প্রাচীন মিশরের মানুষরা বিশ্বাস করত, পৃথিবীতে যেমন বিপদ-আপদ লুকিয়ে থাকে, তেমনি মৃত্যুর পরের জীবনেও নানা অশুভ শক্তি অপেক্ষা করে থাকে। আর সেসব থেকে বাঁচতে তাদের ছিল এক আশ্চর্য ভরসা—অ্যামুলেট। ছোট্ট ছোট্ট এই অলংকারগুলো তারা মনে করত জাদুকরি, যেন অদৃশ্য শক্তি দিয়ে জীবিত কিংবা মৃত সবাইকে রক্ষা করছে। জীবিতরা নেকলেস বা ব্রেসলেটের মতো করে অ্যামুলেট পরত, আর মৃতদের ক্ষেত্রে মমির ব্যান্ডেজের ভেতরে লুকিয়ে রাখা হতো এই বিশেষ তাবিজ। হাজার বছরের মিশরীয় সংস্কৃতিতে অ্যামুলেট ছিল যেন এক অবিচ্ছেদ্য সঙ্গী। কখনো দামী পাথর, সোনা বা রূপো দিয়ে, কখনো ফ্যায়েন্স বা অন্য কোনো চকচকে বস্তু দিয়ে বানানো হতো এগুলো। অন্ত্যেষ্টিক্রিয়াতেও এর গুরুত্ব ছিল অপরিসীম।
এই অ্যামুলেট ব্যবহারের নিয়ম ছিল কঠিন। শুধু বিশেষজ্ঞরাই বলতে পারত কার জন্য কোন অ্যামুলেট দরকার। তাদের বলা হতো “অ্যামুলেটম্যান”—যেনো একাধারে ডাক্তার, আবার জাদুকরও। কারও অসুস্থতা, দুর্ভাগ্য বা দুর্ঘটনা ঠেকাতে, এমনকি বন্ধ্যাত্ব দূর করার জন্যও অ্যামুলেট ব্যবহার করা হতো। এগুলো ডাক্তারি পরামর্শেরই অংশ বলে মনে করত মানুষ।
মমি তৈরির পর মৃতদেহে অ্যামুলেট রাখা হতো এ বিশ্বাসে যে, মৃত্যুর পরের অজানা পথে যাত্রা করার সময় এটি তাকে সব বিপদ থেকে রক্ষা করবে। জীবিত আর মৃত—দু’জনের কাছেই তাই সমান জরুরি ছিল এই তাবিজ। গুবরে পোকা, দেবদেবীর মূর্তি বা ছোট প্রাণীর আকৃতিতে বানানো হতো এগুলো। আবার অনেক সময় কাপড় বা প্যাপিরাসে জাদুমন্ত্র লিখে ভাঁজ করে রাখা হতো, যাকে বলা হতো লিখিত অ্যামুলেট।

প্রাচীন মিশরের জাদুকরী অ্যামুলেট ও তাবিজ—যা জীবিত এবং মৃত উভয়ের সুরক্ষার প্রতীক।
সবচেয়ে বিখ্যাত ছিল গুবরে পোকার আকারে বানানো অ্যামুলেট। মিশরীয়রা বিশ্বাস করত, সূর্যদেবতা রা-র জীবনচক্র অনেকটা গুবরে পোকার জীবনচক্রের মতো। যেমন পোকাটি গোবরে গর্ত করে সেখানে ডিম পাড়ে, পরে সেখান থেকে নতুন জীবন বের হয়—তেমনই সূর্য প্রতিদিন অস্ত যায়, আবার নতুন ভোরে জন্ম নেয়। তাই গুবরে পোকার অ্যামুলেট ছিল পুনর্জন্ম আর অমরত্বের প্রতীক।
তেমনি হৃদপিণ্ড আকৃতির অ্যামুলেটও খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। মিশরীয়রা মনে করত, মানুষের জ্ঞান, অনুভূতি আর কাজের উৎসই হলো হৃদপিণ্ড। মৃত্যুর পর দেবতা মা’তের বিচারে হৃদপিণ্ডের ভূমিকা সবচেয়ে বড়। তাই প্রায় প্রতিটি মমির বুকেই পাওয়া যায় হৃদপিণ্ডের অ্যামুলেট।
আরেকটি প্রতীকী অ্যামুলেট ছিল পদ্মফুল। মিশরীয় কাহিনিতে আছে, পদ্মফুল থেকে সূর্যদেব রা এক ঐশ্বরিক শিশুরূপে জন্ম নেন, আর সেখান থেকেই সৃষ্টি হয় পৃথিবী। তাই পদ্মকে ধরা হতো পুনর্জন্ম ও সৃষ্টির প্রতীক হিসেবে।
ডিজেড স্তম্ভও এক গুরুত্বপূর্ণ প্রতীক ছিল। ফসল কাটার সময় প্রতি বছর মিশরীয়রা ডিজেড উৎসব করত। তারা স্তম্ভ বানিয়ে মাটির উপর দাঁড় করাত—যেন উর্বর ভূমি থেকে শস্য উঠে আসছে। পরে এটি দেবতা ওসিরিসের মৃত্যুর পর পুনর্জীবনকেও বোঝাতে শুরু করে। ওয়াদজ রাজদণ্ড নামের আরেকটি অ্যামুলেট বানানো হতো প্যাপিরাস গুটিয়ে। বিশ্বাস ছিল, এটি পরলে মানুষ চিরযৌবন পায়। আসলে “ওয়াদজ” শব্দের অর্থই হলো সতেজতা।

মমি ও আধ্যাত্মিক অ্যামুলেট: মৃত্যুর পরের জীবনের পথে রক্ষা ও জাদুকরী বিশ্বাসের প্রতীক।
কেবল অলংকার নয়, সমাধিতে রাখা হতো বিশেষ মূর্তিও। এগুলোকে বলা হতো শাবটি। ধনী মানুষদের কবরখানায় শত শত শাবটি রাখা থাকত। বিশ্বাস ছিল, পরজীবনে মৃতের কাজকর্মে সাহায্য করবে এই ছোট দাসমূর্তিগুলো। শুরুতে জীবিত দাসদের সমাধিতে কবর দেওয়া হতো, পরে তার পরিবর্তে বানানো হলো শাবটি। প্রতিটি শাবটির হাতে দেওয়া হতো নিড়ানি আর ঝুড়ি, যেন মালিকের কৃষিকাজে তারা ব্যস্ত থাকতে পারে। নতুন সাম্রাজ্যে প্রতিদিনের জন্য একজন করে শাবটি—অর্থাৎ ৩৬৫টি—রাখার রেওয়াজ চালু হয়। তাদের নিয়ন্ত্রণের জন্য আবার বিশেষ তত্ত্বাবধায়কও বানানো হতো, যার হাতে থাকত চাবুক। অতএব, অ্যামুলেট আর শাবটি শুধু অলংকার বা মূর্তি ছিল না, বরং প্রাচীন মিশরীয় জীবনের বিশ্বাস, ভয় আর আশার প্রতীক। আশ্চর্যের বিষয়, আজও হিন্দু ধর্মের নানা স্থানে শাবটির মতো প্রতীকী মূর্তি কবর বা চিতায় দেওয়ার রেওয়াজ আছে। মানুষের বিশ্বাস, এভাবে প্রিয়জনের সঙ্গে অদৃশ্য এক বন্ধন টিকে থাকে, আর মৃত আত্মা পরলোকে শান্তি খুঁজে পায়।
বলুন তো, কী দারুণ ছিল প্রাচীন মিশরীয়দের এই অলৌকিক বিশ্বাস আর তাদের জাদুকরি অ্যামুলেটের জগৎ!