অনেক অনেক বছর আগে, চীনের এক অভিশপ্ত রাজকুমারীর সমাধি ঘিরে জন্ম নেয় অজস্র কাহিনি। মানুষ বিশ্বাস করত—মৃত্যু মানেই সবকিছুর শেষ নয়। এক নতুন জীবন শুরু হয় আরেক জগতে। তাই মৃতদের সমাধিতে রেখে দেওয়া হতো দামী জিনিসপত্র, যেন পরকালেও রাজকীয়ভাবে বেঁচে থাকতে পারেন তাঁরা। কিন্তু এই দামী ধনসম্পদ লোভীদের আকৃষ্ট করত। তাই সমাধির চারপাশে বসানো হতো ফাঁদ, আবার কখনও লেখা থাকত সতর্কবার্তা—“এখানে হাত দিলে বিপদ!”
১৯৫৭ সালের একদিন, চীনের শানশি প্রদেশের জিয়ান শহরের কাছে লিয়াংজিয়াঝুয়াং নামের এক জায়গায় প্রত্নতত্ত্ববিদরা একটি প্রাচীন সমাধি খুঁজে পান। এই আবিষ্কারের মাধ্যমে চীনের অভিশপ্ত রাজকুমারীর সমাধি নতুন আলোয় আসে। প্রথমে সেটিকে সাদামাটা কবর বলে মনে হলেও খনন চলতেই এক রোমাঞ্চকর সত্য উন্মোচিত হয়—এটি ছিল সুই রাজবংশের এক রাজকুমারীর সমাধি। আর সবচেয়ে অবাক করা ব্যাপার ছিল কফিনের গায়ে খোদাই করা চারটি চীনা অক্ষর:
“যে খুলবে, সে মরবে।”
অভিশাপের মতো শোনালেও, আসলে এটি ছিল সমাধি লুটেরাদের ভয় দেখানোর কৌশল।
কিন্তু তাতে কি! সাহসী প্রত্নতত্ত্ববিদরা কফিন খুললেন। আর সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের চোখ ছানাবড়া—ভেতরে এক অপূর্ব রত্নভাণ্ডার! হাজার বছর আগের জেডের চুলের ক্লিপ, মুক্তার নেকলেস, ব্রেসলেট—সবই ঝলমল করছিল। তার মধ্যেও একটি নেকলেস ছিল একেবারে নজরকাড়া—রক্ত-পাথর, মুক্তা আর ফিরোজা দিয়ে বানানো, আর মাঝখানে খোদাই করা এক বিশাল শিংওয়ালা হরিণ। এই অলংকারটিকে আজও চীনের সবচেয়ে শৈল্পিক রত্নগুলোর একটি হিসেবে ধরা হয়।
কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়—এই সমাধির রাজকন্যা কে ছিলেন?
সমাধির শিলালিপি থেকে জানা যায় তাঁর নাম ছিল লি জিংসুন। রাজবংশের ঘরে জন্ম নেওয়া এই ছোট্ট মেয়েটির রক্তেই ছিল বীরত্ব আর সম্মান। তাঁর প্রপিতামহ ছিলেন সেনাপতি, দাদা ছিলেন সুই সম্রাটের ঘনিষ্ঠ সহচর, পিতা ছিলেন বিখ্যাত ‘গুয়াংলু ডাক্তার’, আর মা ছিলেন এক রানীর কন্যা। লি জিংসুনের শৈশব কেটেছিল রাজপ্রাসাদের আদরে, আর তাঁকে বড় করেছিলেন তাঁর নানী—স্বয়ং রানী ইয়াং লিহুয়া।

রাজকুমারী লি জিংসুন এবং সমাধি থেকে পাওয়া রত্নভাণ্ডার
কিন্তু ভাগ্য বড়ই নিষ্ঠুর ছিল। মাত্র ৯ বছর বয়সে, ৬০৮ সালের ১ জুন, অসুস্থ হয়ে মারা যায় রাজকুমারী লি জিংসুন। দুঃখে ভেঙে পড়েন তাঁর নানী। প্রিয় নাতনিকে চিরঘুমে শায়িত করেন আর কফিনে লেখেন অভিশপ্ত সতর্কবাণী—“যে খুলবে, সে মরবে।”
তবে শতাব্দী পেরিয়ে আজ যখন সেই কফিন খোলা হয়, প্রত্নতত্ত্ববিদদের কিছুই হয়নি। বরং তাঁর আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে ইতিহাসের এক হারানো রাজকন্যার স্মৃতি আবার জেগে ওঠে। লি জিংসুনের সমস্ত অলংকার আর স্মৃতিচিহ্ন আজ যাদুঘরে সযত্নে রাখা আছে। আর ছোট্ট সেই রাজকন্যা, যার জীবন ছিল স্বল্প, এখন বেঁচে আছেন মানুষের ভালোবাসা আর ইতিহাসের পাতায়—চিরকাল। চীনের অভিশপ্ত রাজকুমারীর সমাধি আজও রহস্যময় ইতিহাসের অংশ।