তাওবাদী সন্ন্যাসী ওয়াং ইয়ানলু। তার নির্জনতা প্রয়োজন। ধ্যানে মন দিবেন তিনি। ব্যাস, পার্বত্য শহর ডুনহুয়াং এর এক দুর্গম এলাকা বেছে নিলেন ধ্যান করার জন্য। সময়টা বিশের দশকের শুরুর দিকে। ধ্যানরত অবস্থায় গুহার পিছনে একটি দেওয়াল দেখে বারবারই তার মনে প্রশ্ন জাগে এই দেওয়ালটি কেন তৈরি করা হয়েছে। কৌতুহল নিবৃত্ত করতে এই দেওয়ালটি টোকা দিয়ে বুঝতে পারলেন দেওয়ালটি ফাঁপা। শুরু হয়ে গেল তার নতুন কাজ। দেয়ালটি ভাঙ্গা শুরু করলেন। ভাঙা দেয়ালের ও পাশে বের হয়ে আসলো বিশাল আকারের এক গ্রন্থাগার।
ওয়াং ইয়াংলু বিস্মিত হতভম্ব হয়ে গেলেন। ঢুকে তিনি দেখলেন গোটা গুহা জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে পাথরের তৈরি ছোট বড় নানা আকারের গৌতম বুদ্ধের মূর্তি। কোনটি ১০০ ফুট আবার তার কমও অনেকটা। এছাড়াও পুরোটা দেওয়াল জুড়ে লেখা আছে বৌদ্ধ ধর্মের নানা রকম মন্ত্র। কিভাবে উপাসনা করতে হবে, কেন উপাসনা করতে হবে, নানা আচার অনুষ্ঠানের নিখুঁত বর্ণনা। সেই সাথে সাথে বুদ্ধের বাণী এবং ছবিও আঁকা রয়েছে দেয়ালে । আরেকটু সামনে এগিয়ে দেখলেন গুহার এক কোণে প্রায় পঞ্চাশ হাজারেরও বেশি পান্ডুলিপি ছড়িয়ে রয়েছে। আরও রয়েছে নানারকম সিলমোহর। তিনি তো নিজেই একজন বৌদ্ধভক্ত। ভিক্ষুক হিসেবে জীবন বেছে নিয়েছেন তিনি। তার জীবনের বেশিরভাগ সময় এই বৌদ্ধ ধর্ম নিয়ে কাটিয়ে দিয়েও তিনি কোনদিন জানতেই পারেননি এই গুহার সম্পর্কে।
ডুনহুয়াং প্রদেশে বৌদ্ধ ধর্মের এত আশ্চর্যজনক কিছু গুপ্তধন লুকিয়ে রয়েছে তার জ্ঞান বা ধারণাই ছিল না। কে তৈরি করল এটা? আর কবেই বা তৈরি করা হয়েছিল? কেনই বা সাধারণ মানুষ এই গুহা সম্পর্কে কিছু জানে না এই প্রশ্নগুলো ক্রমাগত তার মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিলো। তবে প্রশ্নের উত্তর পেতে তার বেশ কয়েক বছর সময় লেগে গেল। এই প্রত্ন এলাকা সম্পর্কে বিশ্ববাসী জানার সাথে সাথে বিভিন্ন জায়গার ঐতিহাসিকেরা এর প্রতি আগ্রহ দেখাতে শুরু করল। ছুটে আসলেন হাঙ্গেরিয়ান বংশোদ্ভূত বিশিষ্ট ইতিহাস অনুসন্ধানকারী ইন্ডোলজিস্ট অরেল স্টাইন। শুরু করলেন এর ইতিহাস অনুসন্ধানের। তার গবেষণায় বের হয়ে আসলো, আনুমানিক পঞ্চম থেকে ১১ শতকের মধ্যে তৈরি হয়েছিল এই গুহা এবং সেখানে এই পান্ডুলিপি গুলো রাখা হয়েছিল। তারপর ৯০০ বছর এটি লোক চক্ষুর আড়ালে চলে গিয়েছিল; হারিয়ে গিয়েছিল মানুষের সংস্পর্শ থেকে। পরিত্যক্ত হতে হতে দুর্গম পার্বত্য এলাকায় অবস্থিত বৌদ্ধ এই পাঠাগার স্মৃতির অতলে হারিয়ে যায়। হংবিয়াং নামে একজন বৈদ্ধ সন্ন্যাসী এই গুহার প্রথম গ্রন্থাগারিক ছিলেন, পাশের এক বৌদ্ধ মঠের অধিকর্তাও ছিলেন। তিনি একটু একটু করে বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারীদের জন্য নির্মাণ শুরু করেছিলেন এই গ্রন্থাগার। এর সাথে যুক্ত হয়ে গিয়েছিল ভারতের বৌদ্ধ ভিক্ষুক জুয়ানযাং। এছাড়াও পড়ে এই কাজে যুক্ত হয়ে আরও অনেক ভিক্ষুক। হঠাৎ করেই দশম এবং একাদশ শতকে দুধর্ষ মঙ্গোল জাতির আক্রমণের সাথে সাথে হান রাজবংশের অত্যাচার যখন বৌদ্ধ ধর্মের উপরে ক্রমাগত বাড়তে শুরু করে তখন তারা গ্রন্থাগারকে সংরক্ষণের বিষয়ে ঐ যোদ্ধাদের হাত থেকে ঐতিহাসিক এই পাঠাগারকে রক্ষা করতে সমস্ত পান্ডুলিপি গুহার ভিতরে রেখে একটা কৃত্রিম দেওয়াল দিয়ে জায়গাটিকে লোক চক্ষুর আড়ালে নিয়ে যান।
এভাবেই বছরের পর বছর থাকার পরে মানুষও একসময় ভুলে গেলো গ্রন্থাগারের ইতিহাস। কি সমৃদ্ধ সেই পাঠাগার । বৌদ্ধ ধর্মের গ্রন্থ ছাড়াও গণিত, ইতিহাস, সাহিত্য, চিকিৎসা বিজ্ঞান, জ্যোতির্বিজ্ঞান, দর্শন ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ের উপরে লেখা গ্রন্থের পান্ডুলিপি ছিল সেই গ্রন্থাগারে। বজ্রযান বৌদ্ধ ধর্মের বিভিন্ন নিয়ম নীতি সম্মলিত বইও ছিল গ্রন্থাগারে রক্ষিত। বিশ্বের প্রাচীনতম কালিতে ছাপা গ্রন্থ ছিল সেখানে। আমরা জানি গুটেনবার্গের ছাপাখানা তৈরির আগেও তিব্বত এবং মধ্যচিনে বিশেষ একযন্ত্র ব্যবহারের মাধ্যমে বই ছাপানো হতো। সেগুলিও সেখানে সংরক্ষিত ছিল। তবে দুঃখের বিষয় পান্ডুলিপির অধিকাংশই চলে গিয়েছে ইউরোপিয়ানদের কাছে। গবেষণার কাজে নিয়োজিত অরেল স্টাইন নিজেই সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলেন প্রায় দশ হাজার পান্ডুলিপি। মূল্য দিয়েছিলেন মাত্র ১৩০ পাউন্ড। ১৯২০ সালে চীন প্রশাসন যখন নিজেদের ইতিহাস সম্পর্কে বুঝতে সচেতন হলেন তখন মাত্র ২০ শতাংশ পান্ডুলিপি সেখানে ছিল। সেগুলোই তারা বেজিং শহরে নিয়ে যান। বিশ শতকের সবচাইতে উল্লেখযোগ্য আবিষ্কার গুলোর মধ্যে এই ডুংহুয়াং পান্ডুলিপির আবিষ্কার রয়েছে। আধুনিক যন্ত্রপাতির মাধ্যমে এই পান্ডুলিপি গুলোকে ডিজিটালাইজেশন করার চেষ্টা করা হচ্ছে। এই ডিজিটাল পান্ডুলিপিগুলো চায়নার বিভিন্ন জাদুঘরে রাখা আছে। আশা করি এই ডিজিটালাইজস্ট পান্ডুলিপিগুলোর পাঠোদ্ধারের মাধ্যমে গবেষকরা ইউরোপ এবং এশিয়া সম্পর্কে বহু অজানা তথ্য সংগ্রহ করতে পারবে।
সিল্ক রোড সম্পর্কে আর নতুন করে বলার কিছু নেই। হাজার হাজার বছর ধরে ভারত, চায়না, মধ্যপ্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যের মধ্যে বাণিজ্য চলতো এই পথ ধরে। বলা যায় সিল্ক রোড ছিল প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যের সংযোগস্থল। কি না যেত এই সিল্ক রোডের মধ্যে দিয়ে। পর্যটকরা হেঁটে যেতেন এই পথ ধরে। ধর্ম প্রচারকরা তাদের ধর্মের বানী এক স্থান থেকে অন্য স্থানে পৌঁছে দিতেন। বহু জ্ঞানী জ্ঞান অন্বেষণের জন্যই ঐ পথ ধরে হেঁটে তাদের গন্তব্যে পৌঁছাতো। কেউ আসতেন বাংলাদেশের সোমপুর মহাবিহারাতে কেউ নালন্দা আবার কেউবা তক্ষশিলায়। এই পথ জ্ঞান, বাণিজ্য এবং ধর্মের আদান-প্রদান এর এক শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে কাজ করছিল। সিল্ক রোড পশ্চিম চিনের গাংসু প্রদেশে ডুংহুয়াং শহর প্রাচীন বিশ্বর অন্যতম বৃহত্তম পাঠাগার গড়ে উঠেছিল যা বহু বছর ধরে লোকচক্ষুর আরালে চলে গেছে। সেই হারিয়ে যাওয়া পাঠাগারটি নিয়েই এতোক্ষণের গল্প।