বলা হয়ে থাকে, বহু আগে থেকেই জাহাঙ্গীর মেহেরুন্নিসা এর প্রণয়াসক্ত ছিলেন এবং পরবর্তীতে মেহেরুন্নেসাকে পাবার জন্যই বাংলার সুবেদার পদ থেকে মানসিংহকে সরিয়ে জাহাঙ্গীর কুতুবুদ্দিন খাঁকে বহাল করেন। মেহেরুন্নেসা তখন শের আফগানের বৈধ বেগম। সুতরাং তাকে হত্যা করলেই নুরজাহানকে আয়ত্ব করার জন্য তার কোন বাঁধা থাকে না। এত সব কারসাজি ওই নারীর জন্যই করা হয়। কিন্তু সত্যিই কি জাহাঙ্গীর মেহেরুন্নিসা–এর প্রেমে উন্মাদ হয়ে ছিলেন? এবং শুধু এ কারণেই তিনি শের আফগানকে হত্যা করেছিলেন? আজ এর পোষ্টমর্টেম করার জন্য কিছুটা সময় বের করবো। সমসাময়িক ঘটনা গুলোকে পর্যালোচনা করলেই এর উত্তর পাওয়া যাবে। মোঘল সাম্রাজ্যের সম্পদ, চাকচিক্য ও প্রতিপত্তি তখন তুঙ্গে। সারা পৃথিবীর নজর তখন এ উপমহাদেশের দিকে। এবং এটাই পৃথিবীর নিয়ম। মাইগ্রেশন এর পথটা ঠিক বিপরীত দিকে ছিল, West to East l তাইতো আমরা দেখতে পাই টমাস রো, এডওয়ার্ড থেরি, উইলিয়াম ফিজ, ক্যাপ্টেন হকিন্স, মেনুচি মোঘল শাসনকালে বিভিন্ন সময়ে ভারতে আসেন। তারা ভারতবর্ষে অনেকটা সময় কাটান। একপর্যায়ে তারা তাদের অভিজ্ঞতাকে বই আকারে প্রকাশ করেন। আমাদের প্রথম চেষ্টা তাদের বই থেকে কিছু পাওয়া যায় কিনা তা খুঁজে দেখা l
তারা তৎকালীন সম্রাট বা তাঁর পরিবার সম্পর্কে যে-সব তথ্য দিয়েছেন, তাতে অনেক কুৎসা থাকলেও, কোথাও মেহেরুন্নিসার প্রতি জাহাঙ্গীরের প্রেম বা জাহাঙ্গীরের শের আফগান-হত্যা সম্পর্কে কোনও উল্লেখ নেই। সত্যি যদি তেমন কিছু ঘটতো তবে তারা নিশ্চিত ভাবে তা তাদের বই গুলোতে উপস্থাপন করতেন। সম্রাট নিজেও তাঁর আত্মজীবনী ‘তুজুক-ই-জাহাঙ্গিরী’তে নিজের সম্পর্কে একেবারে নির্ভিকভাবে নানা ঘটনা উল্লেখ করলেও মেহেরুন্নিসার প্রতি ভালোবাসার বা শের আফগান-হত্যা প্রসঙ্গের কোনও উল্লেখ নেই। এমনকি সমসাময়িক কয়েকটি ফারসি ইতিহাস ‘মা-আসেরে-জাহাঙ্গিরী’, ‘পান্দ-নামায়ে-জাহাঙ্গিরী’, ‘তারিখ-ই-সেলিমশাহী’তেও ঘটনা দুটির কোনও উল্লেখ নেই। প্রথম প্রচেষ্টাতে জাহাঙ্গীরকে তেমন ভাবে দোষী সাব্যস্ত করতে পরা গেলো না।
এখন আসি দ্বিতীয় সূত্রটিতে । কাফি খাঁ ছিলেন মোঘল পরিবার বিদ্বেষী। তাঁর ভ্ৰষ্টাচারে রুষ্ট হয়ে আওরঙ্গজেব তাঁকে মোঘল পরিবার নিয়ে ইতিহাস লিখতে নিষেধ করলে, তিনি প্রকৃত নাম হাসিম খাঁ-র পরিবর্তে, কাফি খাঁ ছদ্মনামে লিখতে শুরু করেন। পরে ইতিহাসবিদ এলফিনস্টোন, কাফি খাঁকে অনুসরণ করে ইতিহাস রচনা করায়, এই বিদ্বেষমূলক গল্পটি সংক্রামিত হয়েছে সাধারণের মধ্যেও। এখন আবার আরো একটু ফ্ল্যাশব্যাক করতে হবে। আমরা জানি জাহাঙ্গীর একপর্যায় তার বাবা আকবর এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন। বাবা ছেলের এ দ্বন্দ্বে শের আফগান আকবরকে সমর্থন করলে তাদের দুজনের মধ্যে কিছুটা দুরত্ব তৈরি হয় l মোটাদাগে শের আফগান জাহাঙ্গীরের শত্রুর খাতাতে তালিকাবদ্ধ হন l ওই দিকে মানসিংহ ছিলেন তার বিদ্রোহী ছেলে খসরুর মামা। শাহজাদা খুসরুর পক্ষাবলম্বী মানসিংহ যদি সাম্রাজ্যের কোনও ক্ষতি করে বসেন, তাই তাঁকে এবং তাঁর বিরোধী (বাবারবিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার সময়) শের আফগানকে বাংলায় রাখা সমীচীন মনে না করে, জাহাঙ্গির তাঁদের দিল্লিতে ফেরত আসার ফরমান দিয়ে ভাই কুতুবুদ্দিনকে পাঠান।এটাই হচ্ছে প্রকৃত ইতিহাস।
এ খবরে শের আফগান প্রমাদ গুনলেন। তিনি খুব ভালো করে জানতেন, সম্রাট তাঁর প্রতি প্রীত নন। তাই কুতুবুদ্দিনের মুখে দিল্লি যাওয়ার কথা শুনেই ভাবলেন, এটা তাঁকে বিপদে ফেলার কৌশল। ক্ষিপ্ত হয়ে তিনি কুতুবুদ্দিনকে হত্যা করেন। ঘটনাটি ঘটে একজন কাশ্মীরি সৈন্য এর সামনে। ঘটনা প্রত্যক্ষ করার সাথে সাথে তিনি শের আফগানকে হত্যা করেন। এ ঘটনার বিবরণ ইতিহাসে আছে। একই সময়ে সংঘটিত দুটি হত্যাই হয়েছিল বর্ধমানে তবে তা মেহেরুন্নেসার জন্যে নয় l শহরের পশ্চিম প্রান্তে এই দুই নিহতেরই সমাধি রয়েছে একই জায়গায় পাশাপাশি।
স্বামীর মৃত্যুর পর মেহেরুন্নিসাকে দিল্লি পাঠিয়ে দেওয়া হয়। জাহাঙ্গীরের মায়ের কাছে চার বছর কাটানোর পর, নওরোজের এক উৎসবে সম্রাট প্রথম মেহেরুন্নিসাকে দেখেন। তাঁর রূপে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে বিয়ে করেন। তিনি হয়ে ওঠেন মোঘল সাম্রাজ্যের অন্যতম ক্ষমতাবতী নারী- নূরজাহান। প্রশ্নটা এখানেই— যে সম্রাট তাঁকে বিয়ে করার জন্য তাঁর স্বামীকে হত্যা করলেন, তিনি কী কারণে চার বছর অপেক্ষা করলেন? সেই সময় ভূ-ভারতে এমন কি কোনও শক্তি ছিল, যা সম্রাটকে নিরস্ত করতে পারত?
ইতিহাসবিদ নিজামুদ্দিনের ‘তাবকাত-ই-আকবরী’ গ্রন্থে জাহাঙ্গীরের বাল্য ও যৌবনের কাহিনী লিপিবদ্ধ থাকলেও, সেখানে কোথাও জাহাঙ্গির-মেহেরুন্নিসার প্রণয়ের কথা উল্লিখিত নেই। শুধুমাত্র এক জন ভণ্ড ইতিহাসবিদের বিদ্বেষপ্রসূত কল্পনার জন্য ইতিহাসের পাতায় চিরকালের জন্য কলঙ্কিত হয়ে গেলেন সম্রাট জাহাঙ্গীর। পরবর্তীতে conspiracy theory কাজ করে এখানে l বিভিন্ন ভাবে এর ডালপালা ছড়ায়। ব্রিটিশ লেখকরা এই মুখরোচক গল্পটি লুফে নেয়। মিথ্যা মামলা করা হয় সম্রাট জাহাঙ্গীরের নামে। এ মামলা কিন্ত আদালতে হয় না। হয় মানুষের মনের আদালতে।আমাদের কাজ ভুল সংবাদ গুলোকে ভুল হিসাবে চিহ্নিত করে সত্যকে প্রতিষ্ঠা করা। কে ভালো বা কে মন্দ তার বিচারে বসিনি ,যা সত্য তাই জানার চেষ্টা করছি।
দ্বিতীয় পর্ব
কে এই শের আফগান একটু জানা দরকার l তাই না?
শের আফগান, আলি কুলি খাঁয়ের জন্ম পারস্যদেশে। কমবয়সে তৎকালীন শাসক সফবীর বংশের ইসমাইল মির্জার সফর্চি (খাবার পরিবেশক) হিসেবে নিযুক্ত হন। ইসমাইল মির্জা মারা যেতে আলি কুলি সব ছেড়েছুড়ে পালান। মুলতানে চলে আসেন। শক্তসমর্থ, ভালো যোদ্ধা হওয়ায় মুঘল সেনায় কাজ পেয়ে যান। অল্প দিনেই দায়িত্বনিষ্ঠ আলি কুলি কিছু জমি রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বও পেয়ে যান মুঘল উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের সুনজরে থাকার জন্য। পদোন্নতি হয়। এবার একেবারে লাহোরের বাদশাহি কোর্টে। এখানেই মুঘল সম্রাট আকবরের সংস্পর্শে আসেন আলি কুলি খাঁ। ক্রমেই সম্রাটের ঘনিষ্ঠ বিশ্বাসভাজন হয়ে ওঠেন। আকবরের ছেলে সেলিমের বন্ধুস্থানীয় ও বিশ্বস্ত অনুচরের মত ছিলেন আলি কুলি। সেলিমের সঙ্গেই একদিন শিকারে বেরিয়ে সেলিম বাঘের আক্রমণের মুখে পড়লে তার প্রাণ বাঁচান আলি কুলি। তার ‘শের আফগান’ উপাধি এই ঘটনার জন্যই।
‘আফগান’-এর সঙ্গে আফগানিস্থানের কিন্তু কোনও সম্পর্ক নেই। পারসিক ভাষায় ‘আফগান’-এর অর্থ ‘কব্জা করে যে’। শেরকে কব্জা করেছিলেন বলে তিনি ‘শের আফগান’। আলি কুলি খাঁ ১৫৯৪-তে বিয়ে করেন মেহরুন্নিসাকে। এই বিয়ের তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন স্বয়ং আকবর। সিংহাসনে বসে জাহাঙ্গীর আলি কুলিকে লাহোর থেকে সুদূর বর্ধমানে পাঠান। জাহাঙ্গীরের সৎ ভাই সুবেদার কুতুবউদ্দিনের অধীনে বর্ধমানের জায়গিরদার হিসেবে নিযুক্ত হন তিনি। নতুন জায়গায় নিযুক্ত হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই আলি কুলি খাঁর বিরুদ্ধে কর ফাঁকি দেওয়া ও বৈদেশিক আফগানদের সাহায্য করার অভিযোগ ওঠে। সম্রাটের বিশ্বাসভঙ্গের দোষে সাব্যস্ত আলি কুলিকে বিচারালয়ে নিয়ে আসতে বলা হয় কুতুবউদ্দিনকে। আলি কুলি ধরা দিতে গররাজি হন। কুতুবউদ্দিন কৌশলে তাকে ধরতে এলে আলি কুলি কুতুবউদ্দিনকে আক্রমণ করেন। গুরুতর জখম হন কুতুবউদ্দিন। কুতুবউদ্দিনের অনুচরদের হাতে মারা যান আলি কুলি খাঁ ওরফে শের আফগান। গুরুতর জখম হয়ে কুতুবউদ্দিনও মারা যান। আর, আলমগঞ্জে শের আফগানের পাশেই শায়িত রয়েছেন কুতুবউদ্দিন। একে অপরের সঙ্গে লড়ে মারা যাওয়া দুই যোদ্ধা পাশাপাশি শায়িত, চিরকালের জন্য।
আফগান কুতুব সমাধি শের আফগান এর কবর