ভগুলোর সাথে দড়ি বেঁধে আস্তে আস্তে পাথরগুলোকে উপরের দিকে সোজা ঢাল বরাবর টেনে নিতেন এবং যেহেতু পিরামিডের অসংখ্য ধাপ, সেহেতু ধারণা করা হয় এই কাঠের ঢালগুলোকে কয়েক ধাপে তৈরী করা হয়েছিলো। অর্থাৎ পিরামিডের প্রতিটি ধাপের জন্য আলাদা করে ঢাল তৈরী করা হয়েছিলো এবং পিরামিডের উচ্চতা বাড়ার সাথে সাথে সেই ঢালও একটু একটু করে পেছনের দিকে সরিয়ে নেয়া হতো, যেনো পাথর টেনে নেয়ার জন্য ঢালের জ্যামিতিক আকৃতি বজায় থাকে।
পাথর তোলার ব্যাপারে অপর তত্ত্বটি হলো ‘শাডুফ পদ্ধতি’, যেটি মিশরে হাজার বছর আগে বিদ্যমান ছিলো। শাডুফ পদ্ধতিতে এক ধরনের লিভার ব্যবহার করা হতো, যা দিয়ে মিশরের নীলনদ থেকে সেচের জন্য কৃষকেরা পানি তুলতেন। ধারণা করা হয়, এ ধরনেরই কোনো লিভার ব্যবহার করেও হয়তো পাথরগুলোকে ধাপে ধাপে বসানো যেতে পারে। কিন্তু সত্যি বলতে, এভাবেও যদি কাজ করা হয়, তবে মাত্র ২০ বছরে কিভাবে এই পিরামিড নির্মাণ সম্ভব হয়েছে, তা আজও একটি বিশাল প্রশ্ন হয়েই রয়ে গিয়েছে।
খাফরের পিরামিডের চূড়ার দিকে এখনো সেই মসৃন চকচকে লাইমস্টোনের তৈরী বহিরাবরণ দেখতে পাওয়া যায়, যেটি আগে সমগ্র পিরামিড জুড়েই ছিলো। এই বাইরের স্তরটি হাজার বছর ধরে সংঘটিত বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ক্ষয় হয়ে গিয়েছে। লাইমস্টোনের মসৃণ স্তর থাকাকালীন পিরামিডের উপর যখন সূর্যের আলো পড়তো, তখন পিরামিডগুলো চকচক করতে থাকতো, চাঁদের স্নিগ্ধ আলোয় তা দেখাতো ঝকঝকে সাদা।
আরও একটি অবাক করা বিষয় আছে গিজার পিরামিডগুলো নিয়ে। কোনো কম্পাস বা জিপিএসের সাহায্যে ছাড়াই পিরামিডগুলো এমনভাবে তৈরী যে, এর চারটি পাশ সম্পূর্ণ সঠিকভাবে চারটি দিক নির্দেশ করে এতো বছর ধরে দাঁড়িয়ে আছে। এটি কিভাবে সম্ভব? অবশ্য এ সম্পর্কেও একটি তত্ত্ব দাঁড় করিয়েছেন পন্ডিতরা। অটাম ইকুইনেক্সের সময় যখন দিন এবং রাত একদম সমান হয়, তখন কোন বস্তুর ছায়া একদম স্ট্রেইট লাইনে পূর্ব-পশ্চিম দিক বরাবর ইশারা করে। সেই হিসাব থেকেই হয়তোবা মিশরীয়রা এই পিরামিড নির্মাণ করেছিলেন।
১৯৮৯ সালে রবার্ট বোওভাল আবার ‘ওরিয়ন কো-রিলেশন থিওরি’ প্রদান করেন। এই থিওরি অনুসারে, ওরিয়ন বেল্টের তিনটি তারার স্ট্রেট লাইনে গিজার পিরামিড তিনটির চূড়া অবস্থিত। যদিও আজকের হিসেবে এই অবস্থানে কিছুটা তারতম্য হয়েছে, কেননা কালের বিবর্তনে তারাদের অবস্থানও তাদের নিজ নিজ জায়গা থেকে কিছুটা সরে গিয়েছে। কিন্তু এটি খুবই অবাক করা বিষয় যে, কিভাবে একদম তারাদের অবস্থানের সাথে সামঞ্জস্য রেখে এই পিরামিডগুলো নির্মাণ সম্ভব হয়েছিলো। তবুও যদি পিরামিড তিনটি একই সময়ে নির্মিত হতো, তাহলে এর কিছু একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করানো যেতো, কিন্তু পিরামিড তিনটি নিশ্চিতভাবেই তিনটি ভিন্ন ভিন্ন সময়ে নির্মিত হয়েছে। তবে কি করে এমন নির্মাণ সম্ভব?
অজস্র যুক্তি, তত্ত্ব ও বিশ্লেষণের পরও এখনও পর্যন্ত গিজার এই পিরামিডগুলো আমাদেরকে রহস্যাবৃত করে রাখে। কারণ নানা রকম যুক্তির আদলে এই পিরামিডের নির্মাণশৈলীকে ব্যাখ্যার চেষ্টা করলেও সম্পূর্ণ রূপে এর সঠিক ব্যাখ্যা খুঁজে বের করা আজও পর্যন্ত সম্ভব হয়নি। কি করে এতো সঠিক স্থানে সঠিক দিক নির্দেশ করে মাত্র ২০ বছর সময়সীমায় এতো এতো ভারী পাথর একের পর এক বসিয়ে এই পিরামিড গুলো নির্মাণ করা হয়েছিলো, তার কূল-কিনারা বিজ্ঞানীরা আজও বের করতে পারেন নি। তার উপর সাড়ে চার হাজার বছরের ধকল তো আছেই। বিভিন্ন সময়ে ঘটে যাওয়া প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ভূমিকম্প ও ধ্বংসযজ্ঞ এড়িয়ে এতো মজবুতভাবে কিভাবে পিরামিডগুলো এখনো দাঁড়িয়ে আছে, তাও এক অমীমাংসিত রহস্য বটে।
আমরা যখন কোনো যুক্তি-তর্কে স্থির হতে পারি না, তখনই বিভিন্ন অলৌকিক বিষয়ের কথা উঠে আসে। যেমন, অনেকে বলেন, হয়তো এই পিরামিড কোন মানুষেরই তৈরী নয়, হয়তো এদেরকে এলিয়েনরা তৈরি করেছে। অনেকে আবার বলেন, পিরামিড আসলে দেবতাদের তৈরী। তবে এসব উদ্ভট কথার কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। নিশ্চয়ই তখন মিশরীয়রা আমাদের ভাবনারও উর্ধ্বে এমন কোনো পদ্ধতি আবিষ্কার করতে সমর্থ হয়েছিলেন, যার কারণে এতো দ্রুত এতো মজবুত ও অনন্য স্থাপনার নির্মাণ সম্ভব হয়েছিলো।
রেফারেন্স: