অ্যাংলো-স্যাক্সনদের হৃদয়ের ভালোবাসার প্রতিফলন দেখা যায় তাদের তৈরি সেরা পাঁচটি গুপ্তধনে। এই গুপ্তধনগুলো কেবল দৃষ্টিনন্দন কিছু অলঙ্কার নয়, বরং গভীর ইতিহাস, ধর্মবিশ্বাস, যুদ্ধপ্রিয় মানসিকতা এবং বৈদেশিক বাণিজ্যের প্রতীক। তারা যেমন খ্রিস্টান ধর্মকে গ্রহণ করেছিল, তেমনি পুরনো পৌত্তলিক বিশ্বাসের ছাপও দেখা যায় তাদের জীবনে। ইউরোপ, স্ক্যান্ডিনেভিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যের শিল্পধারা ও প্রযুক্তি ব্যবহার করে তারা তৈরি করেছিল এক অভূতপূর্ব শিল্পভাষা। এই গুপ্তধনগুলো পাঠককে সরাসরি তাদের সভ্যতার সঙ্গে পরিচিত হতে সাহায্য করে। এগুলো তাদের ইতিহাস, বিশ্বাস এবং কল্পনার এক সুন্দর জীবন্ত কাহিনি তৈরি করেছে।
১। সাটন হুর নৌকা ও রাজার সমাধি: ১৯৩৯ সালের গ্রীষ্মের এক দিনে, সাফোকের সাটন হুর মাটির নিচে লুকিয়ে থাকা এক প্রাচীন রহস্য অদ্ভুতভাবে উন্মোচিত হয়। মাটি খুঁড়ে পাওয়া যায় ২৭ মিটার লম্বা একটি প্রাচীন নৌকা। নৌকার ভেতরে ছিল এক রাজার গোপন সমাধি। ধারণা করা হয়, এটি ইস্ট অ্যাংলিয়ার রাজা রেডওয়াল্ডের সমাধি। কবরের ভেতরে যা রাখা ছিল, তা দেখে তো সবাই হতবাক। বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের রূপার বাসনপত্র, নিখুঁতভাবে তৈরি কপ্টিক ঝোলানো বাটি, বিলাসবহুল বস্ত্র ও অলঙ্কার, গার্নেট পাথর বসানো সোনার তৈরি বিভিন্ন গয়নাপত্র। শুধু তাই নয়, সেখানে রাখা ছিল সোনার তলোয়ার, ঢাল এবং এক বিরল হেলমেট। এগুলো সবই অতীতের যুদ্ধ এবং রাজকীয় মর্যাদার সাক্ষী। এর মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় বস্তু হলো একটি হেলমেট। প্রথম অবস্থায় অনেকগুলো ছোট ছোট টুকরো খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল। সমস্ত টুকরোগুলোকে একসঙ্গে জোড়া লাগানোর পরে দেখা গেল—হেলমেটে আঁকা রয়েছে জীবন্ত এক যোদ্ধার ছবি, সেই সঙ্গে পশু ও পাখির অসাধারণ নকশা। হেলমেটটির মুখোশটি দূর থেকে দেখে মানুষের মুখ মনে হলেও কাছে গেলে বোঝা যায়, এটি ড্রাগন বা পাখির শরীর দিয়ে তৈরি এক রহস্যময় মুখোশ। সোনার তৈরি একটি পার্সের ঢাকনাও পাওয়া গিয়েছিল সেখানে। সেখানে দেখা যায় একজন মানুষ, যিনি দুই দিক থেকে আসা পাখি এবং মানব প্রাণীর মাঝে দাঁড়িয়ে আছেন; এটি যেন সাহস এবং শক্তির প্রতীক।

ইংল্যান্ডের সাফোকে সাটন হুতে দাফন করা অ্যাংলো-স্যাক্সন নৌকাটি খননের পরে মাটিতে তার ছাপ ফেলে গিয়েছিল। © britannica.com
২। লিন্ডিসফার্ন গসপেলস:
৭ম থেকে ৮ম শতাব্দীর দিকে লেখা লিন্ডিসফার্ন গসপেলস একটি অসাধারণ পাণ্ডুলিপি। ২৫৯ পাতায় সাজানো চারটি গসপেল যেন এক এক করে জীবন্ত ক্যানভাসে ফুটে উঠেছে। প্রতিটি পৃষ্ঠায় রঙিন অলঙ্করণ, প্রতীক এবং জটিল নকশায় ফুটে উঠেছে আয়ারল্যান্ডের কাজ, জার্মানির পশু-প্রতীক এবং ভূমধ্যসাগরের মানবচিত্র। প্রতিটি গসপেলকে তুলে ধরা হয় প্রতীকের মাধ্যমে—লূকের পাশে ডানাওয়ালা বাছুর, মার্কের সঙ্গে সিংহ, জনের পাশে ঈগল এবং মথির সঙ্গে মানুষ। এই চারজন ধর্মপ্রচারকের প্রতিকৃতি পাঠককে যেন সেই যুগে নিয়ে যায়। বিশপ ইডফ্রিথের লেখা এই গসপেলে তিনি ইচ্ছে করেই কিছু অসম্পূর্ণতা রেখেছিলেন, যেন পাঠকের চোখে এটি ধাঁধার সৃষ্টি করে।

লিন্ডিসফার্ন গসপেলস পাণ্ডুলিপি – অ্যাংলো-স্যাক্সন শিল্প © wikimedia
৩। স্ট্যাফোর্ডশায়ার হোর্ড: অ্যাংলো-স্যাক্সনদের সোনা ও রূপার খনি ৬ষ্ঠ থেকে ৭ম শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে তৈরি অ্যাংলো-স্যাক্সনদের এক বিশাল ধনভাণ্ডার লুকিয়ে ছিল স্ট্যাফোর্ডশায়ারে। প্রায় ৩৬০০ টুকরো সোনা ও রূপার অস্ত্র; অলঙ্করণে ভরা এই ভাণ্ডার যেন যুদ্ধক্ষেত্রের কাহিনি বলছিল। গার্নেট পাথর বসানো সোনার টুকরো, সূক্ষ্ম ফিলিগ্রি, কাচ ও রত্নখচিত নকশা—সবকিছু যেন যোদ্ধাদের সাজানোর জন্য তৈরি করা হয়েছিল। এখানে খ্রিস্টান ধর্মের প্রতীকও পাওয়া গিয়েছে। এটি প্রমাণ করে যে, সেই সময় পৌত্তলিক বিশ্বাস আর খ্রিস্টধর্ম কাঁধে কাঁধ মিলিয়েই চলত। গার্নেট পাথরগুলো এসেছিল দূরের ভারত ও চেক প্রজাতন্ত্র থেকে। এর অর্থ, এই যোদ্ধারা শুধু যুদ্ধপ্রিয়ই ছিল না, তারা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের সঙ্গেও যুক্ত ছিল। অ্যাংলো-স্যাক্সনরা মূলত জার্মানিক উপজাতি ও ব্রিটেনের স্থানীয় জনগণের মিলিত সংস্কৃতির ফল।

স্ট্যাফোর্ডশায়ার হোর্ড: সোনা-রূপার যুদ্ধের স্মৃতি © wikimedia
৪। ফ্র্যাঙ্কস কাস্কেট:
এটি একটি ছোট তিমির হাড় দিয়ে তৈরি বাক্স, এতে খোদাই করা রয়েছে অসাধারণ কিছু দৃশ্য। এক পাশে নকশা করা আছে জার্মানিক পৌরাণিক কাহিনি—ওয়েল্যান্ড দ্য স্মিথের প্রতিশোধ, অন্য পাশে খ্রিস্টের জন্ম ও তিন জ্ঞানীর উপহার। বাক্সে রোমান ইতিহাসও স্থান পেয়েছে—রোমুলাস ও রিমাসকে নেকড়ে লালন এবং জেরুজালেম দখলের দৃশ্য। বোঝাই যাচ্ছে, এই বাক্সে একসঙ্গে পৌত্তলিক বিশ্বাস, খ্রিস্টধর্ম এবং রোমান ইতিহাসের মিশ্রণ ফুটে উঠেছে। এটি অ্যাংলো-স্যাক্সনদের শিল্প ও সংস্কৃতিকে জীবন্তভাবে প্রকাশ করে।

ফ্রাঙ্কস ক্যাসকেট, যেমন প্রদর্শিত হয়েছে ব্রিটিশ মিউজিয়াম; সামনে এবং ঢাকনা © wikimedia
৫। প্রিটলওয়েল সমাধি:
৬ষ্ঠ শতকের এক রহস্যময় সময়ের কথা। প্রিটলওয়েলের ধূলিমাখা জমিতে খুঁজে পাওয়া গেল এক রাজকীয় সমাধি। সমাধিটির ভিতরে সম্রাটদের জীবন ও ভক্তির নিদর্শন লুকিয়ে আছে। কবরের ভেতর ঢুকতেই চোখে পড়ে বিলাসবহুল পানপাত্র, কাচের জিনিসপত্র, ঝুলন্ত বাটি, সোনার বেল্ট, আর ভাঁজ করা লোহার একটি চেয়ার। সেই চেয়ারটি যেন বিচারকের মর্যাদাশীল আসন। সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় ছিল সমাধির ভেতরে রাখা দুটি সোনার ক্রস। এগুলো দেখে মনে হয়, “খ্রিস্টধর্ম সেই সময়ই তখন রাজকীয় জীবনে প্রবেশ করেছিল।” সমাধির মালিককে নিয়ে গবেষকদের মধ্যে বিতর্ক রয়েছে। কেউ বলেন, এটি সেই সময়ের রাজা এথেলবার্টের ছেলে সেক্সারের সমাধি।

প্রিটলওয়েল সমাধি © wikimedia
এই পাঁচটি গুপ্তধন যেন অ্যাংলো-স্যাক্সনদের হৃদয়ের কথা বলে। তারা শুধু লড়াইয়ে পারদর্শী ছিল না, একই সঙ্গে বিশ্বাস করত অদৃশ্য শক্তিতে। ভালোবাসত ধাঁধা আর রহস্য। দূরদেশ থেকে আসা শিল্পকর্ম ও বাণিজ্যের রঙিন ছোঁয়াও জায়গা করে নিয়েছিল তাদের জীবনে। তাদের হাতে তৈরি অলঙ্কার তাই কেবল সৌন্দর্যের প্রতীক নয়—সেগুলো যেন গল্প বলছে। প্রত্যেকটি অলঙ্কার, প্রতিটি জিনিস, প্রতিটি নকশা যেন পাঠককে ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে সেই প্রাচীন নৌকার ভেতরে—যেখানে রাজা, যোদ্ধা এবং শিল্পীর দক্ষতা একত্র হয়ে তৈরি করেছিল ইতিহাসের এক অনন্য অধ্যায়।